ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রায় দ্রুত কার্যকর হওয়া জরুরী

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ৮ নভেম্বর ২০১৯

রায় দ্রুত কার্যকর হওয়া জরুরী

নাজনীন বেগম ॥ দেশের সীমাবদ্ধ গন্ডি থেকে বিশ্ব পরিসরে তোলপাড় করা নুসরত হত্যা মামলার রায় মাত্র সাড়ে ছয় মাসে বিজ্ঞ আদালত ঘোষণা করতে পারায় বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গাটি মজবুত হয়েছে। এক অসাধারণ দুঃসাহসী, প্রতিবাদী মেয়ে নিজের ওপর হয়ে যাওয়া জঘন্য অন্যায়ের সুরাহা করতে গিয়ে মূল্যবান প্রাণটি পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। বীভৎস এই ঘটনাটি ঘটে ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা ইসলামী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাদের ওপর। রাফি এই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিল। ন্যক্কারজনক এই পাশবিকতার শুরু আরও আগে। মাদ্রাসা অধ্যক্ষ লম্পট সিরাজ উদ দৌলা সব সময় নিয়ম করে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করত। কিন্তু তখন অবধি অন্য কোন ছাত্রী এমন ঘৃণ্য অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসই দেখায়নি। ফলে পিতৃপ্রতিম শিক্ষক তার ঘৃণ্য লালসা চরিতার্থ করতে তেমন বাধার সম্মুখীনই হয়নি। প্রথমবারের মতো রুখে দাঁড়াল রাফি। বিক্ষুব্ধ অনুভবে শিক্ষকের প্রতি জন্মাল প্রচন্ড ঘৃণা। পরিবারের সবাইকে অবহিত করতে বিচারিক ব্যবস্থাকে জন্ম সক্ষমে নিয়ে এসে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতেও ছিল দ্বিধাহীন, অকুণ্ঠিত। ফলে কোন এক সময় এই রণপশু প্রচলিত আইনের শিকলে আটকা পড়ে। পুলিশ দায়েরকৃত মামলাকে আমলে নিয়ে অধ্যক্ষকে আটক করে জেল হাজতে রুদ্ধ করে দেয়। তারপর থেকেই ঘটনার মোড় ঘোরে আরও বীভৎসতার ঘেরাটোপে। বন্দী অধ্যক্ষ বিভিন্নভাবে ছাত্রী ও তার পরিবারের প্রতি মামলা খারিজ করে দেয়ার আবেদন জানালেও বার বার তা প্রত্যাখ্যাতও হয়। ক্ষিপ্ত অধ্যক্ষ আরও সহিংস পশুবৃত্তিতে স্বমূর্তি ধারণ করে। প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বই শুধু নয়, মাদ্রাসার ছাত্র এমনকি রাফির সহপাঠীদের সঙ্গে জেলে বসে গোপন আলোচনায় প্রাণে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতেও কুণ্ঠিত হয়নি। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। ক্ষমার অযোগ্য অশুভ পরিকল্পনায় সমস্ত ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হলে কুশীলবরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হতেও সময় নেয়নি। সেই ভয়াল, পশুবৃত্তির ঘটনাটি ঘটানো হয় রাফির পরীক্ষার দিনেই। বোরকা পরা দুই ছাত্রীসহ সর্বাঙ্গ ঢাকা আরও অন্যদের নৃশংস সহযোগিতায় প্রথমে রাফিকে মামলা তুলে নিতে জোর জবরদস্তি করা হয়। অপরাধীরা নিজেই খুনের যে অমানুষিক অত্যাচারের বর্ণনা দেয় তাতে সভ্যতা সূর্য অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার উপক্রম। সহজ, স্বাভাবিক আর সাবলীল শব্দচয়নে বর্ণনা উপস্থাপন করা অসম্ভবই শুধু নয় হৃদয়ের করুণ আর্তিরও এক স্পর্শকাতর মর্মবেদনা। কিভাবে রাফিকে চোখ, মুখ, হাত, পা বেঁধে সারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয় তেমন অসহনীয় বর্ণনাও সবাইকে হতবাক, ক্ষিপ্ত আর বিক্ষুব্ধ করে দেয়। মধ্যযুগীয় বর্বরতার এমন পাশবিক নির্যাতনে মেরে ফেলার যে দুঃসহ অমানবিকতা তা মনুষ্যত্বের চরম স্খলন বললেও কম বলা হয়। মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে অপরাধীরা যে যার কাজে চলে যায় একেবারে ঠান্ডা মাথায় নির্বিকারচিত্তে। কিন্তু দগ্ধ শরীর নিয়ে রাফি যখন ছাদ থেকে নামতে থাকে তখন মাদ্রাসায় কর্মরত পুলিশের নজরে পড়ে যায়। তারপর তাকে হাসপাতালে নেয়া থেকে শুরু করে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রায়ই ৫ দিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে ১০ এপ্রিল রাফির শেষ যাত্রা সবাইকে শোকে পাথর করে দেয়। সারাদেশে তখন চলছে এই পাশাবিক নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও আন্দোলন। জীবনের শেষ পাঁচদিন শুধু যন্ত্রণায় কাতর হয়ে রাফি নিশ্চুপ থাকেনি। এমন বর্বরতার বিরুদ্ধে তার সর্বশেষ আর্জিতে প্রতিকারও চেয়ে গেছে। অসহ্য বেদনায় কাতরাতে কাতরাতে ঘটনার বিবরণ দিতেও এতটুকু থমকায়নি। কাউকে সেভাবে চিনতে না পারলেও যে সব ইঙ্গিত নুসরাত বোঝাতে চেয়েছিল সেখান থেকেই অপরাধী চক্রদের নিশানা পেতে কিছুটা হলেও সম্ভব হয়। ক্রমে ক্রমে অপরাধীরা ধরা পড়তে থাকে। অধ্যক্ষসহ ১৬ জন আসামিকে চিহ্নিত করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা রুজু করা হয়। অপরাধীরা যেভাবে তাদের পরিকল্পনা থেকে আরম্ভ করে ঘটনা সাজানো সর্বশেষে ৬ এপ্রিল হত্যার স্থান নির্ধারণ, কেরোসিন সংগ্রহ করাসহ কিভাবে রাফিকে ছাদে নিয়ে আসা হবে সবই অকপটে বলতে থাকে। এখানে শুধু অধ্যক্ষই নয় আরও প্রভাব প্রতিপত্তিশালী স্থানীয় হোমড়া চোমড়াও এই সূক্ষ্ম হত্যা পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত ছিল। তবে যেসব অপরাধীকে শনাক্ত এবং চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে তাদের সবাইকে প্রমাণসাপেক্ষে মৃত্যুদন্ড দিতে বিজ্ঞ আদালত কোন ধরনের ছাড় দেননি। শুধু তাই নয় অভিজ্ঞ বিচারক রায় পড়া শুরু করতে গিয়ে প্রতিবাদী রাফির প্রতি সম্মান জানাতেও কুণ্ঠিত হননি। বিচারক মামুনুর রশিদ রায়ের আদেশ পড়তে গিয়ে ভারি কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন- নারীর মর্যাদা রক্ষায় তেজোদীপ্ত আত্মত্যাগ নুসরাতকে অমরত্ব দান করেছেন। বাদী পক্ষের বিচারকরা এমন সুষ্ঠু বিচারিক প্রক্রিয়াকে ‘ঐতিহাসিক রায়’ হিসেবে বিবেচনায় এনেছেন। বিচার শুরু হওয়ার মাত্র ৬১ কার্যদিবসে এমন রায় জনসমপক্ষে পড়ে শোনানো হয়। এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞে প্রশাসন ও নিয়মমাফিক কর্মপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী- সবাই অত্যন্ত সচেতন দায়বদ্ধতায় কোন জটিলতা ছাড়াই বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার নির্দেশ দেন। তবে বিচারের রায়ে আপীলের ব্যাপারটি উল্লেখ করে মাত্র ৭ দিন কার্য দিবসে তা সম্পন্নœœ করার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে যে ত্বরিত গতিতে বিচারের সময়কে দীর্ঘসূত্রতার বন্ধনজাল থেকে ছিন্ন করা হয় একই প্রক্রিয়ায় রায়ের আদেশ কার্যকর করারও সচেতন দায়বদ্ধতা আশা করছি মহামান্য আদালতের কাছ থেকে।
×