ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষুদ্র ঋণটা স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা শুরু করেছিলেন ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ১৪ নভেম্বর ২০১৯

ক্ষুদ্র ঋণটা স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা শুরু করেছিলেন ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সমালোচনা করে বলেছেন, এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন হয় না, বরং দারিদ্র্য ‘লালন-পালন’ করা হয়। এক সময় আমরা দেখেছি ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে (কর্মসূচি) কেউ কেউ খুব বাহবা নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এক সময় আমরাও এটাকে সমর্থন দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম যে এর মাধ্যমে বুঝি মানুষ দরিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে পারবে। কিন্তু যখন আমরা বিষয়টা আরো গভীরভাবে দেখলাম, তাতে দেখলাম, আসলে এর মাধ্যমে দারিদ্র্য ঠিক বিমোচন হয় না। কেউ কেউ এর প্রবক্তা হিসেবে নাম-যশ কামালেও বাস্তবতা হচ্ছে যে দেশের জনগণ এর অতটা সুফল পায়নি। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) আয়োজিত ‘উন্নয়ন মেলা ২০১৯’ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ক্ষুদ্র ঋণটা স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা শুরু করেছিলেন। যদিও আমাদের দেশে কেউ কেউ ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা সেজে বিশ্বে ভাল নাম টামও করে ফেলেছেন। কিন্তু দেখা গেছে হয়তো নিজে যতটা নাম কামিয়েছেন দেশের মানুষ ততটা শুভফল পায়নি, এটা হলো বাস্তব। জাতির পিতা বিআরডিবি’র মাধ্যমে এই ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া শুরু করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষকে কিভাবে সমবায়ের মাধ্যম একত্রিত করে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করে তাদেরকে কিভাবে দারিদ্রসীমার থেকে বের করে আনবেন সেই পরিকল্পনাটাই জাতির পিতা নিয়েছিলেন। ২১ বছর পর দেশ পরিচালনায় এসেই আওয়ামী লীগ সরকার দারিদ্র্যকে দেশের প্রধান শক্র হিসেবে চিহ্নিত করে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধেই আমাদের লড়তে হবে এবং মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। সে লক্ষ্যে আমাদের স্বল্প মেয়াদি, দীর্ঘ মেয়াদি এবং আশু পরিকল্পনা প্রণয়ন করি। মূলত বিরোধী দলে থাকার সময়েই সরকারে গেলে দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ এবং তারই ধারবাহিকতায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ১০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর এমডিজি’র সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করে এবং ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা চলছে এবং এগিয়ে চলছে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ। এর সঙ্গে সঙ্গে ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চলছে এবং ২০২১ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কিভাবে গড়ে উঠবে সেই প্রেক্ষিত পরিকল্পনার খসড়া ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন। কাজেই সব সময় জনকল্যাণে কাজ করে যাওয়াই দলটির কাজ। যার প্রতিটি পদক্ষেপের লক্ষ্যই হচ্ছে, টেকসই উন্নয়ন এবং এসডিজি’র বাস্তবায়ন। স্বৈরশাসকদের প্রশাসনিক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে তিনি এটিকেও তাদের শাসনামলে বাংলাদেশের উন্নয়ন না হওয়ার একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যখন মিলিটারি ডিক্টেটররা ক্ষমতায় থাকে তখন সরকার থাকে দুর্বল। কেননা তাদের কোন ভিত্তি থাকে না। অর্থাৎ জনগণের কোন শক্তি থাকে না। এ সরকার ব্যবস্থা অপরের কাছে হাত পেতে চলে, নিজেদের সম্পদশালী করে গড়ে তোলে, ফলে দেশের মানুষ দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণায় দিনের পর দিন ভুগতেই থাকে। জনগণের দিকে তাকানোর কেউ থাকে না। জাতির পিতার এই পদাংক অনুসরণ করে গ্রামীণ জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাঁর সরকারের চালু করা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির বিভিন্ন কর্মসূচি, যেমন- বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ততা ভাতা চালু, গরিবদের মাঝে খাদ্য বিতরণ, কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে এবং স্বল্পমূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, বর্গাচাষিদের বিনা জামানতে এবং স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের মত কর্মসূচির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার নির্দেশ ছিল কৃষি ব্যাংক গ্রামে কৃষকদের কাছে চলে যাবে। হাটবারে গ্রামের হাটে বসে ঋণ প্রদান করবে এবং সেখান থেকেই আবার ঋণ সংগ্রহ করবে। এভাবেই আমরা কৃষকদেরকে সহযোগিতা করেছি।’ কৃষকদের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, কৃষি উপকরণ কার্ড প্রদান, বিএডিসিকে আরো উন্নত করে উন্নতমানের বীজ উৎপাদন ও বিতরণের কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। ‘ঘরে ফেরা’, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’, ‘আশ্রায়ণ’সহ বিভিন্ন দারিদ্র্যবান্ধব কর্মসূচির উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করার জন্য সরকার এ ধরনের বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন করছে। আমরা ভূমিহীনদের জমি দিয়েছি। যারা গৃহহারা তাদের ঘর করে দিয়েছি এবং দিচ্ছি। মানুষ যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সে ব্যবস্থা আমরা করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু একটি কথা বলতেন- ভিক্ষুক জাতির কোনো ইজ্জত থাকে না। আমরা ভিক্ষুক জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাই না। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচির ফলে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। এই হারকে ১৫/১৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। তাঁর সরকারের সময়ে দেশের অভূতপূর্ব আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বহির্বিশ্বে তাঁকে অনেক অনুসন্ধিৎসু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’বিভিন্ন দেশে গেলে আমাকে প্রশ্ন করা হয়- বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির ম্যাজিকটা কি? আমি তাদের বলি, আসলে কোনো ম্যাজিক নেই। দেশকে ভালোবাসা, দেশকে জানা এবং দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করা- এটাই হলো মূল ম্যাজিক।’ তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশকে এখন আর কেউ অবহেলার চোখে দেখে না। বাংলাদেশ এখন অনেকের কাছেই ‘উন্নয়নের বিস্ময়,’ উন্নয়নশীল এক দেশ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে পিকেএসএফ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে দেশে-বিদেশে একটি শীর্ষ স্থানীয় উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করেছে। বর্তমানে এক কোটি চল্লিশ লাখ দরিদ্র ও নি¤œআয়ের পরিবারকে পিকেএসএফ বিভিন্ন কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য পিকেএসএফ’র সংশ্লিষ্টদের কাজ করার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা এবং দরিদ্র মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও পিকেএসএফ’ তার কর্মকান্ড সম্প্রসারিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। দেশের শিল্পায়ন এবং জনগণের কর্মসংস্থানের জন্য সারাদেশে একশ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষি জমি যেন রক্ষা পায় এবং যত্রতত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠে। দুই বা তিন ফসলী জমির যেন ক্ষতি সাধন করতে না পারে এবং বিনিয়োগ আসে সেজন্যই এই অঞ্চল প্রতিষ্ঠা। তিনি বলেন, ভূমি ব্যবহারের জন্য সরকার নীতিমালা করে দিয়েছে। দুই বা তিন ফসলী জমি কেউ নষ্ট করতে পারবে না। কেউ এ ধরনের জমি নষ্ট করলে তারা সরকার প্রদত্ত সকল সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং পিকেএসএফ’র বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারীদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে সাত দিনব্যাপী এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন এবং পিকেএসএফ চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। পিকেএসএফ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মইনুদ্দিন আবদুল্লাহ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, উর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার এবং মিশন প্রধানগণসহ বিদেশি কূটনিতিকবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে কৃষকদের কল্যাণ ও দারিদ্র্য নিরসন এবং কৃষির উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সম্মাননা স্মারক মতিয়া চৌধুরীর হাতে তুলে দেন। পুরস্কার হিসেবে একটি সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং ৫০ হাজার টাকার চেক দেয়া হয়। গ্রামীণ এলাকা থেকে পিকেএসএফ’র সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, গবেষণা ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং সেবামুখী সংগঠনসহ ১৩০টি সংস্থার মোট ১৯০টিরও বেশি স্টল মেলায় স্থান পেয়েছে। মেলায় রয়েছে তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কৃষি, খাদ্য এবং প্রচলিত পণ্য। এছাড়া, ৭ দিনে ৫টি সেমিনারও অনুষ্ঠিত হবে মেলায়। মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলবে।
×