ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৯ ॥ সাহিত্যাঙ্গন রাঙালেন যারা

প্রকাশিত: ১৩:১০, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৯ ॥ সাহিত্যাঙ্গন রাঙালেন যারা

শুধুমাত্র সাহিত্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমাজ-সংস্কারের বহুমাত্রিকতায় মেলেছে ডানা। যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে। নাম ছিল হে ফেস্টিভ্যাল। সাহিত্যের আন্তর্জাতিক এ মহাযজ্ঞ ২০১৫ সাল থেকে রূপ নিয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট রূপে। সাহিত্যের এ মঞ্চে শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, রাজনীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে চর্চিত হয়েছে ভাষার নানা রূপ। নানা আয়োজনে শেষ হলো সাহিত্যের আন্তর্জাতিক মহাযজ্ঞ ‘ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৯’। তিন দিনব্যাপী এবারের উৎসবে পাঁচ মহাদেশের ১৮ দেশ থেকে প্রায় তিন শ’ লেখক-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদ অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা মনিকা আলী ছাড়াও এবারের ঢাকা লিট ফেস্টের নবম আসর আলোকিত করেছেন ভারতীয় রাজনীতিক শশী থারুর, ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল, দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক জহর সেনমজুমদার, মৃদুল দাশগুপ্তসহ আরও অনেকে। সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আসাদ চৌধুরী, রুবী রহমান, সেলিনা হোসেন শাহীন আখতার প্রমুখ। এবারের উৎসবে অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘হাসিনা : আ ডটারস টেল’র বিশেষ প্রদর্শনী ও আলোচনা। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের আগাম আয়োজন হিসেবে ছিল আলোচনা ও তাকে নিবেদিত কবিতা পাঠের আসর। ৭ থেকে ৯ নবেম্বর প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাহিত্যপ্রেমীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। ৭ নবেম্বর বৃহস্পতিবার সকালে তিন দিনব্যাপী লিট ফেস্টের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। উদ্বোধনী আয়োজনের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের শিল্পসৃষ্টি ‘পঞ্চভূত’ নিয়ে নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে সাধনা নৃত্যগোষ্ঠী। উদ্বোধনী বক্তব্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে কে এম খালিদ বলেন, নয় বছর আগে যে ‘হে উৎসব’ বিশ্বসাহিত্য থেকে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার আয়োজন ছিল, আজ ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’ হিসেবে সেই উৎসবই বাংলা সাহিত্য দ্বারা বিশ্বসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হওয়া ঢাকা লিট ফেস্টের প্রথম দিনে ‘গল্প: প্রতিবন্ধকতা নাকি আশ্রয়’ অধিবেশনে কথা বলেন-বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা মনিকা আলী, ব্রাজিলের লেখিক মারিয়া ফিলোমেনা বইসো লেপেসকি, ফিনল্যান্ডের মিন্না লিন্ডগ্রেন ও ব্রাজিলিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা ইয়ারা রড্রিগেজ। সঞ্চালক হিসেবে ছিলেন ভারতীয় লেখিকা সুমনা রায়। একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত এ অধিবেশনের শুরুতেই মডারেটর সুমনা রায় প্রশ্ন ছুড়ে দেন লেখকদের কাছে, তাহলে- গল্প কী? এর জবাবে মনিকা আলী বলেন, গল্প হলো ছোট ছোট ঘটনাকে আবেগ বা কাব্যিকতার ছোঁয়ায় বড় একটা সংগঠনে রূপান্তর করা। মিন্না লিন্ডগ্রেন বলেন, লেখক হিসেবে সামাজিক জীবনের গল্পগুলো তুলে ধরা আমার কাজ। আমি নিজে বয়স্ক মানুষের গল্প লিখতে পছন্দ করি। আমার সাম্প্রতিক বইয়ে বয়স্কদের ভালবাসা ও অপ্রাপ্তির বিষয় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আমার কাছে গল্প হলো সমাজের কথা বলা। মারিয়া ফিলোমেনা বইমো লেপেসকি বলেন, সবার জন্যই কল্পনাশক্তি খুব জরুরী। আমরা বই পড়লে সুন্দর করে কল্পনা করতে শিখি। সে জন্য আমার কাছে গল্প মানে মনোরঞ্জনের মাধ্যম। অন্যদিকে ইয়ারা রড্রিগেজ বলেন, যেহেতু আমি নারীবাদী লেখিকা, সে ক্ষেত্রে আমার কাছে গল্প হলো, সমাজে নারীদের প্রতিচ্ছবিকে বইয়ের পাতায় ফুটিয়ে তোলা। নারীদের অধিকার, সুবিধা ও অসুবিধাগুলো গল্প দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেই আমি সাহিত্য রচনা করি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কবিতা নিয়ে দারুণ এক অধিবেশন হয় প্রথম দিন। ‘কবিতা আড্ডা : এপার ওপার’ শীর্ষক এ সেশনে অংশ নেন বাংলাদেশের কবি রুবি রহমান, কামাল চৌধুরী ও পশ্চিমবঙ্গের মৃদুল দাশগুপ্ত, জহর সেন মজুমদার ও গৌতম গুহ রায়। আলোচনার শুরুতেই কবিতা ও তার রকমফের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কামাল চৌধুরী বলেন, কবিতার দুটি ধারা-একটি এলিটিস্ট আরেকটি পিপলস। এলিটিস্ট কবিতা এমন একপর্যায়ে পৌঁছায়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও উচ্চ শ্রেণীর কিছু পাঠক পড়ে থাকে। আর পিপলস ধারার কবিতা প্রায় সবার জন্যই। পরে কামাল চৌধুরীর দুই ধারার কবিতার সঙ্গে আরও একটি ধারা যোগ করে কবি জহর সেন মজুমদার বলেন, এসব কবিতার বাইরে আরও এক ধরনের কবিতা হয়। আর তা হলো নীরব ধারার কবিতা। এ কবিরা নীরবে, নিভৃতে কবিতা লিখে চলেন। জীবনানন্দ দাশও এ ধারার কবি। কিন্তু তার কবিতা নিজ গুণেই এলিট বা পিপল সব শ্রেণীর কাছেই জনপ্রিয়। এরপর দুই বাংলার কাঁটাতারের বেড়াকে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের জন্য একটি বেড়া উল্লেখ করে কবি গৌতম গুহ রায় বলেন, বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করেছে দুই বাংলাই। কাঁটাতার, আমলাতন্ত্র, খণ্ডীকরণসহ বিভিন্ন বিষয় দুই বাংলার পাঠককে বাংলা সাহিত্যের মূল ধারা থেকে আলাদা করেছে। ফলে অনেকেই দুই বাংলার সাহিত্য সম্পর্কে সেভাবে জানে না। এমনকি মফস্বলেও অনেক ভাল ভাল লিটলম্যাগ হচ্ছে, কিন্তু অনেকেই তা জানতে পারছেন না। ‘আমি জানতাম না, আমি ভাঙ্গা বাংলায় জন্মেছি। পরে যখন ধীরে ধীরে দেশের বাড়ি, দেশের পুকুর, দেশের মানুষের কথা জানলাম, আমার ঠাকুরদাদা ও ঠাকুরমায়ের কাছে তাদের জন্মস্থান ও দেশের বাড়ি সম্পর্কে জানলাম, তখন বুঝতে পারি, আমাদের যে আত্মার বন্ধন ছিল, তা অনেক আগেই ছিন্ন হয়ে গেছে’-‘ভাঙ্গা বাংলা : ত্রস্ত নিলীমায়’ শীর্ষক সেশনে এমনটাই বললেন ভারতীয় ঔপন্যাসিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। এই সেশনে আরও অংশ নেন বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ, গল্পকার, কবি ও গবেষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন ৩০ লাখ শহীদ এবং মা বোনেদের সম্ভ্রমহানি আমাদের জন্য অবশ্যই অনেক বড় ক্ষতি। তবে একটি নব্য স্বাধীন দেশের জন্য বড় সমস্যা ছিল দেশের অবকাঠামো এবং সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়া। আর সেই ভেঙ্গে পড়া জায়গা থেকে একটি দেশকে টেনে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-ঢাকা লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে ‘শেখ মুজিব : আইকন অব পোস্ট-কলোনিয়াল লিবারেশন’ শীর্ষক আলোচনায় এমনটাই বলেন বিশিষ্ট গবেষক, কলাম লেখক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। এ সময় আলোচনায় আরও অংশ নেন- ভারতীয় কংগ্রেস নেতা শশী থারুর এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল চৌধুরী। শশী থারুর বলেন, বঙ্গবন্ধু কখনও কারও সঙ্গে আপস করেননি। সবসময় বাংলাকে ভালবেসেছেন। একইসঙ্গে তিনি নেতা হিসেবে সবাইকে উৎসাহিত করতে পারতেন। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সে সময়ে উর্দুর জন্য যখন সবদিকে একটি আয়োজনের মতো ব্যাপার, তখন একটি মিটিংয়ে অংশ নেন বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী। সেই সময় ইন্দিরা গান্ধী ইংরেজীতে বক্তব্য দিলেও বঙ্গবন্ধু উঠেই বললেন, অন্য ভাষা নয়, শুধু বাংলা, বাংলা এবং বাংলা। একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে ‘ইনইকুয়ালিটি : অল দ্য রেজ’ শীর্ষক অধিবেশনে অংশ নেন ব্রাজিলের লেখক মারিয়া ফিলোমেনা, সিঙ্গাপুরের সাংবাদিক ও লেখক জেমস ক্র্যাবট্রি, ব্রিটিশ লেখক কেনান মালিক এবং নেদারল্যান্ডসের লেখক আরনেস ভেনডার কয়েস্ট। এটি সঞ্চালনা করেন ভারতীয় সাংবাদিক প্রিয়াঙ্কা দুবে। ব্রাজিলের লেখক মারিয়া ফিলোমেনা বলেন, নব্বই দশকের শুরুতে ব্রাজিলে অসমতা শুরু হয়। ঐতিহাসিক প্যারাগুয়ের যুদ্ধে সৈনিকের বেশে দাসদের ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই দাসরা দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন। কারাগার থেকে বের হয়ে আসার পর তাদের জন্য কোন সমাজ ছিল না। যে রাজনীতির কারণে তাদের কারাগারে যেতে হয়েছিল, সেই রাজনীতিবিদরা তাদের গ্রহণ করেননি। সিঙ্গাপুরের সাংবাদিক ও লেখক জেমস ক্র্যাবট্রি বলেন, বছর কয়েক আগে আমি ‘দ্য বিলিয়নিয়ার রাজ’ বইয়ের জন্য মুকেশ আম্বানির সাক্ষাৎকার নেই। মুম্বাই বিমানবন্দরে নামার পর আমার গাড়িচালক আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়ির কাছে গিয়ে গাড়িচালক উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, ‘এটিই সেই বাড়ি।’ একজন বিত্তবানের বাড়ির মূল্য দুই হাজার কোটি টাকা। বাড়ি বললেও ভুল হবে, সেটা একটি কলোনি। পশ্চিমা দেশগুলোতে কখনো বিত্তশালীর এ রকম বাড়ি দেখা যায় না। ব্রিটিশ লেখক কেনান মালিক বলেন, অসমতা কোন সমাজই মেনে নিতে পারে না। সমাজে অসমতা বেড়ে গেলে, তা আর সমাজের মতো আচরণ করে না। নেদারল্যান্ডসের লেখক আরনেস ভেনডার কয়েস্ট বলেন, যে সমাজ অসমতা দূরীকরণের আলো জ্বালায়, সেটি ভাল সমাজ। সব সমাজের এ রকম গুণ থাকে না। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক নাদিম জামান বলেছেন, প্রতিটি সত্য ঘটনায় প্রচুর চরিত্র থাকে, যার কোনটি প্রত্যক্ষ, কোনটি পরোক্ষ। প্রতিটি চরিত্রের আলাদা গল্প থাকে। এসব গল্প সুন্দরভাবে সাজাতে পারলে একটি উপন্যাস তৈরি হয়। ঢাকা লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘ইন দ্য টাইম অব দ্য আদার্স’ শিরোনামের অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন। অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন রিফাত মুনিম। আলাপনের শুরুতেই জানানো হয়, নাদিম জামানের লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ইন দ্য টাইম অব দ্য আদার্স’, যার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। উপন্যাসের মূল চরিত্র ইমতিয়াজের ১৯৭১ সালের মার্চে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা হয় এ অধিবেশনে। এ বিষয়ে নাদিম জামান বলেন, সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণায় কিছু চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধের বাইরের মানুষগুলো যুদ্ধটি কীভাবে দেখেছেন, সেটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি, সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবন কেমন ছিল, সেসব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ উপন্যাসে। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর নির্মিত ডকু ড্রামা ‘হাসিনা : আ ডটার্স টেল’ প্রদর্শিত হয়। এবার লিট ফেস্টে দেশের বেশ কিছু অভিজাত প্রকাশনী তাদের বইয়ের সম্ভার নিয়ে স্টল সাজিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জার্নিম্যান, ইউপিএল, অবসর, প্রতীক প্রকাশনী, ক্রিয়েটিভ ঢাকা ইত্যাদি। ক্রিয়েটিভ ঢাকা প্রকাশনা জগতে নতুন হলেও নিজস্বতা এবং শৈল্পিক উৎকর্ষ দিয়ে রুচিশীল ক্রেতা-পাঠকের মনোযোগ কেড়েছে। লিট ফেস্ট উপলক্ষে কবি মুম রহমান এবং কবি মিলু শামসের দুটি বই প্রকাশ করেছে তারা। শেষ দিনের অধিবেশন শুরু হয় ভজনের সুরে। নজরুল মঞ্চে নাজিয়া জেবীনের ‘সাগর তীরে’ নামের শিশুতোষ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। সকালে বাংলা একাডেমির কসমিক টেন্টে ‘পাওয়ার অব পিকচার’ সেশনে উপস্থিত ছিলেন গ্রাফিক নভেলিস্ট ও কার্টুনিস্ট ফাহিম আঞ্জুম এবং চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা আবরার আখতার। সঞ্চালক ছিলেন কার্টুনিস্ট সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়। স্থিরচিত্র ও সচলচিত্রের শক্তি ও সমাজে এর প্রভাব নিয়ে সেশনের আলোচনা শুরু হয়। আলোচকরা জানান, সচল হোক কিংবা স্থির, সেটা মুহূর্তেই প্রকাশ করতে পারে লাখো ভাবনা। সঞ্চালক তন্ময় নির্মাতা জীবনের শুরুর কথা জানতে চাইলে আবরার বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই গল্প নিয়ে কাজ করতাম। আশপাশের মানুষদের নিজের গল্প বলতাম। আমার মধ্যে যে ছবি বা গল্পের চরিত্রগুলো মাথায় ঘুরত তা কল্পনার মাধ্যমে আমি অনেক দূরে নিয়ে যেতাম। একই প্রশ্ন ফাহিম আঞ্জুমকে করা হলে তিনি বলেন, আমার কার্টুনিস্ট হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা আমাকে অনুপ্রেরণা দেয় তা হলো সুপার হিরো কমিক। আমি ছোটবেলা থেকেই কমিকে ডুবে থাকতাম। নিজে নিজে গল্প বানাতাম। গল্প বলার সে ইচ্ছে থেকেই আমার কার্টুনিস্ট হয়ে যাওয়া। সঞ্চালক ও কার্টুনিস্ট তন্ময় বলেন, আমরা আমাদের কাজের ক্ষেত্রে স্বাধীন। এটাই আমাদের অনেক বড় শক্তি। বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ অডিটোরিয়ামে পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক জেফরি গেটেলম্যান তার বই ‘লাভ, আফ্রিকা : আ মেমোয়ার অব রোমান্স, ওয়ার এ্যান্ড সারভাইভাল’ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। ‘লাভ, আফ্রিকা’ শীর্ষক সেশনটি সঞ্চালনা করেন জাফর সোবহান। জেফরি গেটেলম্যান জানান, আফ্রিকা থাকাকালীন তার দশ বছরের অভিজ্ঞতার নির্যাস এই বই। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের পূর্ব আফ্রিকা বিষয়ক ব্যুরো-প্রধান ছিলেন। কলেজে থাকার সময়ও তিনি কখনও সাংবাদিক হবেন এমনটা ভাবেননি। হঠাৎ করে আফ্রিকায় চলে যাবেন। চাকরির জন্য তার কলেজ জীবনের প্রেমিকার সঙ্গে বার বার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তবে পরে সেই প্রেমিকাকেই বিয়ে করে তিনি আফ্রিকায় পাড়ি জমান। তিনি বলেন, আফ্রিকায় পরিবারসহ থাকাটা সবসময় নিরাপদ ছিল না। সোমালিয়ায় যে কোন মুহূর্তে অপহরণ হওয়ার ভয় ছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী এবং আমি আমাদের পুরো সময়টাতে নিউইয়র্কের নাগরিক জীবনের বাইরে প্রাকৃতিক জীবন উপভোগ করেছি, মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের জীবন বোঝার চেষ্টা করেছি। চাইলেই শুধু পত্রিকায় স্টোরি করে ১০ বছর পার করে দিতে পারতাম, কিন্তু এই ১০ বছর সময়কে উপভোগ করেছি, আফ্রিকাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। দর্শকসারি থেকে প্রশ্ন আসে কাশ্মীর ইস্যুতে তার অবস্থান নিয়ে। কেননা তিনি বর্তমানে দিল্লীতে নিউইয়র্ক টাইমসের ব্যুরো-প্রধান হিসেবে কর্মরত। গেটেলম্যান বলেন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ভারত একটি শক্তিশালী অবস্থানে আছে। অপরদিকে পাকিস্তান পারমাণবিক দিকে শক্তিশালী হলেও অর্থনীতিতে দুর্বল। রাজনীতিতেও শক্ত অবস্থানে নেই। এ কারণে তারা কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধের ঘোষণা দিলেও বেশি দূর যেতে পারবে না। দুপুরে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে ‘ইন্ডিয়া এগেইনস্ট ইটসেলফ’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ভারতের কংগ্রেস নেতা শশী থারুর। তিনি বলেন, কাশ্মীর ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদি অনেকটা কার্যকর উপায়ের কথা বলেছিলেন কয়েক মাস আগে। তা হচ্ছে গুলি না করে, গালি না দিয়ে, বুকে টেনে নিয়ে কাশ্মীরীদের সমস্যার সমাধান হবে। নিজের এই প্রেসক্রিপশন তিনি হয়তো ভুলে গেছেন বলে আমার মনে হয়। আমি আশা করি আগামী সপ্তাহে সংসদে তাকে সেটা আমি মনে করিয়ে দেব। কাশ্মীরের ভবিষ্যত কী? দর্শক সারি থেকে ওঠা এমন প্রশ্নের জবাবে কংগ্রেসের এই নেতা বলেন, আমি জানি না আপনারা কাশ্মীর ইস্যুতে লোকসভায় আমার ভাষণ শুনেছেন কিনা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এটা কোন পন্থা হতে পারে না। এ রকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ঘরবন্দী করে রাখা গণতন্ত্রে এক ধরনের অগ্রহণযোগ্য চর্চা। কাশ্মীর ইস্যুতে এখন অনেক বিষয় আছে। সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। কাশ্মীরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয় গবর্নরকে। এর মানে তিনি যেমনটা চাইছেন তেমনটাই সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছে, যা কিনা সংসদে আলোচনা করে নেয়া উচিত। আমি জানি না এই বিষয়ে কেউ সুপ্রিমকোর্টের শরণাপন্ন হবেন কিনা, যদিও প্রচুর মামলা ঝুলে আছে, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে তারা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন। এভাবে গণতন্ত্র চলতে পারে না। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান একটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে শশী থারুর বলেন, কাশ্মীরের বিষয় অনেক পুরনো, অপ্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে, যা মানবতা ও গণতন্ত্রের বিরোধী। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মতো সমস্যা এখানে হলে তার একটা রাজনৈতিক সমাধান বের করা যেত। কিন্তু কাশ্মীরে পাকিস্তান অস্ত্র সরবরাহ দিচ্ছে অভিযোগ করে শশী থারুর বলেন, আমাদের প্রায় একই ধরনের সমস্যা পাঞ্জাবে শিখ সম্প্রদায় নিয়ে আছে। কিন্তু এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না, পাকিস্তানও সেখানে ইন্ধন দিচ্ছে। কিছুসংখ্যক শিখ সেখানে অর্থ ঢালছে। সেখানকার আন্দোলন হয়তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, কিন্তু কাশ্মীরে সেটা সহজ নয়। সুতরাং চ্যালেঞ্জ হলোÑ আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব? ভারতের রাজনীতির ন্যারেটিভ পাল্টে গেছেÑ এমন মন্তব্য করে ভারতীয় এই রাজনীতিক আরও বলেন, ড. মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বলে গেছেন, আশা করি ইতিহাস আমার প্রতি সদয় আচরণ করবে। এটি ব্যাপকভাবে তখন মিডিয়ায় এসেছিল, এখন তার কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। শুধু মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক লেখাটি পড়লেই বিষয়টি বোঝা যাবে। মানুষ যখন তাকে বিভিন্নভাবে হেয় করেছিল, তখন বোঝা যাচ্ছে যে ন্যারেটিভ পাল্টে গেছে। বাবরি মসজিদের রায়ের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চান না জানিয়ে তিনি বলেন, আমি আশা করি মানুষ এ নিয়ে আর প্রশ্ন না তুলে এটিকে একটি সমাপ্তি হিসেবেই দেখবে এবং উত্তরণের পথে হাঁটবে। কারণ, আমার কাছে মনে হয় আমরা সামাজিকভাবে অনেক ভুগেছি এ নিয়ে। আমাদের জন্য এরচেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। ‘রিভাইভিং দ্য আর্ট অব স্টোরিটেলিং’ শীর্ষক শিশুতোষ আলোচনায় মাদিহা মোরশেদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ চিত্রকর ও অ্যানিমেটর কার্টিস জবলিং, চাইল্ড স্পেশালিস্ট ফ্রান হুরলি, নিউরোসায়েন্টিস্ট নাইলা জামান খান এবং সাজিয়া জামান। এ সময় কার্টিস জবলিং বলেন, একমাত্র পরিবারই শিশুকে গল্প শুনিয়ে আনন্দময় শিক্ষা দিতে পারে যা তার সঠিক মানসিক বুদ্ধিবৃত্তিতে সাহায্য করবে। শিশুদের গৎবাঁধা বই হাতে ধরিয়ে না দিয়ে, খেলাচ্ছলে কল্পনানির্ভর শিক্ষা দেয়া উচিত। একমত হয়ে ফ্রান হুরলি বলেন, প্রযুক্তি নয়, পরিবার শিশুশিক্ষার প্রধান মাধ্যম। তিনটি সেশেনেই শিশুদের উপস্থিতি ছিল সাড়া জাগানোর মতো। ‘ইমাজিন’ শীর্ষক সেশনে মালয়েশিয়ান সাংবাদিক শরদ কুতটানের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক, হিপহপ আর্টিস্ট ও কবি জোহাব জি খান। কবিতায় হাতেখড়ি তার মায়ের কাছে। তিনি বলেন, কোন কিছু কাজই ছোট নয়। স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটলে সাফল্য আসবেই। দর্শক সারি থেকে একজন জানতে চান জোহাবের এই সাফল্যমণ্ডিত জীবনের রহস্য। উত্তরে তিনি বলেন, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায় অর্থাৎ সুশৃঙ্খল জীবনই সাফল্য বয়ে আনতে পারে। সেশনের শেষে তিনি তার ‘ইমাজিন’ কবিতা হিপহপ স্টাইলে আবৃত্তি করে দর্শক মুগ্ধ করেন। চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় বলেছেন, শুধু অসাম্প্রদায়িক নয়, ভাষা নিরপেক্ষ জাতি গঠন প্রয়োজন। শেষ দিন ‘সেলিব্রেটিং দ্য ইয়ার অব ইনডিজেনাস ল্যাঙ্গুয়েজেস’ শীর্ষক সেশনে আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ কথা বলেন। একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার রুমে অনুষ্ঠিত সেশনটি সঞ্চালনা করেন গবেষক মুক্তশ্রী চাকমা। ‘অন দ্য রোড : ট্রাভেল রাইটিং উইথ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল’ শীর্ষক সেশনে আলোচনায় অংশ নেন স্কটিশ ইতিহাসবিদ ও সমালোচক উইলিয়াম ড্যালরিম্পল। গত শতকের নব্বইয়ের দশক এবং একুশ শতকের গোড়ার দিকে প্রায় ২৫ বছর ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের পর এখাকার মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের বৈচিত্র্য তাকে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। এই উপলব্ধির কথা জানিয়ে স্কটিশ ইতিহাসবিদ ও সমালোচক উইলিয়াম ড্যালরিম্পল বললেন, এই উপমহাদেশে যত বেশি সময় কাটান তিনি, তত বেশি রহস্যময়তা ঘিরে ধরে তাকে; অন্বেষণের খিদে বাড়তে থাকে। লেখক অন্তরা গাঙ্গুলীর সঞ্চালনায় ড্যালরিম্পল তার বহুল পঠিত ‘সিটি অব জিনস’, ‘নাইন লিভস : ইন সার্চ অব দ্য স্যাক্রেড ইন মডার্ন ইন্ডিয়া’ এবং ‘দ্য এজ অব কালি : ট্রাভেলস এ্যান্ড এনকাউন্টারস ইন ইন্ডিয়া’ থেকে নির্বাচিত অংশ পড়ে শোনান। পার্সি-উর্দু সংস্কৃতির মানুষের যাপিত জীবন, মধ্যপ্রাচ্যে অতীত আভিজাত্যে অভ্যস্ত মানুষগুলোর বর্তমান ভোগান্তি, অষ্টাদশ শতকে ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মানুষের ধর্মীয় আচার ও জীবনযাপনের ধরন নিয়েও কথা বললেন এই ইতিহাসবিদ। ‘সাহিত্য ও সাংবাদিকতা : দ্বৈতসত্তার মিল-অমিল’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সাংবাদিক মৃদুল দাশগুপ্ত, কবি সাজ্জাদ শরীফ, ও কবি মুস্তাফিজ শফি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন শাহনাজ মুন্নী। আলোচনায় মৃদুল দাশগুপ্ত বলেন, আমি কবিতাকে কিছুতেই জড়াই না সাংবাদিকতার সঙ্গে। আমি মাথা দিয়ে সাংবাদিকতা করি এবং বুক ও মাথা দিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করি। আমি মনে করি, পশ্চিমবঙ্গে যারা লেখালেখি করে তাদের একবার হলেও বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়া উচিত। আর বাংলাদেশের যারা লেখালেখি করে তাদেরও পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোতে ঘুরে আসা উচিত। বাংলাদেশ কবিতার আবাদক্ষেত্র। মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তকরবী’ নাটকে কাজ করতে গিয়ে তাদের প্রথম পরিচয়। সেই পরিচয় প্রণয়ে গড়াতে সময় নেয়নি। এরপর বিয়ে। তবে বিয়ের পরও নাটকের প্রতি, মঞ্চের প্রতি ভালবাসা এতটুকু ম্লান হয়নি তাদের, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সে কারণেই বুঝি নাটক ও সংসার দুই জীবনেই অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন এই দম্পতি। তারা হলেন রামেন্দু মজুমদার ও ফেরসৌসী মজুমদার। সফল এই জুটি তাদের গল্প শোনালেন ঢাকা লিট ফেস্টে। একাডেমির আবুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘মঞ্চের জুটি, জীবনের জুটি’ শীর্ষক সেশনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের থিয়েটার জগতের এই দুই দিকপাল। একাডেমির আবুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ সেশনের মধ্যদিয়ে শেষ হয় ঢাকা লিট ফেস্টের এ আয়োজন। এতে আলোচনায় অংশ নেন ভারতের লেখক মনিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়। যার ডাক নাম শঙ্কর। সঙ্গে ছিলেন লেখক ইমদাদুল হক মিলন। সব শেষে ছিল সঙ্গীতশিল্পী চন্দনা মজুমদারের লোকগান পরিবেশনা।
×