ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সুকুমার রায়

পুতুলের ভোজ

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ৯ নভেম্বর ২০১৯

পুতুলের ভোজ

পুতুলের মা খুকী আজ ভয়ানক ব্যস্ত। আজ কিনা ছোট্ট পুতুলের জন্মদিন, তাই খুব খাওয়ার ধুম লেগেছে। ছোট্ট টেবিলের ওপর ছোট্ট ছোট্ট থালা বাটি সাজিয়ে, তার মধ্যে কি চমৎকার করে খাবার তৈরি করে রাখা হয়েছে। আর চারদিকে সত্যিকারের ছোট্ট ছোট্ট চেয়ার সাজানো রয়েছে, পুতুলেরা বসে খাবে বলে। খুকীর যে ছোটদাদা, তার কিনা সাড়ে চার বছর বয়স, তাই সে বলে, ‘পুতুলরা খেতেই পারে না, তাদের আবার জন্মদিন কি?’ কিন্তু খুকী সে কথা মানবে কেন? সে বলে, ‘পুতুলরা সব পারে। কে বলল পারে না? কে বলল যে কখনও কোনদিন তারা কথা বলে না, কখনও কোনদিন খায় না?’ খোকা-পুতুলের যখন অসুখ করেছিল তখন সে কি ‘মা, মা’ বলে কাঁদত না? নিশ্চয়ই কাঁদত। তা না হলে খুকী জানল কী করে যে তার অসুখ করেছে? খুকীর দাদা এ সবের জবাব দিতে পারে না, তাই সে, ‘বোকা মেয়ে, হাঁদা মেয়ে’ বলে মুখ ভেংচিয়ে চলে যায়। খুকী গেল তার মার কাছে নালিশ করতে। মা সব শুনে-টুনে বললেন, ‘সব সময়ে সকলের কাছে কি পুতুলরা জ্যান্ত হয়? যেদিন দেখবি পুতুল সত্যি করে খাবার খাচ্ছে, সেদিন ছোড়দাকে ডেকে দেখাস্।’ খুকী বললে, ‘আজকে যদি ওরা জেগে উঠে খাবার খেতে থাকে, তখন কী মজাই হবে! আমার বোধ হয় রাত্তিরে যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি, তখন তাদের দিন হয়! তা না হলে আমরা তো দেখতে পেতাম? সেই যে একদিন টিনের তৈরি দুষ্টু পুতুলটা খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলÑ নিশ্চয় ওরা রাত্রে উঠে মারামারি করেছিল! তা না হলে খাট থেকে পড়ল কেন? আজ থেকে আমি ঘুমোবার সময় খুব ভাল করে কান পেতে থাকব।’ পুতুলের জন্মদিনে কি চমৎকার খাবার! ময়দার মিঠাই, ময়দার পিঠে, ছোট্ট ছোট্ট নারকলের মোয়া, আর ছোট্ট ছোট্ট গুড়ের টিক্লি- এমনি সব আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিস। রাত্তিরে শোবার আগে খুকী তার পুতুলদের ঝেড়ে মুছে নাইয়ে-খাইয়ে ঘুম পাড়াল আর বলে দিল, ‘এই দেখ্, খাবার-টাবার রইল, রাত্রে উঠে খাস্।’ কোথায় কে বসবে, কোনটার পর কোনটা খাবে, ঝগড়া করলে কে কী শাস্তি পাবে সব বলে, তারপর দুষ্টু পুতুলটাকে খুব বকে ধমকে, আর ছোট্ট পুতুলকে জন্মদিনের জন্য খুব খানিকটা আদর-টাদর করে, তারপর খুকী গেল বিছানায় শুতে। যেম্নি শোয়া অম্নি ঘুম। খুকীও ঘুমিয়েছে, আর অম্নি ঘরের মধ্যে কাদের টিপ্টিপ্ পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাদের একজন খুকুমণির জুতোর কাছে, ঘরের কোনে ছবির বইগুলোর কাছে, পুতুলদের চাদর-ঢাকা খাটের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে; এটা ওটা শুঁকছে, আর কুটুর-কুটুর করে এতে ওতে কামড়িয়ে দেখছে! খানিকটা বর্ণ-পরিচয়ের পাতা খেয়ে দেখল, ভাললাগে না; জুতোর ফিতেটা চিবিয়ে দেখল, তার মধ্যে কিচ্ছু রস নেই; টিনের পুতুলটাকে কামড়িয়ে দেখল- ওরে বাবা, কী শক্ত! এমন সময় হঠাৎ অন্ধকারে তার চোখ পড়ল- টেবিলে সাজানো ও সব কী রে! দৌড়ে চেয়ার-টেয়ার উল্টিয়ে এক লাফে টেবিলের উপর চড়ে সে একটুখানি শুঁকেই ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কিঁচ্ কিঁচ্ কী-চ্!’ তার মানে, ‘ওগো শিগ্গির এস- দেখে যাও!’ অম্নি টিপ্ টিপ্ টুপ্ টুপ্ ট্যাপ্ ট্যাপ্ থপ্ করে সেই রকম আর একটা এসে হাজির। ঠিক সেই রকম লোমে ঢাকা ছেয়ে রং, সেই রকম সরু লম্বা ল্যাজ, আর সেই রকম চোখা চোখা নাক আর মিট্মিটে কালো কালো চোখ। দুজনের উৎসাহ আর ধরে না! এটা কী সুন্দর! ওটা কেমন চমৎকার!’ এম্নি করে, দেখতে দেখতে, যত খাবার সব চেটেপুটে শেষ! সকালবেলায় খুকী উঠে দেখল- ওমা! কি আশ্চর্য! সব খাবার শেষ হয়ে গেছে! কখন যে পুতুলগুলো জেগে উঠল, কখন যে খেল, আর কখন যে আবার ঘুমোল, কিছুই সে টের পায়নি। ‘খেয়েছে! খেয়েছে! সব খাবার খেয়েছে’ বলে সে এমন চেঁচিয়ে উঠল যে মা বাবা ছোড়দা বড়দা সবাই ছুটে এসে হাজির। ব্যাপার দেখে আর খুকীর কথা শুনে সবাই বলল, ‘তাই তো! কি আশ্চর্য!’ খালি ছোড়দা বলল, ‘তা বই কি! ও নিজে খেয়ে এখন বলছে- পুতুলে খেয়েছে।’ দেখ তো কি অন্যায়! আসলে ব্যাপারটা যে কী, তা কেবল মা জানেন আর বাবা জানেন, কারণ তাঁরা ঘরের কোনে ইঁদুরের ছোট্ট ছোট্ট পায়ের দাগ দেখেছিলেন। কিন্তু সে কথা খুকীকে যদি বল, সে কখনও তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।
×