ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

দরিদ্র-নিরক্ষর পরিবারের সন্তান এবং তাদের শিক্ষাদান

প্রকাশিত: ১২:০৩, ২৪ অক্টোবর ২০১৯

দরিদ্র-নিরক্ষর পরিবারের সন্তান এবং তাদের শিক্ষাদান

সম্প্রতি ইতালির পার্বত্য অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রাম বারবিয়ানার ছেলেদের শিক্ষকদের প্রতি এক গবেষণাপত্রের বইটি পড়ে বিস্মিত হলাম। আশ্চর্য, ওরা যা যা অভিযোগ করেছে তার অনেকগুলো আমি সে সময়ে আগত শ্রীলঙ্কার খ্যাতিমান শিক্ষক, গবেষক ড. রতœায়েকের কাছ থেকে সেই ’৮৭ সালে জ্ঞান লাভ করেছি। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দরিদ্র ও নিরক্ষরের সন্তানদের শিক্ষাগত প্রয়োজন সম্পর্কে জেনে তার ওপর অনেক কাজ করে গেছি দীর্ঘকাল। দারিদ্র্যের ও নিরক্ষরতার একটি দুষ্টচক্র দরিদ্র ও নিরক্ষরের সন্তানদের কিভাবে শ্রেণীকক্ষ থেকে প্রতিটি ধাপে কত রকম বৈষম্য সৃষ্টিকারী উপাদান দ্বারা আঘাত দিয়ে পিছিয়ে দেয় এবং শেষে কম নম্বর পেতে পেতে এক সময় তারা স্কুলশিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি আস্থা হারিয়ে স্কুল ত্যাগ করে। এই দুষ্টচক্রের ছক ভাঙ্গা যাবে ঐ শিশুদের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে সাক্ষরতার মৌলিক দক্ষতাগুলো অর্জনের নানা পদ্ধতি, কৌশল প্রয়োগ করলে। এর ওপর ভিত্তি করে গবেষণাপত্র, নানা প্রতিবেদন, শিক্ষক প্রশিক্ষণে উপস্থাপন করেছি। তাতে যে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে খুব কিছু পরিবর্তন এসেছে, তা নয়। তবে, এবার মনে হচ্ছে, যেসব উচ্চশিক্ষা গ্রহণরত ছেলে-মেয়েরা দরিদ্র, বস্তিবাসী নিরক্ষরের সন্তানদের শিক্ষাদানে ব্রতী হয়েছে, হয়তো তাদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রে এদের জন্য বারবিয়ানার ছেলেদের পরামর্শ, একই সঙ্গে আমার পুরনো পরামর্শ, কাজে আসতে পারে। দরিদ্র ও নিরক্ষরের শিশুরা কোন রকম বর্ণ পরিচয়, সংখ্যা পরিচয় সঙ্গে নিয়ে আসে না যেখানে শিক্ষিত বাবা, মায়ের সন্তানরা আগেভাগেই বর্ণ পরিচয়সহ কিছু পড়া, ছবি আঁকা, সংখ্যা গোনার দক্ষতা শিখে স্কুলে প্রবেশ করে। উপরন্তু বাসায় তাদের প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সাহায্য দেয় মা, প্রধানত। যাতে শিক্ষার প্রতিযোগিতায় তার সন্তান এগিয়ে যায় বাধাহীনভাবে। এটা স্বাভাবিক কিন্তু দরিদ্র ও নিরক্ষরের সন্তানরা বাবা, মার সাহায্য পায় না কারণ তাদের বাবা-মা নিরক্ষর এবং দরিদ্র যারা সারাদিন জীবিকার তাগিদে ব্যয় করে। সেজন্য তাদের পুরো শিক্ষাটা স্কুলে শিক্ষকদের দিতে হবে। বাবা-মায়েদের শিক্ষিত হওয়া এবং নিরক্ষর থাকা একটি বড় পার্থক্য তৈরি করে দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষা পদ্ধতি ভিন্ন হবে যদিও মৌলিক শর্তগুলো অভিন্ন হবে- এটি আমরা বুঝি। নি¤œ বা উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে যে শিক্ষকরা আমাদের খুব আনন্দের সঙ্গে পড়াতেন এমনকি, কোনদিন পাঠ্যবইয়ের পাঠের বদলে কোন গল্পের বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতেন, মাঠে, গাছতলায় বসে পড়াতেন বা গল্প শোনাতেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটকাভিনয় পরিচালনা করতেন- তাঁরা এখনও আমাদের মনের ভেতর স্থায়ী আসনে বসে আছেন। আমাদের সময় স্কুল শিক্ষকদের আমরা কোচিং করতে দেখিনি। কিন্তু, ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষা উত্তীর্ণদের জন্য তিন মাসের একটি খুব স্বল্প মূল্যের সব বিষয়ের ওপর কোচিং ক্লাস স্কুল থেকে পরিচালনা করা হতো। এখানে আমি বলব যে এই তিন মাসের নিরবচ্ছিন্ন বাংলা, গণিত, ইংরেজী বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার মান অনেকটাই উন্নতি সাধন করত। এর পাশে, টেস্ট পেপার নামে এখনকার গাইড বইয়ের মতো স্থ’ূলকায় একটি বই যাতে বিগত অনেক বছরের প্রশ্ন দেওয়া থাকত সেগুলো, বিশেষত গণিত ও ইংরেজী অনুশীলনে খুব ভাল ফল অর্জন সম্ভব করে তুলতো। আমাদের সময় কঠিন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বলে কিছু ছিল না। একটি সমন্বিত বিজ্ঞান সাধারণ বিজ্ঞান হিসেবে প্রচলিত ছিল যে ক্লাস আমরা খুবই ভালবাসতাম। এখনকার পদার্থ বিজ্ঞান বা রসায়ন যে ছিল না তা আমাদের ম্যাট্রিক পাস করাকে সহজ করেছে, নতুবা কি হতো বলা যায় না। পাশাপাশি আঁকা, পেন্টিং, সেলাই, খেলার ক্লাসও ছিল। তখন এমন নমনীয় শিক্ষাব্যবস্থা সে সময়ের শিক্ষার্থীদের মানবিক মানুষ হবার সুযোগ দিয়েছে বলে বিশ্বাস করি। কিন্তু এখন তো মানবিক শাখা বাদ দিলে বিজ্ঞান ও কমার্স শাখার লেখাপড়া তো অনেক কঠিন। আমি বিস্ময় বোধ করি, কিভাবে গ্রামের স্কুলগুলোতে উচ্চতর গণিত, পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন ইত্যাদি পড়ানোর মতো শিক্ষক পাওয়া সম্ভব হয়েছে এবং সেখান থেকে মেধাবী কিন্তু দরিদ্র, এমনকি, ভ্যানচালক, রিক্সা চালকের ছেলে-মেয়েরা এই বিজ্ঞান, কমার্স বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করছে। আমি প্রকৃতই এই দরিদ্র মেধাবীদের পরীক্ষার কৃতিত্ব দেখে মুগ্ধ। আমার দীর্ঘকাল শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণা কাজ থেকে একটি বিষয়ে দৃঢ় মত অবলম্বন করেছিলাম যা অনেক প্রেজেন্টেশন, গবেষণার সারমর্মে বহুবার প্রকাশ করেছিলাম। তার মূল কথাটি এখানে আবারও বলতে চাই এ কারণে যে, সম্প্রতি উচ্চশিক্ষার কিছু শিক্ষার্থীদের দরিদ্র, বস্তিবাসী শিশুদের শিক্ষাদানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ লক্ষ্য করছি, তাদের অবগতির জন্য। ১. আমার শিক্ষাক্রম নিয়ে দীর্ঘকাল কাজকর্ম ও গবেষণা থেকে জেনেছি, সাদা চোখেও দেখেছি যে দরিদ্র ও নিরক্ষর পিতা-মাতার সন্তান যারা পুরো প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় ৮০%, তারা বিশেষ এবং সুনির্দিষ্ট শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ঘাটতি নিয়েই শিক্ষা অঙ্গনে প্রবেশ করে। প্রথমত, তাদেরকে তাদের নিরক্ষর বাবা, মা সাক্ষর বাবা, মায়েদের সন্তানদের মতো আগেই বর্ণমালা, সংখ্যা, কিছু পড়া, অঙ্ক করার দক্ষতা শিখিয়ে দিয়ে শ্রেণীকক্ষে পাঠায়নি। এ সত্যটি কোন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। ২. সুতরাং, শিক্ষার সূচনায়, শিক্ষাক্রম যাই হোক, স্বাক্ষর ও নিরক্ষর দরিদ্রের সন্তানদের মধ্যে বিশাল বৈষম্য তৈরি হয়। অথচ, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ঐ স্তরের ৮০% ভাগ দরিদ্র-নিরক্ষরের সন্তানের জন্যই। এ লক্ষ্যে স্কুলকে প্রস্তুত থাকতে হবে যে কাজটি সঠিকভাবে এখনও সম্পন্ন করা হয় না বলে দু-চারজন মেধাবী দরিদ্রের সন্তানের ভাল ফল করার মধ্যে হারিয়ে যায়। ৩. এই ঘাটতি যা দরিদ্র ও নিরক্ষর বাবা-মায়ের সন্তানের দল সঙ্গে করে নিয়ে আসে। স্কুলের শিক্ষকদের সেই ঘাটতি পূরণ করে তাদেরকে শিক্ষিতের সন্তানদের সঙ্গে সমান মানসম্পন্ন করা দরকার- শিক্ষাক্রমের অন্তত ৮০ ভাগ পাঠ ও দক্ষতা, বিশেষত বাংলা, গণিত ও ইংরেজীর দক্ষতাগুলো শুদ্ধ ও সঠিকভাবে তাদেরকে অর্জন করতে সাহায্য করতে হবে। এ কাজের কোন বিকল্প নেই। এই প্রেক্ষিতে তরুণ, তরুণী, যারা দরিদ্রের সন্তানদের শিক্ষা দেবার কঠিন কাজটির দায়িত্ব গ্রহণ করেছে. তাদেরকে বলতে চাই- ক. প্রথমত, ওদের শিক্ষা গ্রহণের শুরুতে বাংলা, ইংরেজী ও গণিতের প্রাথমিক দক্ষতাগুলো দীর্ঘ সময় নিয়ে ওদেরকে আয়ত্ত করতে সাহায্য করতে হবে। এই সব দরিদ্রের, বস্তিবাসী শিশুদের পাশে শিক্ষিতের সন্তানরা যেহেতু থাকে না, সেজন্য এই ঘাটতি নিয়ে আসা শিশুদের স্বাক্ষরতার অধিকারটি দেওয়া সহজ এবং তখনই সম্ভব হবে যদি তারা মৌলিক স্বাক্ষরতা দক্ষতা- শোনা, বলা, পড়া, লেখা, স্থানীয় মানসহ সংখ্যা ও যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, আরও পরে ভগ্নাংশ শুদ্ধভাবে শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করে, পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে শেখানোর কাজটি করতে হবে। খ. এটি খুব স্বাভাবিক যে, যে বাড়িতে ভাত, আশ্রয়, পানি, জ্বালানি জোটানোর মতো কাজই প্রধান, সেসব বাড়ির শিশুরা ঐসব বাস্তব জীবিকাধর্মী কাজের জ্ঞান নিয়ে স্কুলে এসেছে এবং সে পরিবেশে যেহেতু বই নেই, পড়াশোনা নেই, শুদ্ধ ভাষা নেই, সেখানে বেড়ে ওঠা শিশুদের অপরিচিত বর্ণ, সংখ্যা, ভাষা, অঙ্ক শেখার কাজটি কঠিনতর মনে হবে এবং তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই এই কঠিন ভাষা ও অঙ্ক শেখার কাজটিতে অনেক বেশি সময় নেবে। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা শিক্ষিতের সন্তানেরা কিন্তু বাড়িতেই কেঁদেকেটে এই কঠিন বিষয়গুলো শিখেছিলাম। ওদেরকে প্রচুর সময় দিতে হবে। ধরা যাক, দু-ঘণ্টা যাবত ওরা শুধু বাংলা অথবা অঙ্ক অথবা ইংরেজীর প্রাথমিক দক্ষতাগুলো শিখলে, অনুশীলন করলে তাদের পক্ষে এই দক্ষতাগুলো অর্জনা করা সহজ হবে। তাতে বিষয়গুলো যখন একদিন তারা শুদ্ধভাবে শিখে নেবে, সেদিনের মতো আনন্দ আর কোনদিন শিক্ষাদাতা পাবে না- এ কথা জোরের সঙ্গে বলতে পারি। গ. একটা বড় সমস্যা আছে- ওরা দ্রুত পাঠগুলো ঠিকমতো পড়তে না শিখেই মুখস্থ করে ফেলে এবং পড়তে বললে মুখস্থ বলে যায়! এমনকি, অঙ্কও মুখস্থ করে ফেলে- নিজেদেরকে দ্রুত সফল করার লক্ষ্যে। সেজন্য, কমপক্ষে একই ধরনের বর্ণমালা দিয়ে রচিত কোন অংশ পড়াতে হবে। অঙ্কের ক্ষেত্রে সংখ্যা বদলে দিয়ে নতুন নতুন সংখ্যার যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ প্রশ্নে নানাকরম সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যবহার করে ওদেরকে মৌলিক দক্ষতাগুলো শুদ্ধ ও সঠিকভাবে শেখাতে হবে। ৪. এর পাশাপাশি ওদের অজানা- স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, অন্যের জন্য, বাবা, মা, ভাই-বোন, সহপাঠী, প্রতিবেশীর জন্য কিছু করা, দেশের জন্য কিছু করা, নিজের ভালর জন্য কিছু করা, এসব বিষয়ে তাদেরকে সচেতনতা শিক্ষা সপ্তাহে কমপক্ষে আধা ঘণ্টা দেয়া দরকার। এ ছাড়া ওদেরকে কোনদিন সদরঘাট, কোনদিন কোন খোলা মাঠে ফুটবল প্রতিযোগিতা বা অন্য খেলার সুযোগ করে দেয়া দরকার। পার্কে নিয়ে গিয়ে গাছ চেনা, ছুটে বেড়ানো, নানা খেলায় অংশ নিতে দেয়া বিনোদনের জন্য দরকার যা দু’তিন মাসে একবার হতে পারে। একটা কাজ একবার করলেই ওদের মন-চোখ খুলে যাবে চিরকালের জন্য। ওদেরকে, এমনকি শিক্ষিত মা-বাবার সন্তানদের একবার নভোথিয়েটার দেখালে ওরা বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে কৌতূহলী হবে এবং আকাশকে, সূর্য, চাঁদ, পৃথিবীকে নতুন করে চিনবে ও জানবে। ওদের চোখের ওপর থেকে একটি অন্ধকার অজ্ঞতার পর্দা সরে যাবে। ফলে শিক্ষাদাতার আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যাবে। ৫.আরেকটি কাজ রয়েছে- দলের কেউ দক্ষতা অর্জন করে দ্রুত, কিন্তু একটি ছোট দল থাকবে যারা ঐ দক্ষতা অর্জনে অনেক বেশি সময় নেবে। তাদেরকে সেই সময়টা দিতে হবে, অন্যেরা ওদের জন্য অপেক্ষা করবে, তবে তারা অন্য বই থেকে ছবি দেখবে, পড়া অনুশীলন করবে। দরিদ্র ও নিরক্ষরের সন্তান সবসময় নিম্নমানের শিক্ষা লাভ করে বলে ওরা বাবা-মার নিম্নমানের কর্ম, উপার্জনের পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। উপরন্তু, অপুষ্টি, খাদ্যাভাবে রোগে পড়ে প্রায়ই তারও পড়ার ক্ষতি হয়, সে পিছিয়ে পড়ে কম নম্বর পেয়ে, ফলে স্কুল ও শিক্ষকের প্রতি সে আস্থা হারিয়ে ফেলে, নিজের ক্ষমতার ওপরও আস্থা হারিয়ে একসময় সে স্কুল ত্যাগ করে। তখন তার কম শিক্ষা, কম অর্থের জীবিকাই তাকে নিতে বাধ্য করে। এভাবে দারিদ্র্য ও নিরক্ষতার একট দুষ্টচক্রের মধ্যে ওরা বন্দী হয়ে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এদেরকে এই দুষ্টচক্রটি ভেঙ্গে তরুণ-তরুণীরাই মুক্তি দিতে পারে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×