ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সামাজিক বনায়ন

চারার গ্রাম খানাবাড়ী, ভূমিকা রাখছে পরিবেশ রক্ষায়

প্রকাশিত: ১১:০৬, ১৯ নভেম্বর ২০১৯

চারার গ্রাম খানাবাড়ী, ভূমিকা রাখছে পরিবেশ রক্ষায়

তাহমিন হক ববী ॥ ওদের হাটবাজারে গিয়ে গাছের চারা বিক্রি করতে হয় না। বৃক্ষপ্রেমী মানুষ এবং নার্সারির মালিকগণ ছুটে আসেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা সংগ্রহে নীলফামারীর ডোমার উপজেলার খানাবাড়ী গ্রামে। গ্রামটি উপজেলার হরিণচড়া ইউনিয়নে। এই গ্রামের সকল পরিবার কৃষি কাজের পাশাপাশি গাছের চারা উৎপাদন করেন। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে চারা নিতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় করে। বিভিন্ন জাতের গাছের চারা চাষ করায় খানাবাড়ী গ্রামটি গাছের চারার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই গ্রামের কছিমুদ্দিন (৬৮) ও আব্দুল মতিন (৪৫) ছাড়াও অন্যান্য পরিবারের চাষ করা নানা প্রজাতির বৃক্ষের চারা এখন স্থানীয় বাজার হয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ফসলি জমির আবাদের পাশাপাশি চারা উৎপাদনে ওই গ্রামে শতশত শ্রমিক যেন স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানের পথও খুঁজে পেয়ে গেছে। কছিমুদ্দিন জানান, চলতি বছর তিন বিঘা জমিতে চারা প্রস্তুত করা হয়েছে। বিঘা প্রতি ১২ থেকে ১৪ হাজার পর্যন্ত চারা বিক্রি করা যায়। ওই তিন বিঘায় ৪২ হাজার চারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করেন তিনি। উৎপাদিত চারা শতভাগ বিক্রি হলে অধিক লাভবান হবেন বলে আশা করেন তারা। তিনি বলেন, শ্রাবণ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত এই চারার ব্যবসা চলে। এই চার মাসে চারা উৎপাদন করা যায় চারবার। সরেজমিনে দেখা যায়, ওই গ্রামের শতাধিক পরিবার চারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। গ্রামের আব্দুল মতিন বললেন, গাছের চারা উৎপাদন একটি লাভজনক ব্যবসা। তাই অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি গাছের চারা চাষ করছি। ফসলের দাম কম-বেশি থাকলেও গাছের চারা চাষে কোন লোকসান নেই। গ্রামের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি চারা উৎপাদনের জমিতে ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছের চারার উৎপাদন করা হয়। সেখানে মাটির বেডে চারা রোপণ, বেড প্রস্তুতের কাজও চলছে। আবার কিছু কিছু চারা রোপণের জন্য জমি তৈরি করা হচ্ছে। এদিকে, উঠতি বয়সের চারাসহ জমির অন্য প্রান্তে বিক্রিযোগ্য চারাও রয়েছে। কছিমুদ্দিন জানান, তার বাড়ি ছিল কুড়িগ্রামের চিলমারীতে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদী ভাঙ্গনে বসতবাড়ি হারিয়ে ১৯৮৮ সালে পরিবার নিয়ে পথহারা পথিকে পরিণত হন তিনি। প্রথমে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ছেলেমেয়েসহ বসবাস শুরু করেন। কিন্তু সেখানে কোন কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করতে পারেননি। অভাবের কারণে সেখানে থাকতে না পেরে, কাজের সন্ধানে তিনি প্রথমে একাই চলে আসেন ডোমার উপজেলার হরিণচড়া ইউনিয়নের খানাবাড়ী গ্রামে। এই গ্রামে দিন মজুরি করতে থাকেন। এরপর পরিবার এনে বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে, ডোমার উপজেলার প্রয়াত বনবিভাগ কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার সামাজিক বনায়নের চারা উৎপাদন ও পরিচর্যার কাজে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করেন ওই গ্রামের শ্রমিকদের। দীর্ঘ পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় কছিমুদ্দিন সিদ্ধান্ত নেন নার্সারি করার। নিজের জমি জায়গা না থাকায় একবিঘা জমি ৪ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য চুক্তি নিয়ে চারা চাষ শুরু করেন। শুরু হয় তার চারা উৎপাদন। তখন থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ বসতবাড়ির জমি ক্রয় ও তিন কক্ষ বিশিষ্ট টিনশেড পাকাবাড়ি করেছেন তিনি। কছিমুদ্দিনের মতো অনেকেই এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের কর্মসংস্থানসহ অন্যদের কাজের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। বর্তমানে সেখানে শতাধিক পরিবার ওই কাজে সম্পৃক্ত। এখন আর তাদের দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য ভাবতে হয় না। শুধু কছিমুদ্দিন নয়, খানাবাড়ী গ্রামের এখন অধিকাংশ পরিবার চিলমারীর নদী ভাঙ্গনের শিকার। কছিমুদ্দিন বলেন, একটি গাছের চারা তৈরি করতে খরচ হয় আড়াই থেকে তিন টাকা। আর সেই চারা পাঁচ থেকে ছয় মাসের মাথায় বিক্রি হয় ১৫ টাকা পর্যন্ত। সার, বীজ, সেচ, পরিচর্চা ও পরিবহন খরচ বাদে ওই তিন বিঘা জমির চারা বিক্রি করে ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এক বছরে আয় করেন তিনি। একই গ্রামের বর্গাচাষী সফিয়ার রহমানের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (৩৭) বলেন, এখন আর চারা নিয়ে বাজারে যেতে হয় না। নানা প্রজাতির চারাগাছ পেতে স্থানীয় পাইকার ছাড়াও জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট, পাবনা, কুড়িগ্রাম, বগুড়া ও দিনাজপুর জেলার বড় বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ এনজিওরা ট্রাকে করে নিয়ে যান আমাদের উৎপাদিত চারা। সরকারী সহযোগিতার ব্যাপারে চারা চাষী সফিয়ার বলেন, স্থানীয় বন বিভাগের চেয়ে আমরা এখানে সব থেকে বেশি চারা উৎপাদন করি। তিনি আরও বলেন, ২০ বছর আগে নদী ভাঙ্গনে চিলমারী থেকে শুধু হাত নিয়ে এসে এই এলাকায় পরের জমিতে বসতবাড়ী করি। সংসার চলে দিন মজুরির টাকায়। তারপর এক বিঘা জমি চার হাজার টাকায় চুক্তি নিয়ে সেখানে, মেহগনি, সুপারির চারা, নারিকেল, লিচু, পেয়ারা ও লেবুর চারার নার্সারি শুরু করি। তিনি বলেন, ওই আয় থেকে এক বিঘা জমি ক্রয় করি। এখন আর পরের বাড়িতে কাজ করতে হয় না, বরং আমার চারা উৎপাদন জমি থেকে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচজন মানুষ কাজ করে সংসার চলায়। দেখা যায়, গ্রামের উর্মি বেগমের (২৫) পলিথিনের ছোট ছোট ব্যাগে হরেক রকমের চারা গজিয়েছে। এ বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, পলিথিনের প্যাকেটের চারাগুলো স্থানান্তরিত করে পাশের বেডে (অন্য জায়গায়) লাগানো হয়। বিশেষ করে দেশীয় আমের সঙ্গে বাডিং পদ্ধতিতে উন্নত জাতের আমের কলম করা হয়। এই চারার চাহিদা অনেক বেশি এবং বিক্রিও ভাল হয়। এই আমের চারা রোপণের দুই বছরের মাথায় আম ধরে। উপজেলার হরিণচড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম বলেন, এক সময় এই গ্রামের মানুষ ভাত পেত না। এখন তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে খুব ভাল আছে। চারা উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবানের পাশাপশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাও হচ্ছে। এ ব্যাপারে, নীলফামারী বনবিভাগ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ মাহবুবর রহমান বলেন, বনবিভাগের পক্ষ থেকে তাদের উৎসাহ এবং বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়। পরিবেশ সম্মত চারা উৎপাদন করে ওই এলাকার মানুষ এখন লাভবান হয়েছে। তারা এখন স্বাবলম্বী। এদিকে, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবুল কাশেম আযাদ বলেন, জেলায় ৭ হাজার ৫৩৯টি ছোট বড় নার্সারি রয়েছে। সামাজিক বনায়ন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিনি জানান, খানাবাড়ী গ্রামটি এ জেলার চারা উৎপাদনে মডেলে পরিণত হয়েছে।
×