ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবু আফজাল সালেহ

রক্তজবার কবি মোহাম্মদ রফিক

প্রকাশিত: ১৩:২৩, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

রক্তজবার কবি মোহাম্মদ রফিক

রক্তজবার কবি মোহাম্মদ রফিক। রক্তজবার মতোই তাঁর উচ্চারণ। রক্তজবার মতো দ্রোহ ও টগবগে তাঁর কবিতায় উচ্চারণ। রক্তজবার মতোই টুকটুকে প্রেমের ফল্গুুধারা তাঁর কবিতায়। রক্তজবার মতোই ঝরঝরে কবিতা; ফুরফুরে তাঁর কবিতার শব্দাবলি। কবিতার উপাদান, উপমা বা চিত্রকল্পগুলোতে রক্তিমের আভা; ঠিক যেমন উদ্ভাসিত ঝলমলে রক্তজবা। কবি মোহাম্মদ রফিক (জন্ম-২৩ অক্টোবর, ১৯৪৩) কবি, লেখক ও শিক্ষক। তিনি একজন মননশীল আধুনিক কবি হিসেবেও পরিচিত। মূলত ১৯৬০-এর দশকে কবির আত্মপ্রকাশ ঘটে। পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে ছাত্রআন্দোলন ও কবিতায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কবিতাকে ব্যবহার করেছেন। কবিতায় অবিচার-অনিয়মের প্রতি শক্ত উচ্চারণ করেছেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ২০০৯ এ অবসর নিয়েছেন। খুলনা জেলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে মাধ্যমিক পাস করেন কবি মোহাম্মদ রফিক। পরে ঢাকার নটর ডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এরপরে ঢাকা কলেজে মানবিক বিভাগে চলে যান। এ সময় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। মূলত তখন থেকেই সাহিত্যে তার অবস্থা শক্ত হতে থাকে। তিনি ১৯৬০-এর দশকের প্রারম্ভে সমকাল, কণ্ঠস্বর, স্বাক্ষর, অচিরা ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় কবিতা লিখতে থাকেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বৈশাখী পূর্ণিমায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭৬ সালে প্রকাশ পায় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধুলার সংসারে এই মাটি। যেন শহরে নয়, গাঁয়ে থেকে গাঁয়ের কাব্যবয়ান করেছেন। কবির উল্লেখযোগ্য অন্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে : কীর্তিনাশা (১৯৭৯), খোলা কবিতা ও কপিলা (১৯৮৩),গাওদিয়ায় (১৯৮৬),স্বদেশী নিশ্বাস তুমিময় (১৯৮৮), মেঘে এবং কাদায় (১৯৯১), রূপকথা কিংবদন্তি (১৯৯৮),মৎস্য গন্ধ্যা (১৯৯৯), মাতি কিসকু (২০০০), বিষখালি সন্ধ্যা (২০০৩), নির্বাচিত কবিতা (২০০৩),কালাপানি (২০০৬), নির্বাচিত কবিতা (২০০৭), নোনাঝাউ (২০০৮), দোমাটির মুখ (২০০৯), ত্রয়ী (২০০৯), মোহাম্মদ রফিক রচনাবলী-১ (২০০৯), মোহাম্মদ রফিক রচনাবলী-২ (২০১০)। কবিতার পাশাপাশি তার রয়েছে বেশ কয়েকটি গদ্যগ্রন্থ। এর মধ্য ভালবাসার জীবনানন্দ (২০০৩), আত্মরক্ষার প্রতিবেদন (২০০১), স্মৃতি বিস্মৃতির অন্তরাল (২০০২) অন্যতম। তিনি সাহিত্যে মর্যাদাপূর্ণ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, (১৯৮৭) পান। দেশ ও ভাষার আভিজাত্যের পুরস্কার একুশে পদক (২০১০) পান। এ ছাড়া আলাওল পুরস্কার (১৯৮১)সহ অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননা পেয়েছেন। যা কবির সাহিত্যজীবনকে গৌরাম-িত করেছে। কবি ১৯৬১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। সে বছরই রাজশাহী সরকারী কলেজে ইরেজিতে অনার্সসহ ¯œাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন। মনমানসিকতা শক্ত হতে থাকে। সমাজ ও দেশের নানা অবিচার-অনাচার তাঁকে বিষিয়ে তোলে। সরাসরি অংশ নেন সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে। কবিতাও লিখতে থাকেন দুঃশাসন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে সামরিক আইনে তাকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- দেয় সামরিক আদালত। এ সময় দিনের পর দিন পালিয়ে হুলিয়া আতঙ্কে থাকতেন তিনি। জেলেও যান অবশেষে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে থাকার কারণে তাকে বহিষ্কৃত করা হয় রাজশাহী কলেজ থেকে। তার পরেও কলম থামেনি কবির। ১৯৭১ সালে ১নং সেক্টরের হয়ে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। অংশ নেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও। সবাই কবি হতে পারেন না! হুটহাট করে লিখে কবিতা হয় না। শব্দের পর শব্দ বসালেই কবিতা হয় না! যিনি এভাবে কবিতা লেখেন তিনিও কবিযশ পান না! কবিতা ধার করা বিষয়ও নয়। অনুকরণ করেও কবি হওয়া যায় না। এটা জানেন সবাই। কিন্তু, এসবের বিরুদ্ধে শক্ত উচ্চারণ করেন কয়জন? কবি রফিক করেছিলেন কঠিন কাজটিই। জেনারেলের (এরশাদ) কবিতা পত্রিকার প্রথম পাতায়! কবির লেখা ছাপা হবে মধ্যপাতায়! কবি হওয়া অত সজহ? করলেন রক্তজবার মতো শক্ত উচ্চারণ, ‘সব শালা কবি হতে চায়...।’ ‘খোলা কবিতা’ (১৯৮৩) নামে সেই কবিতা কেউ প্রকাশ করতে সাহসই করছিল না। ‘...সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়ার এসে রাজাসনে বসবেই। ...লোলুপ দুর্নীতিবাজ অপদার্থের দারুণ কামড়ে/অনুর্বর মাঠ-ঘাট, ছিন্ন ভিন্ন সমাজ-কাঠামো/রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুঁজিবাদী কালো থাবা লালরক্ত ঢালে;/আবার আকাশ জুড়ে তৃতীয় বিশ্বের ভাঙ্গাঘর/ঠেলে ঢোকে জলপাই লেবাস্যা দেবতা, একই চালে/পায়ে, কালো বুট; হাতে, রাইফেলের উদ্যত সঙ্গীন/এবার থামাও শালা। শুয়ারেরা ইয়ার্কি থামাও...।’ পুরো কবিতাটি ছিল অনেক দীর্ঘ, প্রায় ১৬ পৃষ্ঠা। এটি গোপনে ছাপানো হয় এক ছাপাখানায়। নিউজপ্রিন্টে ছাপানো সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্রছাত্রীরা। হাতে হাতে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয় এ কবিতাটি নিয়ে। ‘ওই ধর্ষিতার চুল লেপ্টে আছে মেঘে মেঘে, ছেঁড়াখোড়া সারাটা আকাশ/ভেঙ্গে বৃষ্টি মধ্যরাত/কাদাবালু মাখামাখি ধড়/ভাসিয়ে ভুবন জন্ম নেয় সোঁদ শ্যাওলা পুকুরের পাড়;/শত শত রক্তপদ্ম ওই চোখ খুলছে ঘুম ঠেলে/এবং এক ফালি লা-ওয়ারিশ বাহুঠ্যাঙ, /মারণযজ্ঞের ভস্ম উপচে উঠে আসছে কাষ্ঠখ-, মুখে অগ্নি,/ধিক ধিক শরমে কুঞ্চিত, সে আমার মাতৃভূমি, নিরুদ্ধ স্বদেশ।’ -(মুখ)। নানা অনিয়ম, অত্যাচার নিয়ে কবিতায় ধরা পড়েছেন তিনি। কবিতার উচ্চারণই তাঁর উচ্চারণ। বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন তিনি ইতিবাচক সমাজ পরিবর্তনে। শক্ত কলমে আর শব্দ বুননে প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর উচ্চারণে আছে প্রাণ, তারুণ্যশক্তি। দ্রোহের কথা সঞ্চালিত করতে চেয়েছেন সমাজে, রাষ্ট্রে। ব্যর্থ হননি তিনি। প্রেমের কবি মোহাম্মদ রফিক। নান্দনিক উচ্চারণে প্রেমের উন্মাদনা। কত সুন্দরভাবেই তিনি উচ্চারণ করলেন- ‘মরণেতে পেতেছি বাসর/কোথায় সে সর্পদেবী/কে তবে দংশিবে আজ রাতে,/দুই ঠোঁট মেলে দিয়ে তুমি/শ্বাস নাও গহীন আশ্লেষে/আমি দেখি, ঢেউ ভাঙে দুই তীর জুড়ে, ...’ (নদী ও নারী)। প্রেম অমর। সব কিছুই নষ্ট হবে প্রেম-ভালবাসা ছাড়া। প্রেমিকার উদ্দেশে কবির উচ্চারণও তাই বলে- ‘দুই দিন কথা হবে/তিন দিন দেখা মিলবে/তারপর সবকিছু হাওয়া/দুটি চোখ ঝুলে রইবে দিগন্তের কোণে/কিছু কথা বৃষ্টি হয়ে ঝরবে অকারণে, /সমস্ত অস্তিত্ব তবু হবে না বিলীন/টিকে থাকবে তোমার-আমার প্রিয় অনুষঙ্গ, একটি দিন!’ -(অশেষ) অনেক কথা বলা যায় না। কিন্তু বুঝে নিতে হয়। ভেতরের কষ্ট অনেক সময় অনুচ্চারিত থেকে যেতে পারে। বাহ্যিক দৃশ্য ভেতরের দৃশ্যের মতো নাও হতে পারে। কবিও উচ্চারণ করলে সুন্দর চিত্রকল্পের মাধ্যমে এমন একটি কবিতাংশ- ‘লাশ নামানো হচ্ছে গোরে/ঠিক সেই মুহূর্তে একটি প্রজাপতি/ কোত্থেকে, ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে উড়ে/এসে বসল লাশের বুকের ওপর,/প্রজাপতিটি নাড়াচ্ছে পাখনা;/আনন্দে না বেদনায়/কে বলবে!’-(লাশ)। ‘জোনাকি’ কবিতায় স্বপ্ন দেখালেন। ফুটিয়ে তুলনেন সুন্দর চিত্রকল্প-‘অন্ধকারে আলোর ফুল/পাপড়ি খুলছে, পরক্ষণে বুজিয়ে ফেলছে/ যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ/ঘনবদ্ধ পাতার ভিড়ে;/ওরা বলে, জোনাকি,/আমি বলি, স্বপ্ন!’ কবির কবিতায় মাটির গন্ধও পাওয়া যায়। গ্রাম-গঞ্জে-আনাচে-কানাচের শব্দাবলি নিয়ে এসেছেন কবিতায়। কবিতায় তুলে এনেছেন সহজ-সরল উপাদান, উপমা বা চিত্রকল্প। ‘মোছো রক্ত, পৈঠার ওপরে কালসিঁটে এই/লড়াই চলবেই...।’ কি উচ্চারণ! নান্দনিকতার সঙ্গে দ্রোহের উচ্চারণ! বাংলাদেশের চিরায়ত পোড় খাওয়া মানুষের সুখ-দুঃখ, প্রত্যাশা, বিড়ম্বনা, প্রেম আর জীবনের জটিল হিসাব তুলে ধরেছেন এভাবে। লোকজ জীবনের এসব উপাদান কবিকে অনন্য স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। আধুনিক প্রকাশে তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন এক ভিন্নমাত্রায়।
×