ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মনিরুল ইসলাম

গল্প ॥ অস্কার শিন্ডলারের গাছটি

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

গল্প ॥ অস্কার শিন্ডলারের গাছটি

পূর্ব প্রকাশের পর এমন একটা ব্যবসা খুঁজছিলেন যাতে কাঁচা পয়সা কামানো যায়। ঠিক করলেন যুদ্ধে কাজে লাগবে এমন জিনিসই বানাবেন, তখন সর্বোচ্চ চাহিদা এসব পণ্যের। তাই প্রতিষ্ঠিত হলো শিন্ডলারের অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ধাতব দ্রব্য তৈরির কারখানা। স্থান হিসেবে পোল্যান্ডের ক্র্যাকাওকে বেছে নেবার কারণ মূলত দুটি- দখলকৃত দেশে সস্তায় পছন্দমতো জায়গা পাওয়া এবং চাপে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে সস্তায় শ্রমিক পাওয়া। জার্মানদের দখলকৃত এই ভূমিতে সব পোলিশরাই চাপে ছিল কিন্তু সবচেয়ে কোণঠাসা অবস্থায় ছিল এখানকার ইহুদীরা, ক্রাকাওয়ে ছিল ইহুদীদের বড় একটা বসতি। কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শিন্ডলার ‘অবরুদ্ধ’ ইহুদীদের কাছ থেকে পুঁজি, জনবল ও ব্যবস্থাপনা সব কিছুই পেয়েছিল যা তার যুদ্ধকালীন ব্যবসার সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। কিন্তু এর পরও তার কারখানার ইহুদীদের কাছে (যুদ্ধের সময়) শিন্ডলারের ভূমিকা ছিল দেবতার মত, কারণ ওই কারখানায় কাজ করার কারণে ওদের জীবন রক্ষা পেয়েছে। সেনাবাহিনী প্রতিটি ইহুদীকেই ক্যাম্পে রাখার পরিকল্পনা করে, যেখানে মানবেতর অবস্থায় তাদের রাখা হতো। ক্যাম্পে থাকা প্রতিটি ইহুদীকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে, হতে হয়েছে নির্মম নির্যাতনের শিকার। এদের বড় একটি অংশকে মেরে ফেলা হয়েছিল, অনেকে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। সে তুলনায় শিন্ডলারের কারখানার হাজার বারো’শ ইহুদী শ্রমিক ছিল রাজার হালে। অনেক উচ্চশিক্ষিত এবং অন্য পেশার ইহুদীরাও জীবন বাঁচানোর জন্য তার কারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। জার্মান সেনাবাহিনীকে ব্যবসার অংশীদার ক’রে এবং জার্মান সেনা অফিসারদের ঘুষ দিয়ে এই কারখানার শ্রমিকদের ক্যাম্পে নেয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন শিন্ডলার। পড়তে পড়তে অরিন্দম স্বগোতক্তির মতো বলে ওঠে- - শিন্ডলারের কারখানায় না আসলে ওই ইহুদীদের কি হতো? - ওই বার’শ লোকের বেশি ভাগকে হয়ত যুদ্ধের সময়েই মরতে হতো। সিনেমার শেষের দিকের একটা দৃশ্য দেখলে বুঝবা কারখানার ইহুদীরা শিন্ডলারের প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ ছিল ... অরিন্দমের জন্য ইউটিউবে ভিডিও ক্লিপটা চালায় সমীর- ১৯৪৫ সালের ঘটনা, যুদ্ধশেষের ঘোষণা এলো, জার্মান বাহিনী শর্তহীন আত্মসমর্পণ করেছে, পোল্যান্ড দখলে নিয়েছে সোভিয়েত বাহিনী। নাজি পার্টির সদস্য শিন্ডলারকে পালাতে হবে ঐ রাতেই। সেকথা তিনি জানিয়ে দিলেন কারখানার ইহুদীদের। বিদায়ের সময় কৃতজ্ঞ ইহুদীরা তাকে কিছু একটা উপহার দিতে চায়। কিন্তু যে রকম হত দরিদ্র অবস্থা কিই বা দেবে... একজনের সোনায় বাঁধানো দাঁত ছিল ... সেটা গলিয়ে রাতের বেলা ওই কারখানায়ই তৈরি হলো একটা সোনার আংটি... গভীর রাতে শিন্ডলারকে আবেগপূর্ণ বিদায় দেয় ইহুদীরা। যুদ্ধের পর বিচারে শিন্ডলার নির্দোষ প্রমাণিত হন। যুদ্ধের সময় ইহুদীদের প্রতি মানবিক হবার কারণে তিনি অভিনন্দিত ও প্রশংসিত হন। ১৯৫৮ সালে তিনি ইসরাইলে আমন্ত্রিত হন শান্তি ও সম্প্রীতির দূত হিসেবে। জেরুসালেমের ইয়াদ ভাসেম চত্বরে ২য় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৬০ লাখ ইহুদীর স্মারক মূর্তির কাছেই শিন্ডলার একটি গাছ লাগান, ‘সম্প্রীতি বৃক্ষ’। সিনেমার শেষের দৃশ্যে এটার উল্লেখ করে বলা হয়- গাছটা দিনে দিনে বেড়ে উঠছে । শুনে মনে হয়- ইসরাইলে শান্তি ও সম্প্রীতি দিনে দিনে বাড়ছে। হোটেল লবিতে বসে ভাবনায় ডুবে যাওয়া অরিন্দমকে নাড়া দেয় সোহেল, - চল রুমে যাই, ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। (৫) ক্রাকাওয়ে ওদের ভ্রমণটা সাদামাটাই হবার কথা ছিল। তার মানে, অন্যান্য টুরিস্টরা যা দেখে, শহরের ভেতরে রাজ-প্রাসাদ আর শিন্ডলারের কারখানা, শহরের বাইরে লবণের খনি এবং অসউইচ-বার্কিনাওয়ের ইহুদীদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। কিন্তু আরও কিছু অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তা অপেক্ষা করছিল ওদের জন্য, যার জন্য হয়তো ক্রাকাও বিশেষভাবে জ্বলন্ত থাকবে ওদের স্মৃতিতে। গতকাল দুপুর থেকে বিকেলে ওরা রাজপ্রাসাদ আর শিন্ডলারের কারখানা দেখে এসেছে। প্রাসাদটি ইউরোপের অন্য দশটা প্রসাদের মতই শুধু লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির একটা অরিজিনাল ছবি আছে এখানে। স্পিলবার্গের ছায়াছবিটা দেখা ছিল বলেই শিন্ডলারের কারখানা দেখার আগ্রহ ছিল ওদের। এটি এখন ক্র্যকাওয়ের ‘যুদ্ধ-স্মৃতি মিউজিয়াম’। ওয়ারসোতে দেখা ‘যুদ্ধ-স্মৃতি মিউজিয়াম’ এর সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই, তবে শিন্ডলারের কারখানার কিছু নিদর্শন এবং ছবি আছে। আজকে ওরা যাচ্ছে প্যাকেজ ট্যুরে, প্রথম গন্তব্য লবণের খনি তারপর অসউইচ ও বার্কিনাও। ট্যুর কোম্পানির গাইড ব্রুনো লিজকার সঙ্গে পরিচয় হল। লোকটা ক্র্যাকাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইংরেজী জানে বলে পার্টটাইম গাইডের কাজ করে। পরাগ লক্ষ্য করে সামনের সিটে বসাতে সমীর অনেক ক্ষণ ধরে গাইডের সঙ্গে কথা বলছে। সল্টমাইনে গাড়ির থেকে নামার পর সমীরকে জিজ্ঞেস করে - - পোলিশটার লগে এতক্ষণ কি গ্যাজাইলি? প্রশ্নটা শুনে সমীরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে- - ইন্টারেস্টিং বিষয় হইল, ব্রুনো সংস্কৃত ভাষা শিখতেছে ... - তাই নাকি! কোন পারপাস আছে না শুধু ইন্টারেস্ট? পরাগ একটু অবাক হয়। - ক্র্যাকাও বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের শিক্ষক সে, গবেষণা করছে বৌদ্ধ দর্শনের উপর, সেইটাই পারপাস। - ও এইখানেও তোমার দর্শনের লোক পাইয়া গেছ! সমীর সমাজ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনার উপর লেখাপড়া করেছে, চাকরি করে উন্নয়ন গবেষণা সংস্থায় কিন্তু ওর পরাশোনার আগ্রহ, এমনকি সৃষ্টিশীল লেখার বিষয় দর্শন এবং দর্শনের নানা সমস্যা। পরাগ বলতে থাকে- - এই লোকের লগে গল্প পারলে তো ভালোই হইত... ওদের কথায় ছেদ পরে ব্রুনোর আগমনে- - এক্সকিউজ মি গাইজ, হিয়ার ইজ ইয়োর টিকেটস্... ওদের হাতে সল্টমাইনের টিকেট ধরিয়ে দিলো ব্রুনো। সল্ট-মাইন থেকে বেরিয়ে ওরা অসউইচে পৌছালো বেলা এগারোটার দিকে। এখানে আলাদা গাইড ৩০ জনের একেকটা দল। ব্রুনো ওদের একটা দলের সঙ্গে ‘ট্যাগ’ করে দিল, গাইডের নাম হানা। অসউইচ একসময় সৈন্যদের ব্যারাক ছিল, সেরকমই লম্বা লম্বা কতগুলো ঘর। গাইডের উপস্থাপনা ছাড়া এগুলোকে বিশেষ কিছু বলে মনে হবে না। হানার, ইতিহাসের আবহ মেশানো বর্ণনার গুণে ওদের কল্পনায় হলকাস্ট প্রাণবন্ত হয়ে উঠছিল। শিন্ডলার্স লিস্ট আর পিয়ানিস্ট ছবির কিছু কিছু দৃশ্য ভেসে আসছিল সমীরের চোখের সামনে। সব কিছু ঠিকই চলছিল। অসউইচ ক্যাম্পের শেষ প্রান্তে একটি জায়গায় ওরা, যেখানে ইহুদীদের লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলা হতো। সমীর, পরাগ, সোহেল তিন জনই ছবি তুলছে। সোহেলের হাতে ক্যামেরা বাকি দুজনের হাতে মোবাইল। একটু পেছন থেকে লম্বা একটি লোক একটু চাপা কিন্তু ধমকের স্বরে বলছে- ‘ডোন্ট টেক পিকচার, হ্যাভ রেসপেক্ট...’ পর পর দুবার বলাতে ওরা পেছন ফিরে দেখলো লোকটাকে। লোকটার গায়ের চামড়া সাদাই কিন্তু চুল আর (ফ্রেঞ্চকাট) দাড়ি কালো। পরাগ লক্ষ্য করছিল এখানে কোথাও ছবি তোলা নিষেধের কথা লেখা আছে কিনা, তেমন কিছু চোখে পড়ল না। লোকটাও মিউজিয়ামের কেউ না, দর্শনার্থীদের মতো কানে অডিও গাইড লাগানো। লোকটার ধমকের সুরে কথা বলায় ওরা তিনজনই বিরক্ত হলো। অসউইচের বাইরে এসে রাগে ফেটে পড়ল পড়ল পরাগ... - দেখছো শয়তানটা কেমন ধমক দিয়া কথা কইতাছিল, ছবি তোলা নিষেধ নাই... ‘হ্যাভ রেসপেক্ট...’ শালার পুত, ছবি তুললে রেসপেক্ট ধুইয়া যায় নাকি? সোহেলও বেশ উত্তেজিত- - ওই ব্যাটা নিশ্চয় ইহুদী...নাহলে এত জ্বলে কেন? সমীর অতটা উত্তেজিত না, কিছুটা চিন্তিত, নির্বিকার স্বরে বলে- - আমার মনে হয়, অমাদের চামড়া কালো না হইলে এমনভাবে বলতো না। - বাহ্, রেসিজমের ভিক্টিমগো দেখতে আইসা নিজেরাই রেসিজমের ভিক্টিম হইলাম? (পরাগের স্বরে রাগ আর বিস্ময়...)... আমি ওরে চার্জ করুম... - মাথা গরম করিস না পরাগ... (পরাগের কাঁধে হাত রাখে সমীর)... কোন রকম সিন-ক্রিয়েট করা ঠিক না...। বার্কিনাওয়ে এসে ওই লোকটাকে দূর থেকে ফলো করতে থাকে সোহেল, কিছুটা অরিন্দমও। অরিন্দম দূর থেকে লোকটার ছবিও তোলে কয়েকটা। সোহেল পরাগের কাছে এসে বলে- ‘আমি শিওর লোকটা ইহুদী।’ - কিভাবে বুঝলা, সোহেল ?... একটু দূরে দাঁড়ানো সমীর জানতে চায়... - ভাব ভঙ্গিতেই বোঝা যায় দাদা... সোহেলকে সাহায্য করে অরিন্দম- - দাদা, আমরা এখানে এসেছি কৌতূহল থেকে, কিন্তু ওর মধ্যে এগুলো নিয়ে আবেগ আছে তা পরিষ্কার বুঝা যায়...এই ছবিটাতে ওর এক্সপ্রেশন দেখেন.... ওরা সবাই ছবিটা দেখে, একটা মনুমেন্টের সামনে আধবোজা চোখে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। অসউইচের এই কথিত ইহুদী লোকের কাহিনীটা হয়ত এখানেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু পোল্যান্ডে ওদের ইহুদী-অভিজ্ঞতার আরেক ধাপ বাকি ছিল। (৬) বার্কিনাও থেকে শহরে ফিরতে ফিরতে প্রায় ৬ টা বেজে যায়, এখনও সূর্য হেলে পড়েনি এখানে। গাড়ি থেকে নেমে ব্রুনোর কাছ থেকে বিদায় নিতে ট্যুর অফিসে ঢোকে পরাগ আর সমীর। অপ্রত্যাশিতভাবেই ঐ কথিত ইহুদী লোকটাকে দেখতে পায়, ব্রুনোর সঙ্গে কথা বলছে। ওদের দেখে ব্রুনো হাত নাড়ে- - হাই ফ্রেন্ডস্ ... মিট মাই ফ্রেন্ড শালোভ... শালোভ, এরা দুজনই বাংলাদেশের... দুজনই লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী... - প্রোব্যাবলি উই মেট টুডে ইন অসউইচ...(সমীর গুতো দিয়ে পরাগকে থামিয়ে দেয়) হ্যান্ডশেক করার সময় শালোভ পুরো নাম বলে ইমানুয়েল শালোভ। ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, ক্র্যাকাও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে গবেষণা করতে। পরাগ সমীরকে বাংলায় বলে- - নাম শুইনাই বুঝা যায় ব্যটা ইহুদী। একটু আলাপ করতে পারলে ভাল হইত... - বইলা দেখি রাজি হয় নাকি, আক্রমণাত্মক কিছু বলিস না কিন্তু... - না না ঠিক আছে... (আস্বস্ত করে পরাগ)... ইমানুয়েল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, সমীর এগিয়ে গিয়ে বলে- - ব্রুনো ক্যান আই অফার এ ড্রিংক টু বোথ অফ ইউ? ব্রুনোর আপত্তি নেই বোঝা যাচ্ছে, ইমানুয়েল কিছুটা দ্বিধা মিশিয়ে বলল- - আই হ্যাভ টু লিভ ইন থার্টি মিনিট্স, ওকে জাস্ট আ ড্রিংক... সমীর আর পরাগের সঙ্গে ঐ লোকটাকে বেরোতে দেখে কিছুটা চমকে গিয়েছিল সোহেল আর অরিন্দম। (চলবে)
×