ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুক আসক্তি

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ২১ নভেম্বর ২০১৯

ফেসবুক আসক্তি

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ফেসবুক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ফেসবুকের মাসিক সক্রিয় সদস্য দুই বিলিয়ন অর্থাৎ ২০০ কোটি। এই মাধ্যমটি ব্যবহারে যেমন উপকারিতা রয়েছে, তদ্রুপ খারাপ দিকও অনেক। আমি মনে করি শুধু মতবিনিময়, যোগাযোগ রক্ষা, তথ্য আদান-প্রদান, তথ্য প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রভূমি হিসেবে ফেসবুককে গ্রহণ করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুক আমাদের জীবনের বড় একটি সময় কেড়ে নিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে মানুষ গড়ে প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করছে প্রতিদিন ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট, ছবি আপলোড, চ্যাটিং বা হোমপেজ ব্রাউজিং করতে। আর টিনএজরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও বেশি জড়িয়ে পড়ছে। নাওয়া-খাওয়া, ঘুমের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করছে ফেসবুকে। ফেসবুক আসক্তি এখন একটা মারাত্মক নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল তরুণ প্রজন্ম একবার ফেসবুকের মধ্যে ঢুকলে আর বের হতে চায় না। এ কথা অনস্বীকার্য, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করায় বাস্তবে ইয়ং জেনারেশনে খুব একটা ক্রিয়েটিভ হচ্ছে না। ইয়ং জেনারেশনের ভেতরে ম্যাক্সিমাম ব্যবহার করে ফেসবুক চ্যাটিং করার জন্য। এটি ক্রিয়েটিভ ইউজ নয়। তরুণদের ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হতাশা থেকে শুরু করে ঘুম কম হওয়াসহ নানা অসুস্থতার জন্যও একে দায়ী করা হচ্ছে। কাজেই ফেসবুক ব্যবহারে প্রয়োজন সচেতনতা। আর শিশু কিংবা উঠতি বয়সীদের ফেসবুক ব্যবহারে প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা। দেশের অনলাইন ব্যবহারকারী ৭০ শতাংশ নারীই কোন না কোন ধরনের হয়রানির শিকার। শুধু দেশই নয়, বিশ্বজুড়ে অনলাইনে নারী হয়রানির এমন ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার নিরাপত্তা শাখার তথ্যমতে, তথ্যপ্রযুক্তি অবাধ বিচরণের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ভূমিকা রাখছে আবার এসব মাধ্যমে নারী হয়রানির ঘটনাও বাড়ছে। পুলিশের দাবি, অভিযোগকারীদের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই সাইবার নিরাপত্তা ইউনিট থেকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রতিকার করা সম্ভব হচ্ছে। অনলাইনে ব্যবহারকারীর প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরী। প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত করা হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের হয়রানি কমবে। পাশাপাশি ব্যবহারকারীদেরও নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছে টিনএজ নারীরা। এ বয়সের একটি আবেগ থাকে। এ কারণে তারা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিও তুলছে। বন্ধুরা সে সব ছবি ফেসবুক বা অন্য কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে তাকে হয়রানি বা ব্লাকমেইল করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন শিক্ষিত কর্মজীবী নারী হয়েও ফেসবুকে অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছি। সবাই জানে নারীর মন মাটির মতো নরম। এ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে অনেক অপরিচিত মানুষ কেউ ক্যান্সার, কেউ হৃদরোগসহ নানাবিধ রোগের কথা বলে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। আমি সত্যি বিশ্বাস করে অনেকের জন্যই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলাম। পরবর্তীতে জানতে পারি সব ভুয়া ছিল। এ জন্য বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে নারীদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। হয়রানির শিকার নারীদের আইনী সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া জরুরী। ফেসবুকের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এখন থেকে ছড়ানো হচ্ছে ধর্মীয় বিদ্বেষ আর বিভিন্ন গুজব। এখন পর্যন্ত দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করে যতগুলো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সবই ফেসবুক থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন পোস্টে গুজব ছড়ানো হয় শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও ছাত্রী ধর্ষণের। রাষ্ট্র ও ব্যক্তিবিরোধী বা কোন সংগঠনের বিরুদ্ধে আপত্তিকর কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার আগেই অপরাধীকে আইনের আওতায় নেয়ার মতো সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে।এবং সে কার্যক্রম চলছে। সাইবার স্পেসে আপত্তিকর কিছু দেখলে মানুষ যাতে সঙ্গে সঙ্গে তা পুলিশের নজরে আনে সে জন্য জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে সাইবার অপরাধ করে সহজে আর পার পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া ফেসবুক ব্যবহার করে প্রতিবছর অসাধু মহল, অভিনব কায়দায় মেডিক্যালসহ বিভিন্ন পাবলিক ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন, এসএসসি, এইচএসসি এমনকি জেডিসি বা জেএসসি পরীক্ষারও প্রশ্নফাঁস করে আসছে। আগ্রহীরা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন পেজে পোস্ট বা ভুয়া প্রোফাইল থেকে এ ধরনের অসাধু কাজ সম্পাদন করে থাকে। অনেক সময় প্রশ্নপত্র মিললেও বেশিরভাগ সময় ভুয়া প্রশ্নপত্র দিয়ে হাজার হাজার টাকা লুটে নেয় চক্রটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে চলছে বিকৃত যৌন চর্চা। অনেক সময় গ্রুপ পাবলিক রেখে বা ক্লোজড করে দিয়ে একটা সংঘবদ্ধ চক্র যৌনাচার করছেন। এসব গ্রুপে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মেয়ের নোংরা-নগ্ন ছবি পোস্ট করে নানা রকম মন্তব্য করতে বলা হয়। অনেক সময় গোপনে ধারণ করা ছবিও পোস্ট করা হয়। এ রকম কয়েকটি গ্রুপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাতের গভীরতা বাড়লেই এসব গ্রুপের সদস্যরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনেক সময় বিভিন্ন মেয়ের আইডি থেকে উত্তেজক ছবি পোস্ট করে ফোন নম্বর দিয়ে দেয়া হয়। অনেকে আবার প্রতি ঘণ্টা বা রাতের হিসাব করে যৌন কাজের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। গ্রুপগুলোতে এক ধরনের পোস্ট প্রায়ই দেখা যায়। যেমন- একটি স্বল্প বসনা নারীর ছবি দিয়ে বলা হয়, জামাটি খুব সুন্দর। আবার বিভিন্ন রাস্তাঘাট, শপিংমলে ঘুরতে বের হওয়া অপ্রস্তুত অবস্থায় ধারণ করা মেয়েদের ছবি পোস্ট করে বলা হয় ‘কার কার লাগবে এমন জিনিস।’ এভাবে ওই মেয়ে বা মহিলার অজান্তেই ছড়িয়ে পড়ছে ওই মেয়ের ছবি। ফেসবুকের এসব অপরাধ দমন করার জন্য পুলিশ সদর দফতর হতে দেশব্যাপী পুলিশের পৃথক ১০০টি সাইবার টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি টিমে পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরের একজন সহকারী উপমহাপরিদর্শকের (এআইজি) নেতৃত্বে এ টিমকে পরিবীক্ষণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সাইবার অপরাধ ঠেকাতে বেশকিছু উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। আরও কিছু প্রযুক্তি আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা প্রচার ও গুজব ছড়াচ্ছে এমন শতাধিক ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের এ্যাডমিনদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নেয়ার চেষ্টা চলছে। সুন্দর,পরিশীলিত মেধা, মননের জায়গা হোক ফেসবুক। ঢাকা থেকে
×