ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতারা রাষ্ট্রদ্রোহী, মামলা কই?

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ৭ নভেম্বর ২০১৯

 সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতারা রাষ্ট্রদ্রোহী, মামলা কই?

ভুলে গেলে চলবে না- এই সাম্প্রদায়িকতার উস্কানিদাতারাই কিন্তু সেই ’৭১-এর রাষ্ট্রবিরোধিতাকারীদের একই এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছে। অর্থাৎ, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে, চেতনাবাহী নব্বই ভাগ মুক্তিযুদ্ধপন্থীর বিপরীতে সামান্য এক দুই ভাগ পাকিস্তানপন্থী ’৭১-এর আগে থেকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নামে কাফের মুরতাদ ঘোষণা করে হত্যা, লুট, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে যে প্রাচীন সাম্প্রদায়িক এক চরম পন্থার অপরাজনীতির জন্ম দিয়ে কয়েকটি দেশে অস্থিতিশীলতার অব্যাহত এক ধারার প্রবর্তন করেছে, তারই ধারাবাহিকতায় এ সমস্ত বর্তমানের জঙ্গী সম্প্রদায়িক সংখ্যালঘু বিরোধিতার কার্যক্রম চালাচ্ছে। উপমহাদেশে দেশপ্রেমিকদের সব রকম রাজনৈতিক স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধীতা করার লক্ষ্যে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তরাংশের বেশ কিছু ধর্মান্ধের এই ‘গু-ামি’ ও মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে এই অপরাজনীতির সূত্রপাত ঘটায়। আশ্চর্য হলেও সত্য এই যে, সেই হুজুরেরা ব্রিটিশ দূতদের নির্দেশে মাত্র ১০-১২ টাকার মাসোহারার বিনিময়ে কংগ্রেস দলের নেতা জওহরলাল নেহরু, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের ধর্মনিরপেক্ষ দল খোদাই-খিদমতগার এর নেতাকর্মীদের ওপর যে নৃশংস হামলা-জেল-জুলুমের মাধ্যমে অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং ধনতান্ত্রিক বিশ্বের প্রধান সহযোগী হিসেবে এই ধর্মজীবী নিরক্ষর পীর-মোল্লাদের সমাজতন্ত্রের প্রভাবকে প্রধান বাধাদানকারী দল হিসেবে গঠন করে পশ্চিমা শক্তি। বলা চলে, পাকিস্তানের সীমান্তের অদূরে সে সময় লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে। এই পীর-মোল্লারাই কিন্তু আগাগোড়া উপমহাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করে যৎসামান্য মাসোহারার বিনিময়ে। ক্রমে পাকিস্তান, ভারত স্বাধীন হলেও সমাজে, সম্প্রদায়ে দরিদ্র নিরক্ষর জনমানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এই লোভী, স্বদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নামে গুন্ডা শাসনের বিস্তার ঘটায়। জনগণ দেখেছে আফগানিস্তানের প্রবল ধর্মনিরপেক্ষ আফগান জাতি যখন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষা, নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিতে দ্রুত গতিতে উন্নয়ন ঘটাচ্ছিল তখন যুক্তরাষ্ট্র, সিআইএ লাদেনের জন্ম দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সব নেতাকে হত্যা করে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, অসহিষ্ণু তালেবানদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। দুর্ভাগ্য, সেই সহজ সরল, ধর্মনিরপেক্ষ আফগান জাতি, যাদের অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, তারা আজ শুধুমাত্র মান্ধাতা আমলের ঘৃণ্য ও হিংসাশ্রয়ী, আধুনিকতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানবিরোধী এক তালেবানী শাসনের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। পাকিস্তান তো ব্রিটিশ আমল থেকেই এই ধর্মান্ধ-নিরক্ষর মোল্লা-মৌলবীদের কাছে জিম্মি হয়ে এক মিছামিছি গণতন্ত্রের অভিনয় করছে, যাদের পেছনে থেকে পাক সেনাবাহিনী লাদেন, তালেবান, আল কায়েদা থেকে শুরু করে নানা নামের ধর্মভিত্তিক ঘৃণা-হিংসার অপরাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে হরকত-উল-জিহাদ, হিজবুত তাহ্রীর, জইশ-ই মোহাম্মদ, লক্সর-ই তৈয়বা এবং অবশ্যই পুরনো মওদুদী বাদী- জামায়াতে ইসলাম প্রধান। বর্তমানে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারতকে অস্থিতিশীল রাখার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে সামনে থেকে পাকিস্তান সরকার, নেপথ্য থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, যারা সিআইএর কাছ থেকে লাখ লাখ ডলারের উপঢৌকন হিসেবে অর্থকরী কাজ, ব্যবসা লাভ করে। পাকিস্তানে অবশ্য এখনও ধর্মীয় গোরা দল আল-কায়েদা, তালেবান, জইশ-ই মোহাম্মদ, লস্কর-ই তৈয়বা ইত্যাদি প্রাচীন দশ টাকার পীরদের স্থান গ্রহণ করে যেহেতু সে দেশে এখন হিন্দু, খ্রিস্টান নেই বলেই ধরা যায়, তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের নিয়মিত বোমা হামলার শিকার হচ্ছে- শিয়া মুসলমানরা। অর্থাৎ মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করতে পারবে- যদি তারা ভিন্ন শাখার ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর চাইতে হাস্যকর আর কি হতে পারে! বাংলাদেশে ওই ’৭১-এর বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর সাহায্যে, প্রণোদনায়, প্ররোচনায় গঠিত জেএমবি, হরকত-উল জিহাদ, হিজবুত তাহ্রীর, আনসার আল ইসলাম, আল্লাহর দলসহ বেশকিছু ধর্মীয় জঙ্গী-সন্ত্রাসী দলের অস্তিত্ব ২০১৬-এর গুলশান ক্যাফে হামলার পর উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও কিছুটা এখনও রয়ে গেছে। এদের মধ্যে আলাদাভাবে ২০১৩ সালে উত্থান হয়েছে সন্ত্রাসী-জঙ্গী সাম্প্রদায়িক দল হেফাজতে ইসলাম-এর। আমরা এদের সম্মিলিত সাম্প্রদায়িক হামলা প্রত্যক্ষ করেছি- ১) একাধিকবার আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদের ওপর, মহররমের তাজিয়া মিছিলের ওপর এবং কিছু শিয়া মতাবলম্বী ব্যক্তির ওপর এই জঙ্গী মোল্লারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব ঘৃণা ও সহিংসতা প্রচার করেছে, সেসব শুনে ও দেখে নিজেকে মুসলিম ভাবতে লজ্জা হয়। ২) এই উগ্র ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক দলগুলো রীতিমতো ’৭১-এর আল-বদরদের মতোই তালিকা করে বিজ্ঞান মনস্ক, ধর্মনিরপেক্ষ, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসীদের নিজেদের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তে ‘কাফের’, ‘মুরতাদ’ ঘোষণ করে হত্যা করেছে। এই মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকারের শাসনকালে যখন প্রগতিশীল লেখক, কবি, বিজ্ঞানীদের চাকু, চাপাতি দিয়ে হামলা, প্রাণ হারানোর শিকার হতে হয়, তখন সরকারের কাছ থেকে জনগণ, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করছে- তাদের এসব অন্যায় হামলার হাত থেকে রক্ষা করতে দ্রুত জঙ্গী-সন্ত্রাসী খুনী ও উস্কানিদাতাদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশা করে। জনগণ সাম্প্রদায়িক দলের দৃষ্টান্ত হিসেবে হেফাজতের শাপলা চত্বরকে কেন্দ্র করে হত্যা, ত‍ান্ডব , উস্কানির অপরাধের অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করে এদের সব অপতৎপরতার মূলোৎপাটন করবে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের যেমন রক্ষা করবে, তেমনি রাষ্ট্র ও সরকার, সুশাসনের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকারকে নিশ্চিত করবে, যা এসডিজি অর্জনে সরকারকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। ৩) জনগণ দেখেছে- এই জঙ্গী ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের হামলার টার্গেট হয়েছে লালনসাঁই-ভক্ত সাধক দল। এমন কি পহেলা বৈশাখ পালন, গ্রামের যাত্রাপালার দল, মেলা, সিনেমার দর্শক, গায়ক, গায়িকা, অভিনেতা, বাদক পর্যন্ত। এরা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শত্রু- এতে কোন সন্দেহ নেই। এদের কর্মকা-ই এদের পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্য যথেষ্ট। এদের উক্ত সব অপরাধের হামলার শিকার ব্যক্তি ও পরিবার রয়েছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে রাষ্ট্র ও বাংলা সংস্কৃতি বিরোধিতার জন্য একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারগুলো করা হলে এসব সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিরোধীদের দমন করা সম্ভব হবে। এ কাজগুলো ফেলে রাখার মতো নয়। বরং দ্রুত পদক্ষেপ দাবি করে। ৪) এরপর এসেছে সংখ্যালঘুদের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে দেখানোর চেষ্টা যে, সে হিন্দু বা বৌদ্ধ হয়ে, ঐ মুসলিম সন্ত্রাসীদের যাদের নবী বেঁচে থাকলে ধর্ম থেকে বহিষ্কার করতেন, তাদের স্বহস্তে ইসলাম ও নবীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করার জন্য, মিথ্যা ছবি বানিয়ে সংখ্যালঘুর নামে প্রচার করার জন্য এরা ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীর সমান অপরাধ করেছে। তারা হিন্দু, বৌদ্ধদের বাড়িঘর লুটপাট, সম্পদ হানি, মন্দির উপাসনালয়, দেব-দেবী ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, কোন ক্ষেত্রে ধর্ষণ ইত্যাদি অপরাধ করেছে, যা প্রমাণ করে এরা পুরোপুরি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের পদলেহী পদাঙ্ক অনুসরণকারী। সুতরাং রামু, নাসির নগর, গোবিন্দগঞ্জ, সুন্দরগঞ্জ, সম্প্রতি ভোলায় যারাই ঘৃণা-সহিংস হামলার উদ্দেশ্যে উসকানি দিয়েছে, যারা হিন্দু, বৌদ্ধ তরুণের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে মিথ্যা কটূক্তিগুলো নিজেরা লিখেছে এবং যাদের উস্কানিতে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রায় শতাধিক হিন্দু বাড়ি, মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছে, তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার, নিরীহ সংখ্যালঘু জনগণের বাসগৃহ, উপাসনালয় ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন। কারণ, রামু ও নাসিম নগরে সংঘটিত অপরাধের বিচার না হওয়ায় ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা অপরাধ করেই চলেছে। এসব অপরাধের বিচার না হওয়ার জন্য তৃতীয়, তারপর চতুর্থ অপরাধ সংঘটিত করেছে তারা। কারণ তারা বার বার বিচার থেকে অব্যাহতি পেয়েছে বলেই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করেছে, করার দুঃসাহস করেছে। এক্ষেত্রে, সরকারের, জঙ্গী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিটি প্রকৃত অর্থে দেখা যাচ্ছে বাস্তবায়ন হয়নি, যা জনগণের জন্য শুধু নয়, রাষ্ট্রের জন্যও দুর্ভাগ্যজনক। সরকারের একটি অংশের নিষ্ক্রিয়তার ফলে ধর্মান্ধ জঙ্গী, সন্ত্রাসীরা ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে বারবার আঘাত করার সাহস পাচ্ছে, যার ফলে সংখ্যালঘুদের কেউ বিদেশীদের কাছে অভিযোগ জানাতেই পারে। যদিও বিদেশী সরকারের এদেশে করার কিছু নেই। কিন্তু ঘটনা তো ঘটছে। এ সত্যকে নির্মূল করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় এবং সরকার প্রধানকে ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে উক্ত সব অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। সবশেষে বলব, উন্নয়নশীল দেশে বা কোন উন্নত দেশে সে দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা কেমন, সেটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচ্য সূচক। এখানে, এক্ষেত্রে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিপুলসংখ্যাক জনগণের দেশে আমরা কিছুতেই ওই স্বল্প সংখ্যক দানবীয় ধর্মান্ধ জঙ্গীদের কাছে হার মানতে পারি না। যথাশীঘ্র ব্যবস্থা গ্রহণ করা কর্তব্য। অজয় স্যার জঙ্গীদের হাতে নিহত পুত্র অভিজিতের মামলার বাদী হয়ে আদালতে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। মৃত্যুর আগে কি তিনি পুত্র হত্যার বিচার পাবেন? লেখক : শিক্ষাবিদ
×