ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাহসিনা এনাম তৃষা

সুমনের ঘরে ফেরা

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

সুমনের ঘরে ফেরা

সকাল থেকেই সুমন মায়ের জন্য খুব কান্না করছে। গত সাত দিন ধরেই মায়ের জন্য সুমনের মনটা যেন কেমন করছে। গতকাল রাতে এখানকার রহিমা খালা তাকে খুব জোরে গালে একটা চড় মেরেছেন। এখন মা কাছে থাকলে সুমনকে খুব আদর করতেন। আর তাই সুমন আজ এত কান্না করছে। গত সাত দিন ধরে সুমন তার বাড়িতে নেই। সে আছে ঢাকার একটা সেফ হোমে। কারণটা আর কিছুই না, সুমন ঢাকায় হারিয়ে গেছে। এই তো ক’দিন আগেও সুমন গ্রামে তার নিজের বাড়িতে ছিল তার পরিবারের সঙ্গে। বাড়িতে তার মা আছে, বাবা আছে, দাদি আছে আর আছে বছর তিনেকের একটা ছোট্ট বোন। সুমনের বোনের নাম মিনু। আধো আধো বলে সারাদিন মিষ্টি মিষ্টি ছড়া বলে বেড়ায় মিনু। সেদিন ভর দুপুর বেলায় সুমন খেলছিল। সুমনের মা উঠানে ধান শুকাতে দিচ্ছিল। সুমন খেলতে খেলতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। খেলার জন্য মাটির হাঁড়ির ভাঙ্গা টুকরো খুঁজতে এসেছিল সে। ভাঙ্গা টুকরো না পেয়ে দৌড়ে রান্না ঘর থেকে বের হতে গিয়ে এক ভয়াবহ বিপত্তি ঘটাল সুমন। তার ধাক্কা লেগে সরষের তেলের ভাঁর মাটিতে পড়ে গেল। সমস্ত তেল মেঝেতে পড়ে নষ্ট হলো। শব্দ শুনে সুমনের মা রান্নাঘরে দৌড়ে এলেন। অভাবের সংসার তার। এত কষ্টের টাকায় কেনা তেল মেঝেতে পরে আছে দেখে বুক ফেটে গেল তার। সুমনকে আচ্ছা করে বকে দিলেন তিনি। গরিবের ঘরের খাবারের জিনিস অপচয়ের ভয়াবহতা নয় বছরের সুমনের মাথায় ঢুকল না। মাথায় ঢুকলো শুধু মায়ের কথাগুলো। ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বের হয়ে এল সে। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল গ্রামের ছোট রেল স্টেশনে। উঠে পড়শ একটা ফাঁকা বগিতে। তারপর কখন যে সুমন ঘুমিয়ে পড়ল তার আর খেয়াল নেই। সুমনের যখন ঘুম ভাঙল তখন অনেক রাত। ট্রেনটা ছুটে চলছে। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল সুমন। ফাঁকা ট্রেনের বগিতে এখন অনেক মানুষ। সুমন অবাক চোখে দেখতে লাগল সবাইকে। লোকজন ভাবল সুমন বুঝি ট্রেনের হকার অথবা ভিক্ষুক। তাই তাকে কেউ কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চলার পর ট্রেনটা থামল। বগি ফাঁকা হয়ে এলে সুমন নিজেও নেমে পড়ল বগি থেকে। স্টেশন নেমেই সুমন বুঝতে পারল এটা তার গ্রামের রেলস্টেশন নয়। এই রেলস্টেশনটা অনেক বড়। অনেক ব্যস্ত মানুষ একটা স্রোত যেন সুমনকে আলত করে ছুঁয়ে গেল। এবার সুমনের ঘোর কাটল। সে এগিয়ে গেল এক বয়স্ক কুলির দিকে। গায়ে তার লাল রঙের শার্ট আর গলায় গামছা। সুমন ডেকে বলল, ‘দাদা এই জায়গাটা কোথায়? এটা তো আমাদের গ্রামের ইস্টিশন না।’ সুমনের ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকাল বৃদ্ধ কুলি। সুমনকে ভাল করে পরখ করল। শ্যামলা রং, রোগা শরীর। তবে চোখগুলো ডাগর ডাগর। কেমন একটা মায়া আছে ছেলেটার চেহারা। বৃদ্ধ বললেন, ‘আরে এইটা ঢাকা শহর। আর এই হলো কমলাপুর রেল ইস্টিশন।’ এইবার সময় বুঝতে পারল সে হারিয়ে গিয়েছে। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। সুমনের কান্না দেখে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলো। সুমন তাদের সব কথা খুলে বলল। সব শুনে বৃদ্ধ কুলি সুমনকে নিয়ে গেলেন স্টেশন মাস্টারের কাছে। স্টেশন মাস্টার সুমনকে তার বাবা-মার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দায়িত্ব দিল পুলিশকে। পুলিশকে সব খুলে বলল সুমন। আরও বলল তার বাবার নাম তার মায়ের নাম আর গ্রামের নাম। আর তারপর পুলিশ সুমনকে নিয়ে গেল সেফ হোমে। গত সাত দিন ধরে এই সেফ হোমে আরও দশ-বারোটা বাচ্চার সঙ্গে আছে সুমন। দুপুরের খাবারের ঘণ্টা পড়েছে। সব বাচ্চার সার বেঁধে বসে খাচ্ছে। আজকে রান্না হয়েছে মাংসের ঝোল আর ভাত। বাচ্চারা সবাই খুব আনন্দ নিয়ে খাচ্ছে। সুমন মাংস খেতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু আজ তার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। বাড়ির কথা মনে পরে আবারও কান্না পেলে সুমনের। খাবার ছেড়ে উঠে গেল সে। মা, বাবা দাদি আর মিনুর জন্য পুরো সন্ধ্যা পর্যন্ত ভীষণ কান্না করল সুমন। সন্ধ্যাবেলা অফিস ঘরে ডাক পড়ল সুমনের। কেয়ারটেকার মালের চাচার হাত ধরে সুমন সেখানে গেল। গিয়ে দেখল দুজন পুলিশ এসেছে। সুমনের ভেতর একটা মৃদু শিহরণ খেলে গেল। কৌতূহলী চোখে খুব দ্রুততার সঙ্গে একবার চোখ বুলাল পুরো ঘরটায়। পুলিশ দুজন ছাড়াও আরও দুজন নতুন লোক আছে এই ঘরে। আসে দুজন মানুষ সুমনের ভীষণ চেনা। তার মা আর বাবা। সুমন দৌড়ে গিয়ে তার মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পরল। ছেলেকে কাছে পেয়ে সুমনের মা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন তিনি। আর তারপর সুমনকে জড়িয়ে ধরে খুব করে আদর করলেন। বাবা এসে কোলে তুলে নিলাম সুমনকে। আবার কমলাপুর স্টেশনে এসেছে সুমন। তবে এবার একা নয়। এসেছে তার বাবা আর মা’র সঙ্গে। নিজের গ্রামে ফিরে যাব সুমন। তার দাদি আর ছোট বোন মিনু সেখানে অপেক্ষা করছে তার জন্য। কমলাপুর স্টেশনে এখনো প্রচন্ড ভিড়। ভিড়ে সুমন আবার হারিয়ে যেতে চায় না। আর তাই এবার সুমন তার বাবার হাতটা চেপে ধরল খুব শক্ত করে। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×