ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

নোবেলের দেশে

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ২৩ অক্টোবর ২০১৯

নোবেলের দেশে

বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রিত আলোচকদের মধ্যে অতসীও একজন। সুতরাং ওকেও ব্যস্ত থাকতে হয়েছে সেমিনার এবং কবিতা পাঠে। তবে এরই ফাঁকে ঝড়ের গতিতে দেখে নিয়েছে শহরের রাস্তাঘাট, আর্ট গ্যালারি ইত্যাদি। সুইডেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর গোথেনবার্গ আসলে সমুদ্র উপকূলীয় শহর। গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর। এক সময় ডাচ্্দের বাণিজ্য উপনিবেশ ছিল। মেট্রোপলিটন এলাকায় এক মিলিয়ন মানুষের বাস। সমুদ্র উপকূলীয় শহরের কি এক আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে বলে মনে হয় অতসীর। গোথেনবার্গ শহরে বেরিয়েও তা টের পায়। প্রসারিত দিগন্ত, বাতাসের ¯িœগ্ধ স্পর্শ, রাস্তায় উদার প্রান্তরের হাতছানি। অন্যরকম এক ভাল লাগা আচ্ছন্ন করে। আন্দামান, নিস্্, ফ্লোরেন্স ইত্যাদি সমুদ্র উপকূলীয় শহরে গিয়েও একই রকম অনুভূতি হয়েছে ওর। প্রথম দিন সেমিনার ও কবিতা পাঠ শেষে একটা আর্ট গ্যালারি দেখে সন্ধ্যার দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিল গথিয়া নদীর পাড়ে। নদীর পাড় ঘেঁষে নান্দনিক স্থাপত্যের অপেরা হাউস। বিশাল চত্বর থেকে চওড়া সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠতে হয় ভবনে। করিডরে হাঁটতে হাঁটতে অতসীর হঠাৎ মনে হয় নদী বা জলাশয়ের সঙ্গে অপেরা হাউসের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। সিডনির বিখ্যাত অপেরা হাউসও সিডনি হারবারের তীর ঘেঁষে নির্মিত। অবশ্য দেখার দৌড় তো মোটে এই দুটো। এ দিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায় না। মেলার ভেন্যু গোথেনবার্গ হলেও উৎসব চলেছে তিন শহরে। গোথেনবার্গ, উপসালা এবং স্টকহোমে। প্রথম দু’দিন গোথেনবার্গে, পরের গুলো উপসালা এবং স্টকহোমে। উপসালা থেকে ট্রেনে স্টকহোমের দূরত্ব ঘণ্টাখানেক। উপসালায় দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান বিকেলে। সকাল এবং দুপুর পুরো ফ্রি। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় অতসী। সুইডেনে এসে সিটি হল এবং নোবেল মিউজিয়ামে একটু ঢুঁ না মারলেই নয়। অনুষ্ঠানের সময়সূচীতে শেষদিন স্টকহোমে অনুষ্ঠান থাকলেও কোন ভাবেই বাইরে বেরোনোর সুযোগ নেই। সকালে উপসালার অনুষ্ঠান শেষ করে গাড়িতে মোটামুটি দীর্ঘ ড্রাইভে স্টকহোম। সেখানে বিকেলের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে। সুতরাং দ্বিধা না করে ভোরের ট্রেনে চেপে বসে। রোদ ঝলমলে দিন না হলেও মোটামুটি উজ্জ্বল আবহাওয়া। রেলযাত্রা বরাবরই প্রিয় অতসীর। আর ইউরোপের ট্রেন জার্নি তো অসাধারণ। জানালার বাইরে চমৎকার ল্যান্ডস্কেপ। এখন অটাম বা শরত ঋতু চলছে। গাছের পাতায় রং বৈচিত্র্যের অপূর্ব সমাহার। সবুজ পাতাগুলো ধীরে ধীরে হলুদ হচ্ছে। তারপর লাল, কোন কোন গাছের পাতা পুরো লাল। গাছগুলো যেন একই মাপে, সমান্তরালভাবে সাজানো, দু’ধারে বিস্তীর্ণ মাঠে হলদেটে সবুজ ঘাস। কোথাও আঁকাবাঁকা সড়কের পাশে সারিবদ্ধ রঙিন গাছ। এতদিন যা ছবি এবং পেইন্টিং-এ দেখেছে তাই এবার প্রত্যক্ষ করছে। ইউরোপের আর কোন দেশে প্রকৃতির এমন রূপ দেখেনি অতসী। যেন একখানা চলন্ত তৈলচিত্রের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে ট্রেন এসে থামে স্টকহোম স্টেশনে। সিটি হল নির্মাণ শুরু হয় উনিশ শ’ এগারো সালে। শেষ হয় উনিশ শ’ তেইশে। এর খ্যাতি মূলত নোবেল ব্যাঙ্কুয়েট ‘ব্লু হল’-এর জন্য। এক শ’ ষাট ফুট দৈর্ঘ্য, আটানব্বই ফুট প্রস্থ এবং বাহাত্তর ফুট উচ্চতার ব্লু হল এই সিটি হলের ভেতরে। নোবেল বিজয়ীরা এখানেই তাদের অফিসিয়াল বক্তৃতা করেন। তাদের সম্মানে ডিনারের আয়োজন হয় এখানে। তথ্যমতে, সুইডেনে বিশ শতকের বৃহত্তম স্থাপত্য প্রকল্প এটি। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, গথিক এবং ইতালিয়ান স্থাপত্যের সংমিশ্রণে নির্মিত। দেয়ালের গায়ে লতিয়ে উঠেছে রঙ-বেরঙের গাছ। প্রবেশপথের উপরের দিকের দেয়ালে বড় সড় ঘুলঘুলির মধ্যে স্থাপিত বিভিন্ন ধরনের মূর্তি। এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো সুইডেনের ঐতিহ্যবাহী, হাতে তৈরি এক ধরনের লাল ইটের ব্যবহার। সিরামিক ইটের মতো। আট মিলিয়ন ইট ব্যবহার করা হয়েছে পুরো ভবনের বাইরের দেয়ালে। সুইডেনের স্থাপত্যের ইতিহাসে যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে নির্মাণশৈলীতে চার্চের আদল এবং বিষণœ আবহ কেমন যেন মন ভার করা, মনে হয় অতসীর। সামনে বিস্তৃত মারলেন লেক। রবীন্দ্রনাথ কি এসেছিলেন এখানে? বেড়াতে এসেছিলেন কিনা সে তথ্য জানা নেই অতসীর। তবে সিটি হলে আসেননি তা নিশ্চিত। কেননা, তিনি নোবেল পেয়েছিলেন উনিশ শ’ তেরো সালে। আর হল উদ্বোধন হয় উনিশ শ’ তেইশের তেইশ জুন। চারপাশে লাল ইটের ভবনটির মাঝখানে সবুজ ঘাসে ঢাকা লনে দাঁড়িয়ে প্রিয়-অপ্রিয় অনেক নোবেল জয়ী সাহিত্যিকের নাম এক মুহূর্তে ছলকে ওঠে অতসীর মনে। সবচেয়ে আগে যে নামটি মনে পড়ে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমির দুর্ভাগ্য তাকে নোবেল পুরস্কার দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জ্যাঁ পল সার্ত্রে। সেটা উনিশ শ’ চৌষট্টি সালের কথা। নোবেল পুরস্কার নিয়ে এখন যা হচ্ছে! শান্তি পুরস্কার বিতর্কিত হয়েছে অনেক আগেই। এমন সব ব্যক্তিকে শান্তিতে নোবেল দেয়া হয়েছে যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির মহানায়ক। সাহিত্যের নোবেল নিয়েও মাঝে মাঝেই বিতর্কের ঝড় উঠেছে। এ পুরস্কারের পেছনেও শুরু থেকেই রাজনৈতিক বিবেচনা এবং লেখকের ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে তা ছিল নির্লজ্জ রকম দৃষ্টিকটু। জ্যাঁ পল সার্ত্রে ঘৃণাভরে এ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এর পেছনের ওই হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্যই। এবার যা হলো তাতে আর রাখঢাক রইল না। বলকান কসাই নামে পরিচিত কুখ্যাত সার্ব নেতা স্লোভোদান মিলোসেভিচের সমর্থক এবং ঘনিষ্ঠ পিটার হ্যান্ডকের হাতে এ পুরস্কার তুলে দিয়ে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি একটি জঘন্য গণহত্যাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করল। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কত তফাত! জ্যাঁ পল সার্ত্রে মানুষের মুক্তির সপক্ষে লড়েছিলেন আর হ্যান্ডকে ঠিক তার উল্টো। নোবেল পুরস্কারের ওপর খুব বেশি ভক্তি-শ্রদ্ধা অতসীর কোনকালেই ছিল না। তবু সুইডেনে এসে সিটি হল এবং নোবেল মিউজিয়াম না দেখে অভিজ্ঞতার ঝুলি ফাঁকি রাখতে চায় না। তাই এখানে আসা। যদিও ব্লু হলের ভেতরে ঢোকা হয়নি। যে লম্বা কিউ! দাঁড়ালে উপসালার বিকেলের অনুষ্ঠান ধরতে পারবে না। নির্ধারিত অনুষ্ঠান মিস করতে রাজি নয় অতসী। পারস্পরিক আলোচনায় নিজ নিজ দেশের শিল্প সাহিত্যের সাম্প্রতিক প্রবণতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। সুইডেনের বয়োজ্যেষ্ঠ কবি এলসি ইয়নসন যখন সুইডিশ সমাজে ক্রমশ বেড়ে চলা এলিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতার কথা বলেন কিংবা মানুষে মানুষে সম্পর্ক শিথিল হওয়ার কথা বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারীকরণের মন্দ দিকগুলো তুলে ধরেন অতসী তখন নিজ দেশের সমাজচিত্রই দেখতে পায়। উনিশ শ’ একত্রিশ সালে জন্ম নেয়া এলসির বক্তব্যে সুইডেনের কর্পোরেট মিডিয়া জগতের যে চিত্র উঠে আসে তাও অতসীর বড় চেনা। কবি অরনে ইয়নসন (অৎহব ণড়যহংড়হ)। বলা হয়ে থাকে টমাস ট্রমারের পর তিনি সমসাময়িক সুইডিশ ভাষার গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি। তার কবিতার বিষয়বস্তুও অচেনা মনে হয় না অতিসীর। কবি মাইনুস দালেরুস, কার্ল ইউহান বাক্যেফোনের, লার্স হ্যাগার্স, ক্রিস্টার গুসতাভসন এক অকবেলসাপার প্রমুখ কবিদের সকণ্ঠে আবৃত্তি ও অনুবাদ শুনে অতসীর মানসপটে তথাকথিত বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক প্রভাবের দৃশ্যই ভেসে ওঠে। ওর মনে হয় এখনকার একরৈখিক বিশ্বের সমস্যা ও সঙ্কটগুলো সব দেশে কম-বেশি একই ধরনের। সিটি হল থেকে সুইডিশ পার্লামেন্ট ভবন ও রাজার বাড়ি পেরিয়ে ‘নোবেল প্রাইজ মিউজিয়াম।’ এ পর্যন্ত যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের প্রত্যেকের জীবনীনির্ভর আলাদা আলাদা সফটওয়্যার চেম্বার রয়েছে। বোতাম চাপলেই হাজির রবীন্দ্রনাথ, হেমিংওয়ে, ট্রান্সট্রমার, অমর্ত্য সেন, ইউনুসÑ যাকে চাই তিনিই। অমর্ত্য সেন আছেন তার সাইকেল চেপে। অমর্ত্য’স সাইকেল নামে সুইডিশ ভাষায় কি সব লেখা রয়েছে। মিউজিয়াম সংস্কারের কাজ চলছে। একটা অংশ তাই দর্শকদের আড়ালে। মিউজিয়ামের নাম ‘নোবেল প্রাইজ মিউজিয়াম।’ তাই স্বাভাবিকভাবেই এতে বৈচিত্র্য কম। নোবেল বিজয়ীদের তথ্য, ছবি ইত্যাদি দিয়ে আর কত বৈচিত্র্য আনা যায়। আকর্ষণ বাড়াতে একটি স্যুভেনিয়র শপ ও একটি কফি শপ রাখা হয়েছে ভেতরে। নোবেল প্রাইজ মিউজিয়াম, রাজবাড়ি, পার্লামেন্ট ভবন সব শহরের পুরনো এলাকায়। তবে আমাদের পুরান ঢাকা যেমন শহরের পুরনো অঞ্চল বলে অবহেলা ও তাচ্ছিল্যে ধুঁকছে, পুরান স্টকহোমে মোটেই তেমন নয়। পুরনো রাস্তা, পুরনো বাড়ি অপরিবর্তিত আদল নিয়ে ঝকঝক করছে। অর্থাৎ পুরনো এলাকাকে এরা আধুনিক সংরক্ষণ পদ্ধতিতে আগের মতোই রেখেছে। এ এলাকায় যান চলাচল নিষেধ। ঘুরতে হয় হেঁটে। মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে চোখে পড়ে রাজবাড়ির প্রহরী বদলের চিত্র। একদল ডিউটি শেষ করে চলে যাচ্ছে, অন্য দল ডিউটি শুরু করছে। দু’দলেরই অধিনায়ক নারী। দূর থেকে দেখা যায় নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর পার্লামেন্ট ভবন। মারলেন লেকেরই অন্য পাড়ে এর অবস্থান। সিটি হলের বিপরীত দিকে। এক ঝলকে একেবারে কম দেখা হলো না। ফিরতি ট্রেন তিনটায়। সুতরাং স্টেশনের দিকে পা বাড়ায় অতসী।
×