ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিকায়ন প্রকল্প মিটিং আর ফাইলপত্রে;###;কোন জেলাতেই নিজস্ব ভবন নেই ;###;বন্ধ করা যাচ্ছে না অনিয়ম, দালালদের দৌরাত্ম্য

বিআরটিএর সক্ষমতা নিয়ে সংশয় ॥ নতুন সড়ক আইন প্রয়োগ

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ৯ নভেম্বর ২০১৯

 বিআরটিএর সক্ষমতা নিয়ে সংশয় ॥ নতুন সড়ক আইন প্রয়োগ

আজাদ সুলায়মান ॥ সড়কে শৃঙ্খলা ও যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন আইন কার্যকর হলেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)- সক্ষমতা বাড়েনি। মান্ধাতা আমলের জনবল ও যন্ত্রপাতি নিয়ে কোনক্রমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামাল দিতে হচ্ছে পরিস্থিতি। ব্যাপক চাহিদার বিপরীতে কার্যক্রম সীমিত রয়েছে মন্ত্রণালয়ের বৈঠক আর ফাইল পত্রে। এখনও গড়ে ওঠেনি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআরটিএ। হয়নি আধুনিকায়নেরও কাজ। এ অবস্থায় নতুন সড়ক আইন প্রয়োগে বিআরটিএ প্রকৃতপক্ষে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সড়কে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় একমাত্র ওয়াচডগ হিসেবে বিআরটিএর অবকাঠামো, জনবল, ও যন্ত্রপাতি আধুনিকায়নের জন্য নেয়া কোন প্রকল্পই বাস্তবায়ন হয়নি আজ পর্যন্ত। দেশব্যাপী বিআরটিএর নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন, নিজস্ব ড্রাইভিং ইনস্টিটিউট প্রকল্প বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে। শুধু প্রতিমাসে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাস্তবে কোন কাজ হচ্ছে না। কয়েকটি স্থানে জমি অধিগ্রহণ করার পরও ভবন নির্মাণের জন্য গণপূর্ত অধিদফতর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে শুধু চিঠি চালাচালি হচ্ছে। বর্তমানে রাজধানীতে জরাজীর্ণ ভাড়া ভবনে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। জেলা শহরে ডিসি অফিসে একটি কক্ষে চলছে এসব কাজ। এছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, রুট পারমিট, ট্যাক্স টোকেন, মালিকানা পরিবর্তন কার্যক্রমের রাজস্ব অনলাইনে নিলেও বাস্তবে দুর্নীতি বন্ধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এসব কার্যক্রমে প্রতিটি কার্যালয়ে গ্রাহকদের এখনও শিকার হতে হচ্ছে নানা হয়রানির। প্রতিবছর এই খাতে সরকার তিন হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করলেও বিআরটিএর কোন অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে না। গ্রাহকরা পাচ্ছেন না কাক্সিক্ষত সেবা। বিআরটিএর কর্মকর্তারাও প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ফাঁদে আটকে আছে এসব প্রকল্প। আরেকটি প্রকল্প ছিল ড্রাইভিং কম্পিটেনসি টেস্ট বোর্ড (ডিসিটিবি)। যার জন্য ২০ একর জমির ওপর রাজধানীর সব ধরনের গাড়ির যাচাই, ড্রাইভিং পরীক্ষা নেয়া হবে। এই প্রকল্প পরিকল্পনায় আটকে আছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে বিআরটিএ আধুনিকায়নের জন্য কয়েকটি প্রকল্প পরিকল্পণা নেয়া হয়। এর মধ্যে ছিল বিভাগীয় শহরে সব ধরনের সুবিধাসহ নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন, নিজস্ব ড্রাইভিং ইনস্টিটিউট চালু করা। এছাড়া জেলা শহরের অফিস হিসেবে ডিসি অফিসের বাইরে নিজস্ব ভবন স্থাপন করা। লোকবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আলাদা জনবল নিয়োগ প্রদান করা। বিভিন্ন ধরনের ফি অনলাইনের মাধ্যমে গ্রহণ। এর মধ্যে ফি আদায় অনলাইনে প্রদান কার্যক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলো এখনও কাগজে কলমে। তবে কার্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৫ সালে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে নতুন জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। এর মধ্যে ঢাকার উত্তরা দিয়াবাড়িতে ২৪ কাঠা ও পূর্বাচলে ২৩ কাঠা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ভবন নির্মাণের জন্য প্ল্যান চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরপরে কোন উদ্যোগ নেই। এসব প্রকল্প নিয়ে চলতি বছরে ৭টি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বাস্তবায়নের জন্য কমিটি সুপারিশ করেছে প্রতিবার। দিয়াবাড়ি, জোয়ারসাহারা, ইকুরিয়ায় ছোট্ট একটি ভবনে চলছে সব ধরনের কার্যক্রম। দিয়াবাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, শত শত গাড়ি আর মানুষের ভিড়। বিভিন্ন সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের দাঁড়ানোর জায়গা নেই। সেখানে চলছে ড্রাইভিং পরীক্ষা, ফিটনেস যাচাই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বসার জায়গা পর্যন্ত নেই এখানে। প্রতিটি কার্যালয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ প্রদানের জন্য জনবল, অবকাঠামো ও আধুনিক লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। মাঠ পর্যায়ে লাইসেন্স প্রত্যাশীদের পরীক্ষা নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় মানসম্পন্ন পরীক্ষা নেয়া যাচ্ছে না। এছাড়া আধুনিক ভেহিকেল ইন্সপেকশন সেন্টার না থাকায় ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে ফিটনেস সনদ দিচ্ছে বিআরটিএ। নেই পর্যাপ্ত রেকর্ড রুম। ফলে যানবাহন নিবন্ধ করা কাগজপত্র এসব তথ্য দ্বিতীয়বার আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই চিত্র সারাদেশের বিআরটিএ কার্যালয়ে। জানা গেছে, বিআরটিএ প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করে। গত অর্থবছরে ৩ হাজার ৭৬ কোটি টাকা, আগের বছর ২৬শ’ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। গ্রাহকদের কাছ থেকে এ অর্থ আদায় করা হলেও তাদের শিকার হতে হয় হয়রানির। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে দুর্নীতি কিছুটা ঠেকানো গেলেও পরীক্ষা পদ্ধতিতে রয়েছে নানা অনিয়ম। সরেজমিনে ঢাকার মিরপুর ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা খিলখেত জোয়ারসাহারায় নেয়া হয়। সেখানে রাজনৈতিক নেতাকর্মী পরিচয়ধারী দালাল ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে বেশ সখ্য দেখা যায়। কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ায় বিআরটিএ কার্যালয়ে ও উত্তরায় প্রতিদিন পেশাদার ও অপেশাদার চালকের লাইসেন্সের পরীক্ষা নেয়া হয়। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম কার্যালয়েও প্রতিদিন পরীক্ষা হয়। আর অন্য জেলা শহরে মাসে দুইবার বা তার বেশি পরীক্ষা নেয়া হয়। বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে ঢাকাসহ মহানগরগুলোতে দৈনিক প্রতিটি সার্কেলে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ চালক পরীক্ষায় অংশ নেন। জেলাগুলোতে অংশ নেন ২০০ থেকে ৩০০, জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের চালকদের কারও কারও নিজের বাহন থাকে। বাকি পরীক্ষার্থীই ভাড়া করা গাড়িতে পরীক্ষা দেন। প্রতিটি গাড়ি ভাড়া বাবদ জন প্রতি গড়ে ২০০ টাকা দিতে হয় পরীক্ষার্থীদের। এর বাইরে গাড়ির ফিটনেস যাচাইয়ের আধুনিক সরঞ্জাম না থাকায় অনুমান নির্ভর সনদ প্রদান করা হয়। ফলে পুরনো গাড়িতে রং করে নিয়ে এসেও পাওয়া যায় সনদ। এতে দুর্নীতির মাত্রা কোন ভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। এসব বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে গড়ে উঠেছে এলাকাভিত্তিক দালাল ও সিন্ডিকেট চক্র। জানতে চাইলে বিআরটিএর সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোঃ শহিদুল আযম বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যুগোপযোগী এই আইনটি খুবই ভাল। তবে এটি বাস্তবায়ন করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। মানুষের কাছ থেকে রাজস্ব নিয়ে তাদের উন্নত সেবা দিতে হবে। বিআরটিএতে নানা ধরনের সঙ্কট রয়েছে। এসব সঙ্কট দূর করতে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
×