ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রযুক্তি দিয়ে শব্দকে জয় করার উদ্যোগ

শব্দদূষণ শহুরে মানুষের জন্য বড় হুমকি

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

  শব্দদূষণ শহুরে মানুষের  জন্য বড় হুমকি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যখনই শহুরে পরিবেশ এবং দূষণ নিয়ে আপনি ভাবেন, তখন কি সঙ্গে সঙ্গে শব্দদূষণের নেতিবাচক বিষয়গুলোর কথা ভাবেন? অধিকাংশ মানুষ (তাদের মধ্যে নগর পরিকল্পনাবিদরাও আছেন)- তাদের শহরকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার মধ্যে দূষণ বলতে স্থান দেন গাড়ির ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, জমে থাকা নোংরা কাদা-পানি, যেখানে সেখানে ফেলা আবর্জনা আর প্লাস্টিক ইত্যাদি জঞ্জালের স্তূপকে। কিন্তু বিজ্ঞান এটা প্রমাণ করেছে, শব্দদূষণ কম গুরুত্বপূর্ণ কোন হুমকি নয়। এতদিন এই দূষণকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া না হলেও এখন এটাকে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনার সময় এসেছে। কারণ শব্দদূষণ মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত, হৃদরোগ, কাজের মানের অবনতি, স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য লেখাপড়ার সমস্যা, এমনকি শ্রবণশক্তি পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। এ প্রসঙ্গে নোবেলজয়ী চিকিৎসক রবার্ট কোচ, যক্ষ্মা বিষয়ে যুগান্তকারী অবদানের জন্য ১৯১০ সালে যিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি বলেন, ‘মানুষকে একদিন শব্দ-দূষণের মোকাবেলা করতে হবে কলেরা এবং কীটপতঙ্গ ঠেকানোর মতো সমান গুরুত্বের সঙ্গে’। কিন্তু শব্দের বিরুদ্ধে লড়াই কিভাবে শুরু করবেন? ইউরোপের কোলাহলপূর্ণ শহর বার্সেলোনাতে একটি নীরব শান্ত এলাকা খুঁজে বের করা রীতিমতো কঠিন কাজ। কেমন সে শহর? এক্ষেত্রে স্থাপত্যবিদ্যা কি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন তারা কাজটা পারেন। ইংল্যান্ডের সলফোর্ড ইউনিভার্সিটির শব্দ বিষয়ক প্রকৌশলী ট্রেভর কক্স বলছেন, ‘অর‌্যাল আর্কিটেকচার হচ্ছে এমন একটি বিষয় যেখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভবনগুলো কি বলতে চাইছে, ভবনগুলোর ভেতর কি ধরনের শব্দ তৈরি হচ্ছে, আমরা কীভাবে তাতে সাড়া দিচ্ছি সেগুলো। এই ভবনগুলো মানুষ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলছে সেটা বোঝা। সর্বাধুনিক শব্দ প্রযুক্তি এবং নতুন ধরনের নির্মাণ উপকরণ কেবলমাত্র উন্নত নতুন শহর তৈরি করতে শুধু সহায়তা করবে তা নয়, বরং পুরনো ধাঁচের শহরগুলোরও মান উন্নয়ন করবে। এসব প্রযুক্তি দিয়ে বর্তমান ভবনগুলো তারা এমনভাবে বদলে দিতে পারেন যে ভবনের বাইরেটা অবাঞ্ছিত বাইরের শব্দগুলো ঠেকিয়ে রাখবে। সুনির্দিষ্ট শব্দ তরঙ্গ আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য তৈরি করে অবাঞ্ছিত শব্দকে ভবনের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে না। সাউন্ড আর্টিস্ট মাইকেল ফাওলার উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘ভবিষ্যতে বিমানবন্দরের খুব কাছে বাস করা হয়তো সম্ভব হবে। আপনি যে মুহূর্তে ভবনের কয়েক মিটারের মধ্যে পৌঁছবেন, সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরের সব শব্দ উধাও হয়ে যাবে এই প্রযুক্তির কল্যাণে।’ মিস্টার ফাওলার জার্মানিতে টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনের অডিও কমিউনিকেশন গ্রুপের একজন সদস্য এবং অর‌্যাল আর্কিটেকচার নিয়ে তার অনন্য অবদান রয়েছে। ফাঁকা জায়গাকে শব্দ দিয়ে সুন্দর করে সাজানোর ব্যাপারে তিনি খুব আগ্রহী। যেমন, জাপানি ধাঁচে বাগান তৈরি- যেখানে থাকবে শুকনো পাথুরে ঝর্না যা সত্যিকারের ঝর্ণার মতো প্রবাহিত হবে। বুদ্ধি খরচ করে চোখের আড়ালে পানির উৎস বসালে তা বিশেষ একটা দৃশ্যপট তৈরি করবে। তিনি বলেন, স্থপতিরা ভবন নির্মাণের সময় বা জনসাধারণের ব্যবহারের জায়গায় এ ধরনের ফিচার বসানোর নক্সা দিতে পারেন যা সবার জন্য একটা দূষণমুক্ত সুন্দর শব্দময় পরিবেশ তৈরি করবে। বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা বলছে, বিশ্বজুড়ে শব্দদূষণ একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা, এবং শত কোটি মানুষ বসবাস করে এমন সব এলাকায় যেখানে শব্দের তীব্রতা অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এই গবেষণা অনুসারে চীনের গুয়াংঝু শহর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শহর। অন্যদিকে সবচেয়ে কম শব্দদূষণ সুইজারল্যান্ডের জুরিখে। সবচেয়ে খারাপ মাত্রার শব্দদূষণের তালিকায় বিশ্বের যে দশটি শহর রয়েছে তার মধ্যে এশিয়ায় গুয়াংঝুর পরেই আছে- দিল্লি, মুম্বাই এবং বেইজিং। আফ্রিকায় কায়রো, ইউরোপের শহরগুলোর মধ্যে ইস্তানবুল, বার্সেলোনা এবং প্যারিস এবং লাতিন আমেরিকাতে মেক্সিকো সিটি এবং বুয়েনস আয়ার্স। যেখানে শহুরে কোলাহল থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়, সেখানে যানবাহনের শব্দকে কি সুরেলা করে তোলা সম্ভব? অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের আরএমআইটি ইউনিভার্সিটির গবেষক জর্ডান ল্যাসি এমনটাই করেছেন ২০১৬ সালে। তিনি শব্দ বদলের একটি অভিনব সরঞ্জাম তৈরি করেছেন। তিনি একটি পার্কের পাশের রাস্তার কোলাহল, যানবাহনের তীব্র আওয়াজ মাইক্রোফোনে রেকর্ড করে তার সঙ্গে মিশিয়েছেন সঙ্গীতের মূর্ছনা। তারপর সেই সুরেলা শব্দ তিনি লাউডস্পিকারের মাধ্যমে পার্ক এলাকায় বাজাচ্ছেন। ফলে আগে যারা শব্দের অত্যাচারে ঘরের দরোজা বন্ধ করে রাখতেন বারান্দায় বেরতেন না, এখন সেইসব বাসিন্দারা তাদের বারান্দায় নিশ্চিন্তে বসছেন। ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার গবেষকরাও বিশেষ আকারের জানালা তৈরি করেছেন যা চারপাশ থেকে আসা শব্দকে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে ধরবে এবং বাড়ির মালিক তার ঘরের ভেতর পছন্দের সঙ্গীত তার সঙ্গে মিশিয়ে একটা নতুন শব্দরাজ্য তৈরি করতে পারবেন। তাহলে, কোলাহলপূর্ণ শব্দকে বিরক্তি উদ্রেককারী পর্যায় থেকে আনন্দদায়ক করে তোলা যেতে পারে, কিন্তু শব্দের অত্যাচার থেকে একেবারে পালানো কি সম্ভব? স্থপতিরা আগামী দিনের শহরগুলো পরিকল্পনা করছেন এমনভাবে যাতে একটা শান্ত এবং প্রাকৃতিক শব্দ সংবলিত শহর গড়ে তোলা যায়। জর্ডান লেসি বলেন, ‘শহরের কোলাহল সম্পর্কে অভিযোগ করা সহজ, বলা সহজ যে আরও নিবিড়ভাবে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা উচিত। কিন্তু যে সমস্ত লোকের এর কাছাকাছি আসারও সুযোগ নেই তারা কী করবে?’ তিনি মনে করেন, সেসব জায়গায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে তার সাথে প্রযুক্তির মিশ্রণ ঘটিয়ে শহরে একটা শান্ত পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। যার উদ্দেশ্য হবে প্রকৃতির কাছে তাদের নিয়ে যাওয়া নয়, বরং শহরের আবহে তাদের শব্দ থেকে পালানোর সুযোগ করে দেয়া। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সিস্টেম এখানে বড় ভূমিকা রাখছে। স্থপতিরা বুঝতে শুরু করেছেন তাদের নকশা করা ফাঁকা জায়গা কী ধরনের শব্দ তৈরি করতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলে ‘অর‌্যালাইজেশন’। এটা হল ফাঁকা জায়গার মধ্যে এমনভাবে শব্দ বা ধ্বনি তৈরি করা, যা আপনাকে কোন বিশেষ পরিবেশের কথা মনে করিয়ে দেবে। বাইরের শব্দকে প্রযুক্তির মাধ্যমে এমনভাবে কৃত্রিমভাবে তৈরি শব্দের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে যা মানুষের জন্য একটা সুখের বা আনন্দের অনুভূতি তৈরি করবে।
×