ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

লাইনচ্যুত, আগুন ॥ এবার ট্রেনে ভুল সিগন্যাল

প্রকাশিত: ১১:৫০, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

লাইনচ্যুত, আগুন ॥ এবার ট্রেনে ভুল সিগন্যাল

স্টাফ রিপোর্টার, সিরাজগঞ্জ ও ঈশ্বরদী ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় আবারও ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনায় ট্রেনের চালক, সহকারী চালকসহ মোট ২৬ জন আহত হয়েছেন। রংপুর এক্সপ্রেসের পাওয়ার কারের তেলের ট্যাংক ফেটে আগুন লেগে গেছে। সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। যদিও ট্রেন দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হয়নি। তবে অল্পের জন্য বড় ধরনের হতাহতের ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে ট্রেন যাত্রীরা। ট্রেন দুর্ঘটনায় মোট তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলেছে রেল কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনার পরপরই সেখানে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছেন। রাত আটটার পরে বিকল্প পথে ট্রেন চলাচল করছে। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। রেল বিভাগ জানায়, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। এ সময় ট্রেনটির তেলের ট্যাঙ্কারে আগুন ধরে যায়। ফায়ার সার্ভিস দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। দুর্ঘটনায় একটি এ?সি চেয়ার কোচ, দুটি পাওয়ার কার ও শোভন চেয়ার কোচ লাইনচ্যুত হয়। ট্রেনটি প?রিদর্শ?নের জন্য উর্ধতন কর্মকর্তারা সেখানে হাজির হন। দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনটি উদ্ধারের জন্য রিলিফ ট্রেন ঈশ্বর?দী থেকে রওনা হয়েছে। জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ-ঈশ্বরদী রেলপথে ট্রেনটি ঢাকা থেকে রংপুর যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আকস্মিক দুর্ঘটনার কারণে কমপক্ষে ২০ জন যাত্রী আহত হলেও প্রাণহানির কোন ঘটনা ঘটেনি। স্টেশনের সহকারী মাস্টার মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, লাইনম্যানের ক্লিয়ারেন্স পেয়ে ট্রেনটি উল্লাপাড়া থেকে ঈশ্বরদীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। উল্লাপাড়া স্টেশনের মূল প্লাটফর্ম পার হতেই হঠাৎ ট্রেনটির ইঞ্জিন ওপরের দিকে উঠে যায়। এ সময় ইঞ্জিন ছাড়াও সাতটি বগি একে একে লাইনচ্যুত হয়। দুর্ঘটনার জন্য লাইনম্যানের ভুল ক্লিয়ারেন্স ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজ চালায় পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, স্বাস্থ্যকর্মীসহ স্থানীয় লোকজন। উল্লাপাড়া ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার নাজির হোসেন ও উল্লাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের কর্মী গোলাম কিবরিয়া জানান, দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। তাদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ট্রেনের চালকসহ ছয়জন আহত হয়েছেন। পশ্চিমাঞ্চল রেল বিভাগ পাকশীর বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মিজানুর রহমান জানান, ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পাকশী থেকে রিলিফ ট্রেন উল্লাপাড়া পাঠানো হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে পাকশীর বিভাগীয় ট্রাফিক অফিসার (ডিটিও) আবদুল্লাহ আল মামুনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে লাইনম্যানের কোন গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। খবর পেয়ে দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান আরিফ ও উল্লাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফাসহ রেলওয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা। এবারও সিগন্যালের ভুলে রংপুর এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি। ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে ট্রেনের লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকো মাস্টারসহ ছয়জন আহত হয়েছেন। তাদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুজ্জামান বলেন, উল্লাপাড়া স্টেশনে পয়েন্টিং সিগন্যালের ভুলের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ছয়জন আহত হয়েছেন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকা থেকে রংপুরগামী ৭৭১ রংপুর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে অপর চারটি বগিকে ধাক্কা দেয়। এতে ট্রেনের চারটি বগিতে আগুন ধরে যায়। ফলে ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সিরাজগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হামিম বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আহত কয়েকজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ট্রেন দুর্ঘটনায় মোট তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পক্ষ থেকে বিভাগীয় ও জোনাল পর্যায়ে দুটি এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনার তদন্তে কমিটিগুলো গঠন করা হয়। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের নতুন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মিহির কান্তি গুহ জানান, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট শহিদুল ইসলামকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল রেল বিভাগ পাকশীর বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) মিজানুর রহমান জানান, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে পাকশীর বিভাগীয় ট্রাফিক অফিসার (ডিটিও) আবদুল্লাহ আল মামুনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। এদিকে দুর্ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ। তিনি বলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ফিরোজ মাহমুদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত সোমবার রাত তিনটায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মন্দবাগ রেল ক্রসিংয়ে উদয়ন এক্সপ্রেস ও আন্তঃনগর তূর্ণা নিশীথার মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে। আখাউড়া রেলওয়ে পুলিশের ওসি শ্যামল কান্তি দাশ জানান, ঘটনাস্থলেই ১০ জনের মৃত্যু হয়। আর হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যায় আরও ছয় জন। আহত হয় অন্তত অর্ধশতাধিক। তাদের কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। মন্দবাগ রেলস্টেশনের মাস্টার জাকির হোসেন জানান, দুর্ঘটনার সময় তূর্ণা নিশীথার গতি ছিল ঘণ্টায় কমপক্ষে ৮০ কিলোমিটার। রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহান জানান, প্রাথমিক তদন্তে তূর্ণা নিশীথার চালক সিগন্যাল না মানায় দুর্ঘটনাটি ঘটে বলে প্রমাণ মিলেছে। ঘটনার সময় সিলেট থেকে ছেড়ে আসে উদয়ন এক্সপ্রেস। সেটি যাচ্ছিল চট্টগ্রামে। আর তূর্ণা নিশীথা চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে এসে যাচ্ছিল ঢাকায়। মন্দবাগে দুই ট্রেনের ক্রসিংয়ের সময় সিগন্যাল পেয়ে উদয়ন এক্সপ্রেস মেইন লাইন থেকে লুপ লাইনে অর্থাৎ সাইট দেয়ার জন্য পাশে থাকা আরেকটি রেল লাইনে প্রবেশ করছিল। ট্রেনের নয়টি বগি লুপ লাইনে চলে গিয়েছিল। দশম বগিটিও পাশের লাইনে যাচ্ছিল। সিগন্যাল না মানায় তূর্ণা ট্রনটি উদয়ন ট্রেনের পেছনের দিকে থাকা দশ নম্বর বগিটিকে মারাত্মকভাবে ধাক্কা দেয়। স্বাভাবিক কারণেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে দুই ট্রেনের বগিগুলো লাইনচ্যুত হয়ে যায়। আর তখনই হতাহতের ঘটনাটি ঘটে। আর প্রচন্ড গতি থাকার কারণে তুর্ণা নিশীথা ট্রেনের একাধিক বগি উদয়ন এক্সপ্রেসের বগির উপরে ওঠে যায়। ইস্পাতের চাকাগুলো ট্রেনের বগির লোহার মোটা শক্ত পাত কেঁটে উপরে ওঠে যায়। এ সময় ট্রেনের ভেতরে থাকা যাত্রীরা ট্রেনের চাকায় কাঁটা পড়ে। দুইটি ট্রেনের অনেক বগি রীতিমতো দুমড়ে মুচড়ে যায়। একটি বগি ও ট্রেনের চাকা আরেকটি ট্রেনের বগির ভেতরে কেঁটে ঢুকে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ, রেল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়রা উদ্ধার কাজ শুরু করে।
×