ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সামষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের প্রভাব

প্রকাশিত: ১২:৩১, ১৭ নভেম্বর ২০১৯

সামষ্টিক অর্থনীতিতে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের প্রভাব

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক পার হয়েছে। এ সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভাল কিছু যোগ হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি ও পুঁজিবাজারে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। অর্থবছরের এ সময়ে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রেমিটেন্স বেড়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশের বেশি। প্রথম মাসেই ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে রাজস্ব আহরণে। ঘাটতি কাটিয়ে জুলাই শেষে চলতি হিসাবেও ২৪ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হলেও কমেছে আমদানি প্রবৃদ্ধি। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই সরকারের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর বিপরীতে সঙ্কোচন ঘটেছে বেসরকারি খাতের ঋণ যোগানে। একই সময়ে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক দশমিক ২৮ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকের রফতানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ শতাংশ কমে গেছে। গত তিন মাসে উল্লেখযোগ্য পতন হয়েছে পুঁজিবাজারের সূচক ও বাজার মূলধনে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, বেশ কয়েকটি সূচকের প্রবৃদ্ধি হয় নেতিবাচক, নয়ত শ্লথ। শুধু রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধি ভাল অবস্থানে রয়েছে। ব্যাংকিং খাত থেকে বেসরকারী ঋণে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অর্থই হলো বিনিয়োগের ওপরও সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ক্যাপিটাল গুডস, ইন্ডাস্ট্রিয়াল র ম্যাটেরিয়ালের প্রবৃদ্ধিও নেতিবাচক। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের বিষয়টি তেমন প্রভাব ফেলবে না। কারণ বেসরকারী খাতে যেহেতু বিনিয়োগ হচ্ছে না, তাই ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের চাহিদাও কমেছে। একদিকে ব্যাংকগুলোর তারল্য সঙ্কট রয়েছে, অন্যদিকে ঋণের চাহিদাও কম। এ পরিস্থিতিতে সরকার ঋণ নিলে ব্যাংকগুলোর জন্য আয়ের একটা উৎস তৈরি হবে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই হোঁচট খেয়েছে রফতানি খাত। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে মোট ৯৬৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরের একই সময়ে যেখানে পণ্য রফতানি হয় ৯৯৪ কোটি ৬ লাখ ডলারের। এ হিসাবে রফতানি কমেছে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান রফতানি খাতই এ সময় খারাপ করেছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে আমাদের রফতানি বেড়ে যাওয়ার কথা। পাশাপাশি কারেন্ট এ্যাকাউন্ট ব্যালান্সও সারপ্লাস হওয়ার কথা। এর প্রভাবে অভ্যন্তরীণ ভোগও বাড়বে বলে আশা করা যায়। চ্যালেঞ্জ হবে আমদানির ক্ষেত্রে, মূলধনী যন্ত্র ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে যদি আমরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অবমূল্যায়নের দিকে যাই, তা হলে আবার মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ থাকবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে এ্যাড্রেস করতে পারে, তবে সামগ্রিকভাবে জিডিপি ও রফতানি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ভোগও বাড়ার কথা। সরকারের তরফ থেকে বাজেটের সময় কিছু অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল সঙ্কট মুহূর্তের জন্য। বিরূপ পরিস্থিতিতে সেটাও কাজে লাগানো যেতে পারে। রফতানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধাক্কা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর পড়েছে। গত দুই বছর ধরেই রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি নেই। গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২১১ কোটি ডলার। যদিও এর আগে রিজার্ভ ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল। মূল্যস্ফীতি খানিকটা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চলতি অর্থবছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর মধ্যেও রাজস্ব ও রেমিটেন্সে ভাল প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি হিসাবে ঘাটতিও কাটিয়ে ওঠা গেছে। রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ১৫ হাজার ৪৩৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এ সময় রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ছিল শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ। এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেছেন, অগ্রিম করও ভাল এসেছে। সেই সঙ্গে নতুন ভ্যাট আইনের কারণে এখানেও অগ্রিম কর এসেছে। তবে আগস্টে ছুটির কারণে রাজস্ব আহরণে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও তা সেপ্টেম্বরে কাটিয়ে উঠেছি। এ ছাড়া পদক্ষেপ হিসেবে আয়করের জরিপ করাচ্ছি। বিভিন্ন স্থানে কর্মকর্তাদের পাঠাচ্ছি। আমরা যাদের মনে করছি, যারা কর শনাক্তকরণ নম্বর পাওয়ার যোগ্য বা যারা কর দেয়ার যোগ্য কিন্তু দিচ্ছে না, তাদের কর শনাক্তকরণ নম্বর দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে এবার ভাল ফল পাওয়া যাবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রেমিটেন্সে ভাল প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ৪৫১ কোটি ৮ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ১৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশে রেমিটেন্স এসেছিল ৩৮৬ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। তবে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা এখনও বিতরণ শুরু না হলেও চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার সামান্য অবমূল্যায়নও প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর বাইরে হুন্ডি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎপরতাও বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৩ দশমিক ৯ টাকা পাওয়া যেত, যা এখন ৮৪ দশমিক ৫ টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ হাজার ৪২১ কোটি টাকা বেশি পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আমদানির তুলনায় রফতানি আয় না হওয়ায় বৈদেশিক পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বড় বড় প্রকল্পে নির্মাণের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি আমদানি করতে হচ্ছে। এতে করে আমদানি ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সেই হারে রফতানি আয় হয়নি। যার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ইপিজেডসহ রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৯৫৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে এক হাজার ৩২৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে সেপ্টেম্বর শেষে দেশে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (বিনিময় হার ৮৪ টাকা ৭৫ পয়সা দরে) দাঁড়ায় প্রায় ৩১ হাজার ৫০১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ঘাটতির এ অঙ্ক ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময় ছিল ৩৮৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এবার ঘাটতি কিছুটা কম।
×