ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জন্ম নিয়েছি ধূলিতে...

প্রকাশিত: ১৩:২৩, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

জন্ম নিয়েছি ধূলিতে...

বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়, অধিকার এবং অবস্থান নিয়ে আলোচনা এখনও যথেষ্ট অন্ধকারেই রয়েছে। তবে অন্য বদলও আসছে যাদের এখন তৃতীয় লিঙ্গ বলা হচ্ছে তাঁরা আড়াল থেকে বৃহত্তর সমাজের কাছে নাগরিক হিসেবে মানুষ হিসেবে তাদের দাবি জানাচ্ছে। তাই তো তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে ভাবনা বলেনÑ ‘আমরা কোন দোকানে গেলে দোকানি খুব কুৎসিত দৃষ্টিতে তাকায় এবং খারাপ উক্তি করে।’ আর পিংকি বলেনÑ ‘আমার মাকে যখন দেখতে যাই তখন পাড়ার সব বয়সী লোক ভিড় করে আমাকে একনজর দেখার জন্য ফলে ভাই ও ভাবিরা আমাকে যেতে বাধা দেয়, কিন্তু মনকে বোঝাতে পারি না। পরিবার যদি খাওয়া-পরার দায়িত্ব নিত তাহলে আমাকে দলে ভিড়তে হতো না। মা থাকে ভাইদের সঙ্গে আমার দায়িত্ব নেবে কে?’ এভাবে পিংকি, ভাবনা বঞ্চনা ও অসহায়ত্বের কথা বললেন। এ শুধু ভাবনা, পিংকির জীবন চিত্র নয়, সমগ্র দেশে বসবাসরত হিজড়া সম্প্রদায়ের অভিন্ন চিত্র। তাদের অধিকাংশই অভাবের তাড়নায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে তাদের গুরুমা মর্জিনা নিন্মি জানান- ‘আমাদের প্রতিবন্ধী হিসেবেও পরিবারে স্থান দেয় না। আর পরিবার রাখতে চাইলেও সমাজের লোকলজ্জার ভয়ে পাওে না। সরকার প্রতিবন্ধীদের ভাতা দিচ্ছে। কিন্তু আমরা কী অপরাধ করেছি, আমরা তো সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধী আমাদেরও যদি ভাতা বা অনুদানের ব্যবস্থা থাকত তাহলে পরিবারে আমাদের একটা অবস্থান থাকত। আমরা অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক। আমার বয়স ৪২ বছর কোন দিন ভোট প্রয়োগ করিনি। ভোটার লিস্টের কোন লোকই আমাদের নাম লেখে না।’ যদিও ২০০০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে তৎকালীন সরকারদলীয় এমপি শাহজাহান খান উত্থাপিত এক জরুরী জনগুরুত্ব সম্পন্ন বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণের নোটিসের জবাবে তৎকালীন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী সংসদকে জানান যে, হিজড়াদের ভোটার করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে তিনি তাদের ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং তাদের জন্য ৬টি পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা, দলবদ্ধতাকে সংঘবদ্ধতায় রূপান্তর এবং তাদের নাচ-গানকে রুচিসম্মত করার জন্য পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন। হালনাগাদ ব্যাপারটি এ অবস্থায়ই শ্লথ অবস্থায়ই আছে। তাদের অভিজ্ঞতার বিবরণে অনেক অজানা, অশ্রুত মানুষ, যাদের জীবন সাধারণ সামাজিক জীবনের বাইরে সম্পূর্ণ অন্য নিয়মে চলতে থাকে। যা আমাদের মাঝে এক অন্য বিশ্বের আবিষ্কার যাদের দেখেও না দেখতে আমরা অভ্যস্ত। তাঁরা পূর্ণ মনুষ্যত্বে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান মানবিক নীতি সম্বন্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ না করে চোখ খুলে দিতে চান আমাদের। হিজড়াদের ঘিরে যে এত কুসংস্কার তার মূল এখানে। অন্য যৌনতাকে যারা জীবনের সত্য বলে বরণ করে নিয়ে দুঃখ মেনে নেন, তাঁদের উপস্থিতি বৃহত্তর সমাজের সদস্যদের মধ্যে যৌনতা সন্বন্ধে অস্বস্তিকর প্রশ্ন জাগাতে পারে, তাদের পরিচিত যৌনতার কাঠামো ও লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তির নিশ্চয়তাকে নড়বড়ে করে দিতে পারে। বিয়ে ও প্রজননকেন্দ্রিক সমাজে অন্য যৌনতার স্থান নেই, অথচ যৌনতার বোধ এবং আত্মবোধ একই বিষয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ হিজড়া সমাজ সব রকমের অন্য যৌনতার মানুষের আশ্রয়। সবচেয়ে বড় কথা এই সমাজের অন্তর্গত হলে নিজের পরিচয় না লুকিয়েই দেহব্যবসা করা যায়। কিন্তু হিজড়াদের মধ্যে যৌনজীবন সমকামিতার ভূমিকা নিয়ে এক পুলিশ অফিসার বলেন- ‘অনেক রকম যৌনতার মাঝে তারা এক রকম দেহব্যবসা করে যা সমকামিতাকে জীবনের সত্য বলে বরণ করে নেয়।’ যৌন বিকৃতির একটি বিকৃতি ঙৎধষ ঝবী. বেসরকারী সংস্থা কেয়ারের সমর্থনে ২০১৯ সালে ৩০ জন হিজড়ার ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় ২৯ জনই সিফিলিসে আক্রান্ত। হিজড়া ও পথশিশুদের ওপর এক জরিপে দেখা যায় এক সপ্তাহে ৮৮% হিজড়া ঙৎধষ ঝবী-এ লিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে ৯৫ ভাগই কনডম ছাড়া সম্পাদন করে। পুরুষ যৌনকর্মী যারা মূলত পুরুষের সঙ্গেই যৌনকর্ম করে থাকে। তবে কারও মধ্যে উভয় লিঙ্গের প্রতিই আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। ঢাকায় আশপাশে অবস্থানরত ৪০৭ জন পুরুষ যৌনকর্মীর ঙৎধষ গবহ যিড় যধাব ংবী রিঃয সবহ(গঝগ) ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় এদের বয়স ১১ থেকে ৫৫ এর মধ্যে এবং এর ৫৫ ভাগই ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সের। এক সপ্তাহে ৯৪% অন্য পুরুষের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে যৌনক্রিয়া করেছে। এই বাণিজ্যিক যৌনকর্ম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুরক্ষিত নয়। চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল মান্নান বলেনÑ ‘অস্বাভাবিক যৌনক্রিয়ার কুফলতায় বিভিন্ন প্রকারের যৌনরোগে আক্রান্ত হয় তারা। অথচ তাদের চিকিৎসা সুবিধা একেবাওে নেই বললেই চলে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে অবহেলিত হয়ে উপায়ন্ত হাতুড়ে ডাক্তার-কবিরাজের নিকট দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়। আর এভাবে সঠিক চিকিৎসার অপ্রাপ্তিতে ধুঁকে ধুঁকে পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় হিজড়ারা। চিকিৎসাসেবা যদি প্রত্যেক মানুষের মৌলিক হলেও হিজড়ারা এর ন্যূনতম সুবিধা সেবা পায় না। পায়ুপথে যৌনমিলন এইচআইভি/ এইডস সংক্রমণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এ ধরনের যৌনমিলনে পায়ুপথের মিউকাস আবরণ ছিঁড়ে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে যা এইচআইভি/ এইডস ত্বরান্বিত করে। সাধারণত পুরুষ সমকামীরা পায়ুপথে যৌনমিলনে অভ্যস্ত। তাই এইচআইভি/ এইডস বিস্তারের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ মহিলা যৌনকর্মীর পক্ষে জানা বা বোঝা সম্ভব নয় যে তার যৌনসঙ্গীর অন্য কোন পুুুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক আছে কি নেই। তবে নিঃসন্দেহে কোন মহিলা যৌনকর্মীর ক্ষেত্রে পুরুষ সমকামী যৌনসঙ্গী অন্যান্য পুরুষ যৌনসঙ্গীর তুলনায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।’ পেশাদার সমকামী ভাবনা বলেন, ‘আমি ছোটকাল থেকে চট্টগ্রাম ছিলাম চার মাস হলে এখানে এসেছি। হঠাৎ জ্বর ও পাতলা পায়খানা হওয়ায় আমার ওজন অনেক কমে এবং সমস্ত শরীরে ফোস্কা পড়ে গেছে। গত তিন বছর যাবত জলনা (গনোরিয়া, সিফিলিস) রোগে ভুগছি। শরীরের এই অবস্থায় রোজগারের ঝাঁপে লাঠি (ব্যবসা বন্ধ) উঠে গেছে। জেল ফেরত কয়েদি, দারোয়ান থেকে শুরু করে কম-বেশি সব ধরনের লোকই আমার জুড়িদার (সঙ্গী) ছিলেন। ভাল রোজগারে জন্য এখানে আসা। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার একনিষ্ঠ কর্মী ও আইনজীবী নাজমুল আলম চৌধুরী নোমান বলেন- ‘শ্রেণী বিন্যাস ছাড়াও অসাম্যের যে অন্য উৎস আছে তা মানা এবং বৈষম্য সৃষ্টি বজায় থাকার কারণ যে শুধু শ্রেণীবিভাগ নয়, এটি যেমন জানা দরকার, তার সঙ্গে এটাও জানা প্রয়োজন যে, অসাম্যের অন্য উৎসগুলোর কোনটাই শ্রেণী-নিরপেক্ষ নয়। নি¤œ শ্রেণীরা যে বাধা অতিক্রম করতে পারেন না উচ্চশ্রেণী সে বাধা সহজেই টপকাতে পারেন। সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিতে লিঙ্গবিভেদ নিশ্চয়ই একটি উপাদান, কিন্তু তা শ্রেণীনিরপেক্ষভাবে কাজ করে না। বস্তুত নি¤œ শ্রেণীর ক্ষেত্রে শ্রেণী বঞ্চনা এবং লিঙ্গ বঞ্চনা একবিন্দুতে মিলিত হয়ে তাদের জীবন দুঃসহ করতে পারে। তবে তাদের সবার মধ্যকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ সবার জন্যই কম বেশি ঝুঁকি বহন করছে। যা পরিষ্কার হয় তা এই যে, বাংলাদেশের এবং গোটা উপমহাদেশের হিজড়া সমাজের ইতিহাস ও অবস্থান পশ্চিমের তৃতীয় লিঙ্গের ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেই কারণে পশ্চিমের ‘লিঙ্গতত্ত্ব’ বাংলাদেশীয় তৃতীয় লিঙ্গের সম্পর্কে সহজে প্রয়োগ করা যায় না। তা-ও আজকাল এই দেশের সমাজে অনেকেই কিছু কিছু নামকরণ ব্যবহার করেন যেমন- টান্স জেন্ডার, ট্রান্স সেক্সুয়াল, থার্ড জেন্ডার ইত্যাদি। আধুনিকতার ছাপ তৃতীয় লিঙ্গের সমাজে পড়তে শুরু করেছে ঠিকই, তারা নাগরিক অধিকার চাইছেন, সমাজে সসম্মান স্বীকৃতি চাইছেন, শিক্ষা ও উপার্জনের সুযোগ দাবি করছেন, লিঙ্গ পরিবর্তনের বিজ্ঞানের সাহায্য চাইছেন। মনোভাবের বদল তাঁদের হচ্ছে, কিন্তু তাঁদের যারা যুগ যুগ ধরে অচ্ছুত করে রেখেছে তাদের হচ্ছে কি?
×