ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য, নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ নেই

চিকিৎসকদের পদোন্নতি নিয়ে চলছে ভানুমতির খেলা

প্রকাশিত: ১০:২৮, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

  চিকিৎসকদের পদোন্নতি নিয়ে চলছে ভানুমতির খেলা

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ নেতিবাচক মনোভাব ও আন্তঃক্যাডার বৈষম্যসহ নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ না থাকায় চিকিৎসকদের পদোন্নতি নিয়ে চলছে ভানুমতির খেলা! ঘটছে একযাত্রায় পৃথক ফল। এসব কারণে সুবিধাবাদী চিকিৎসকরা বড় বড় সরকারী হাসপাতালে ও মেডিক্যাল কলেজে ডেপুটেশেনে পদায়ন নিয়ে সুযোগমতো পদোন্নতির আশায় পড়ে থাকছেন বছরের পর বছর ধরে। অথচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেশিরভাগ চিকিৎসকের পদ খালি পড়ে আছে। ফলে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই বিসিএস ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া কনসালটেন্ট ও সহকারী অধ্যাপক থেকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঘটছে এক যাত্রায় পৃথক ফলের ঘটনা। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ মাঠপর্যায়ে কর্মরত কনসালটেন্টসহ পদোন্নতি বঞ্চিত চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক এক কর্মকর্তা অভিযোগ করে জানান, বিএমএ ও স্বাচিপ নেতৃবৃন্দ চিকিৎসকদের পদোন্নতির বৈষম্য দূর করার বদলে ব্যস্ত বদলি বাণিজ্য নিয়ে! ফলে দীর্ঘদিনেও চিকিৎসকদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা তৈরি হয়নি। এসব কারণে চিকিৎসকদের পদোন্নতি দিচ্ছে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, আর বদলির বিষয়টি দেখভাল করছে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ! পদোন্নতির কমিটিতে বিশেষজ্ঞ না থাকায় ডিপিসির মাধ্যমে চিকিৎসকদের পদোন্নতির মানদ- নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক একাধিক কর্মকর্তা। এই ক্ষেত্রে পিএসসিকে চিকিৎসকদের পদোন্নতির জন্য অনেকটা কার্যকর বলে মনে করেন এসব কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একই ক্যাডার পদোন্নতি পান একসঙ্গে। অথচ স্বাস্থ্য ক্যাডারের ক্ষেত্রে এটি অনুপস্থিত। কেবল তাই নয়, সব ক্যাডারের মতো বিভাগীয় পরীক্ষা, ফাউন্ডেশন কোর্স ও সিনিয়র স্কেল পাস করার পরও পদোন্নতির জন্য উচ্চতর ডিগ্রীর প্রয়োজন হয় একমাত্র চিকিৎসকদের বেলায়। অথচ নিয়োগের শর্তে অতিরিক্ত যোগ্যতা থাকার বিধান স্বাস্থ্য ক্যাডার ছাড়া আর কোন ক্যাডারে নজির নেই। এটি আন্তঃক্যাডার বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। এই ধরনের বৈষম্য চিকিৎসকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে তৈরি করছে নানা বিশৃঙ্খলা। পদোন্নতির জন্য জুনিয়র কনসালটেন্ট থেকে অধ্যাপক সমমর্যাদার চিফ কনসালটেন্ট পদ সৃষ্টি এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করা গেলে স্বাস্থ্য খাতে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় থাকবে। হতাশাগ্রস্ত বঞ্চিত চিকিৎসকদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হবে। সর্বোপুরি মাঠপর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিত হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান পদোন্নতি বঞ্চিত ভুক্তভোগী চিকিৎসকরা। অবসরে যাওয়া মেডিক্যাল কলেজের একাধিক অধ্যক্ষ মনে করেন, উচ্চতর কোর্স ও ডিগ্রী অর্জনের পর স্বাস্থ্য অধিদফতরে রিপোর্ট না করে যেসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন সরকারী হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজে কাজ করছেন তাদের কনসালটেন্ট হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পোস্টিং করে দেয়া উচিত। নামকরা একাধিক অবসরপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এমবিবিএস কোর্স কারিকুলামে ছাত্রদের পড়ানোর জন্য প্রয়োজন মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, পেডিয়াট্রিক, ইএনটি, চক্ষু বিভাগের শিক্ষকের। কিন্তু দেখা গেছে এমবিবিএস কোর্স কারিকুলামের মেডিসিনের শাখা নিউরোলজি, হেমাটোলজি, হেপাটোলজি, নেফ্রলজি, গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজির, এন্ড্রো-ক্রাইনোলজি, কার্ডিওলজি, পালমোনলজি, ফিজিক্যাল মেডিসিন এবং সার্জারির শাখা ইউরোলজি, প্লাস্টিক সার্জারি, হেপাটোবিলিয়ারি সার্জারি, কলোরেকটাল, গ্লুকোমা, রেটিনা, নিউরোসার্জারি, কার্ডিয়াক, ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের শিক্ষকদের ছাত্র পড়ানোর সুযোগ নেই। অথচ নতুন নতুন মেডিক্যাল কলেজে মেডিসিন ও সার্জারির শাখার উল্লিখিত বিভাগে শিক্ষকদের পদায়ন করা হচ্ছে। এসব শিক্ষকদের ছাত্র পড়ানোসহ হাসপাতালে সেবা দেয়ার সুযোগ নেই। দেখা গেছে, বিশেষজ্ঞ ডিগ্রী অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তারা কনসালটেন্ট হিসেবে সেবা না দিয়েই সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ ডিগ্রী অর্জনের জন্য সরকার কোর্সের একটা নির্দিষ্ট সময় পড়াশুনার জন্য পূর্ণ বেতনসহ ডেপুটেশন সুবিধা দেয়। সূত্র মতে, এই ক্ষেত্রে সরকার যদি একটা নীতিমালা করে দেয় যাতে সব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক একটা নির্দিষ্ট সময় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও স্পেশালাইজড হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসেব সেবা দেয়ার পরই তার পদোন্নতি বিবেচনা করা হবে। এছাড়া যারা ইতোমধ্যে তিন থেকে পাঁচ বছর কনসালটেন্ট হিসেবে বিশেষজ্ঞের সেবা দিয়েছেন তাদের পদোন্নতি হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। তাহলে চিকিৎসকদের মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে সেবা দেয়ার মানসিকতা তৈরি হবে। বিপরীতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা পাবে যা বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপের মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ এম এ আজিজ জনকণ্ঠকে জানান, উচ্চতর কোর্স ও ডিগ্রী অর্জন করা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের কারণে চিকিৎসকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে। তবে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি। এ বিসয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মোঃ আসাদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, স্বাস্থ্য ক্যাডারকে অন্যান্য ক্যাডারের মতো বিবেচনা করায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে লেজেগোবরে অবস্থা। বিদ্যমান অবস্থায় কনসালটেন্ট ও সমমর্যাদার সহকারী অধ্যাপক থেকে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এক যাত্রায় পৃথক ফল হচ্ছে। কনসালটেন্ট থেকে পদোন্নতি পেতে সহকারী অধ্যাপক করা হচ্ছে। অথচ সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতি পেয়ে হচ্ছেন সহযোগী অধ্যাপক! সূত্র আরও জানায়, স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসকদের পদোন্নতি ৩টি ধারায় বিভক্ত। একটি বিভাগ সরাসরি স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িত, আরেকটি একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রমসহ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত, অপরটি প্রশাসনিক ধারায় যুক্ত। শুরুতে সেবার সঙ্গে যুক্ত ধারায় আছেন মেডিক্যাল অফিসার (এমও), সহকারী সার্জন, সহকারী রেজিস্ট্রার, রেজিস্ট্রার, ইনডোর মেডিক্যাল অফিসার (আইএমও) ও কনসালটেন্ট। দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসব চিকিৎসক সেবা দিয়ে আসছেন। প্রশাসনিক ধারায় যুক্ত চিকিৎসকরা টিএইচএ থেকে ডেপুটি সিভিল সার্জন, সিভিল সার্জন, সহকারী পরিচালক, উপ-পরিচালক ও পরিচালক পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। একাডেমিক ধারায় যুক্ত চিকিৎসকরা মেডিক্যাল কলেজগুলোতে প্রভাষক থেকে পদোন্নতি সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হচ্ছেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরপি) ডাঃ হরিমোহন পন্ডিতের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্মজীবনে সহকারী অধ্যাপক সমমর্যাদার কনসালটেন্ট পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক সমমর্যাদার সিনিয়র কনসালটেন্ট ও অধ্যাপক পদমর্যাদার চিফ কনসালটেন্ট হওয়ার কথা। চিফ কনসালটেন্টের কোন পদ না থাকায় একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট থেকে চিফ কনসালটেন্ট পদোন্নতি পাওয়ার কোন নজির নেই। এ ক্ষেত্রে একজন কনসালটেন্টকে পদোন্নতির জন্য ফের সমমর্যাদার সহকারী অধ্যাপক হয়ে পরবর্তী ধাপ পার হতে হচ্ছে। অথচ একই কোর্স ও ডিগ্রী অর্জনের পর কলেজ ও হাসপাতালের বাইরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবাদান ছাড়াই একজন সহকারী অধ্যাপক পরবর্তী ধাপ পার হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। পদোন্নতির এমন নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে মেডিসিন ও সার্জারি শাখার চিকিৎসকরা সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদায়ন নিয়ে বছরের পর বছর নতুন মেডিক্যাল কলেজে থাকছেন। অনেকে মাঠপর্যায়ে পোস্টিং না নিয়ে ডেপুটেশনে থাকছেন বড় বড় হাসপাতালে। মেডিক্যাল কলেজে একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম ও গবেষণাসহ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেয়ার কথা এসব অধ্যাপকদের। হাসপাতালে নামমাত্র সেবাদান আর কলেজে ছাত্র পড়ানো ছাড়া গবেষণার কোন বালাই দেখা যায় না অধ্যাপকদের। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ আনোয়ার হোসেন জানান, একাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রভাষক ও অধ্যাপকদের মূল কাজ হচ্ছে চিকিৎসক তৈরি ও গবেষণা। এসবের পাশাপাশি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছাত্রদের জন্য ক্লিনিক্যাল প্রাকটিসের মাধ্যমে রোগীদের সেবাদান করে থাকেন। কিন্তু নতুন মেডিক্যাল কলেজে এই সুযোগ নেই বললেই চলে। তারপরও মেডিসিন ও সার্জারি শাখার চিকিৎসকদের সংযুক্তিতে পোস্টিং থেমে নেই। অথচ বিশেষজ্ঞ এসব চিকিৎসকদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শূন্য পদের বিপরীতে অথবা সংযুক্তি হিসেবে কনসালটেন্ট পোস্টিং দেয়া হলে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পেত। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের প্রাক্তন মহাসচিব মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ টিটো মিঞা জনকণ্ঠকে জানান, পদোন্নতির জন্য কনসালটেন্ট হিসেবে সেবা দেয়ার বাধ্য বাধ্যকতা থাকলে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পেতেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশন-পিএসসির নীতিমালা অনুসরণ করে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড-এসএসবি ও ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি-ডিপিসির মাধ্যমে চিকিৎসকদের পদোন্নতি হলেও এই ক্ষেত্রে ডিপিসিতে কোন বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ রাখা হচ্ছে না। অথচ ডিপিসিতেই ৮০ শতাংশ পদোন্নতি হচ্ছে। বাকি ২০ শতাংশ পদোন্নতি হচ্ছে পিএসপি ও এসএসবিতে। এই ক্ষেত্রে অন্যান্য ক্যাডারের মতো কেবল ডকুমেন্ট দেখে দেয়া হচ্ছে পদোন্নতি। অথচ এর আগে পিএসসির পদোন্নতির বোর্ডে বিষয় ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ থাকার পাশাপাশি প্রার্থীকে ভাইভা ফেস করতে হতো। ডিপিসিতে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ না থাকায় বিশেষজ্ঞদের পদোন্নতির মানদ- নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, পেডিয়াট্রিক্স, চক্ষু, ইএনটি থেকে ডিগ্রী অর্জনের পর জুনিয়র কনসালটেন্ট করা হচ্ছে। অথচ নিউরো মেডিসিন কিংবা ইউরোলজিসহ মেডিসিন ও সার্জারি শাখার কাউকে জুনিয়র কনসালটেন্ট করা হচ্ছে না। শাখার চিকিৎসকদের পদায়ন করা হচ্ছে মেডিক্যাল কলেজে। এটি এক যাত্রায় পৃথক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নতুন মেডিক্যাল কলেজে একাডেমিক তেমন কোন চাপ না থাকায় এসব চিকিৎসক হাসপাতালে হাজিরা দিয়ে বাইরের প্রাইভেট প্রাকটিস নিয়েই ব্যস্ত থাকছেন। সূত্র আরও জানায়, এর আগের নীতিমালায় ছিল বিশেষজ্ঞ ডিগ্রী অর্জনের পর কমপক্ষে একটা নির্দিষ্ট সময় কনসালটেন্ট হিসেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করার পরই সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য ডাকা হবে। ৩৩তম বিসিএসে মেডিক্যাল অফিসাররা তিন বছর এবং দুর্গম রাঙ্গামাটি, বান্দারবান, খাগড়াছড়ি ও ভাঁটি অঞ্চলে কম সময় চাকরির বিধান থাকায় ওই সময় কোন কোন চিকিৎসক চেয়ে পোস্টিং নিয়েছেন। ডিগ্রী অর্জনের পর পদোন্নতির ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সময় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবাদান বাধ্যতামূলক করা হলে ৩৩তম বিসিএসের মতো চেয়ে চেয়ে পোস্টিং নেবেন বলে মনে করেন অনেকে। সার্জারি ও মেডিসিনের যে সব শাখায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পদ নেই সেখানে শূন্য পদের বিপরীতে অথবা সংযুক্তি হিসেবে পোস্টিং দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। এজন্য সরকার একটা নীতিমালা তৈরি করে দিতে পারে বলেও মনে করেন তারা। অথচ নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ না থাকায় পদোন্নতি নিয়ে তৈরি হয়েছে লেজেগোবরে অবস্থা। ২৭তম বিসিএসে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকা মেডিক্যালে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন প্লাস্টিক সার্জারির ডাঃ হেদায়েত ও প্রদীপ চন্দ্র দাস। একই বিসিএসে ইউরোলজি ও নিউরো সার্জারির একাধিক চিকিৎসক পদোন্নতি পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হয়েছেন। ১৭তম বিসিএসএ নিয়োগ পেয়ে গত ২০০৪ সালে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে সার্জারির জুনিয়র কনসালটেন্ট যোগ দিয়ে সিনিয়র কনসালটেন্ট হয়েছেন নেত্রকোণা সদর হাসপাতালের ডাঃ শফিকুর রহমান। অথচ ২১তম বিসিএস করা ডাঃ শফিকুরের ছাত্র ময়মনসিংহ মেডিক্যালের সার্জারি বিভাগের ডাঃ এহসানুর রেজা শোভন গত ২০১৩ সালে জুনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ দিয়ে হয়েছেন সহযোগী অধ্যাপক! চিফ কনসালটেন্টের পদ সৃষ্টি না হওয়ায় ডাঃ শফিকুরের এই লাইনে পদোন্নতির সুযোগ নেই। অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতির জন্য ডাঃ শফিকুর রহমানকে সিনিয়র কনসালটেন্টের সমমর্যাদার সহযোগী অধ্যাপক হয়ে পরবর্তী ধাপে যেতে হবে। আর ডাঃ শোভন সরাসরি পরবর্তী ধাপে অর্থাৎ অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ পাবেন। অধ্যাপক ডাঃ শোভনের সিনিয়র ডাঃ আবুল কালাম আজাদের ভাগ্য আরও খারাপ। তিনি এখনও রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক পদে! ময়মনসিংহ মেডিক্যালে ইএনটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডাঃ শাকের আহমেদ ও গ্যাস্ট্রো এন্টোলজির অধ্যাপক ডাঃ শাহ আলম সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে পেয়েছেন এই পদোন্নতি। অথচ গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজির সহকারী অধ্যাপক সাইফদৌল্লা বিসিএস, মেডিক্যাল কলেজের ব্যাচেও অধ্যাপক শাহ আলমের সিনিয়র। ডাঃ সাইফদৌল্লা পদোন্নতি পেয়ে ২০১১ সালে সহকারী অধ্যাপক হন। আর ডাঃ শাহ আলম সহকারী অধ্যাপক হন ২০১৪ সালে। এটি আন্তঃক্যাডার বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করছেন বঞ্চিতরা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থা ময়মনসিংহে ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে ১২টি। প্রতিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সঙ্কট। বেশিরভাগ পদই শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিসিন, সার্জারি, শিশু, ইএনটি, চর্ম ও যৌন বিষয়সহ কনসালটেন্ট পদ রয়েছে ১০ জনের। অথচ এখানে পোস্টিং আছে মাত্র তিনজনের। বাকি সাত জনের পদ খালি দীর্ঘদিন ধরে। এর চাপ সামাল দিতে মেডিক্যাল অফিসার, জরুরী মেডিক্যাল অফিসার ও আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারসহ কর্তব্যরত চিকিৎসকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডাঃ আবুল কাশেম জানান, ময়মনসিংহ বিভাগের ৩৪ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ২৮টি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে এই সঙ্কট। ৫০ শয্যার প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন করে কনসালটেন্ট থাকার কথা থাকলেও বেশিভাগ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই ২/৩ জনের বেশি নেই। বাকি পদ খালি। ডেন্টাল সার্জন নেই কোথাও। অথচ হাসপাতাল ও কলেজে ডেপুটেশনে থাকা বিশেষজ্ঞদের এসব হাসপাতালে পোস্টিং দেয়া হলে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী সেবা পেতেন বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিভাগের এই পরিচালক।
×