ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ২৩ নভেম্বর ২০১৯

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের স্মৃতি

২১ নবেম্বর ছিল ৪৮তম সশস্ত্রবাহিনী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন মুক্তিযুদ্ধের মাঝে স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী সমন্বয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী গঠন করা হয় এবং হানাদার পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু হয়। আমাদের সশস্ত্রবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে আন্দোলন জোরদার করে। এরপর আর বেশিদিন যুদ্ধ করতে হয়নি। যৌথবাহিনী ও দেশাভ্যন্তরে গেরিলাদের আক্রমণে কোণঠাসা হতে হতে ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী চাঁদপুরে অস্ত্র ফেলে দেয় এবং ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানীদের মিত্রবাহিনীর কাছে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সূচিত হয়। কিন্তু যে মহান নেতা বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নসাধ স্বাধীনতার প্রশ্নে জীবনের ১৩টি বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেও এতটুকু হার মানেননি, পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে অন্তত দুইবার ফাঁসিতে হত্যা করার জন্য কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছিল তারই কারাসেলের পাশে, সেই নেতা বাঙালী ও বাংলাদেশের ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে। পাকিস্তান আর্মির সারেন্ডার ও বিশ্ব বিবেকের চাপে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় স্বাধীনতা পূর্ণতা পেল। সেদিন তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে প্রথমে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ও পরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন পর্যন্ত কত মানুষ রাস্তায় নেমেছিল তা অনুমান করাও সম্ভব নয়। কেবল এটুকু বলতে পারি এত মানুষ কোনকালে কোথাও প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য পথে নেমেছে এমন নজির নেই। সেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসঙ্গী ভারতীয় সাংবাদিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেলা কণ্ঠের ধারাবিবরণী আর জনতার আবেগঘন এক অভাবনীয় আবহের সৃষ্টি করেছিল। ২১ নবেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবসে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে এক প্রীতি সম্মিলনীর আয়োজন করা হয়। ক্যান্টনমেন্টের জিওসি বা জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল আহমেদ তাবরিজ শামস এনডিসি, পিএসসির আমন্ত্রণে প্রীতি সম্মিলনীতে অংশগ্রহণ করি। মনে পড়ে একাত্তরপূর্ব এই ক্যান্টনমেন্টের সামরিক প্রশিক্ষণের কথা। বৃহত্তর কুমিল্লা নোয়াখালী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সদস্য রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। আমাদের সংসদ সদস্য ও আর্মি অফিসারদের নিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কেক কাটেন প্রধান অতিথি বীরমুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আমার জন্য অংশগ্রহণটি আবেগের। এই ক্যান্টনমেন্টেই আমি ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে UOTC (university officers training co) ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করি এবং যে ট্রেনিং আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তান আমলে পশ্চিমা মিলিটারি জান্তা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ও কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছেলেদের জন্য এই টঙঞঈ কোর্স চালু করে। তাদের টার্গেট ছিল আমাদের মতো ছাত্রদের ট্রেনিং দিয়ে একটি প্যারা মিলিটারি বাহিনী গড়ে তোলা এবং সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাদের দেয়া ট্রেনিং দিয়ে আমরা তাদেরই পরাজিত করেছিলাম। আমাদের কাছে ট্রেনিংটি লোভনীয় ছিল এজন্য যে, এই ট্রেনিং করে যদি কমিশন অফিসার হওয়া যায়। তাছাড়া একেকটি ট্রেনিং হতো দেড় মাসের। প্রথম ট্রেনিংয়ের পর জুনিয়র মিলিটারি সায়েন্স পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাওয়া যেত এবং পাস করতে পারলে ফাইনাল পরীক্ষায় ১০ নম্বর যোগ হতো। দ্বিতীয় ক্যাম্পের পর সিনিয়র মিলিটারি সায়েন্স পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাওয়া যেত। সেই ট্রেনিং হয়েছিল পরের বছর সফিপুর ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু মাসাধিককাল ট্রেনিংয়ের পর ২১ ফেব্রুয়ারি এলে আমরা বিদ্রোহ করি এবং ক্যাম্প ভেঙ্গে পাঁচ শতাধিক ছাত্র ঢাকায় ফিরে আসি। ততদিনে ৬ দফা +১১ দফার ছাত্র গণঅভ্যুত্থান সশস্ত্র বিপ্লবের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পথে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সেই UOTC ট্রেনিং দিনের ছবি চোখের সামনে ভেসে আসতে থাকল। সম্ভবত এটাকেই নস্টালজিয়া বলে। সে দিনের কথা একেক করে মনে পড়তে থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে পুরোপুরি আর্মি ড্রেস পরে কখনও হাফপ্যান্ট প্রথমে লেফট-রাইট অর্থাৎ প্যারেড, তারপর অস্ত্র চালনা, তারপর ক্লাস অর্থাৎ রীতিমতো মিলিটারি সায়েন্সের ক্লাস, বেলা একটা বেজে যেত তারপর গোসল করে দুপুরের খাবার তারপর বিকেলে খেলাধুলা অর্থাৎ ফিজিক্যাল ট্রেনিং। বলে রাখা ভাল যে মুহূর্তে টঙঞঈ -তে নাম রেজিস্ট্রি করা হলো বা ভর্তি হলো সেই মুহূর্ত থেকে সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তান আর্মির কমান্ডে। অপরাধ অবহেলা করলে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। কোর্ট মার্শাল পর্যন্ত হতো। সবচেয়ে খারাপ লাগত যখন অবাঙালী হাবিলদার-সুবেদারগুলো ভুল করলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করত। ট্রেনিং-এ আমাদের হরেক রকম অস্ত্রচালনা শেখানো হতো, যেমন রাইফেল তো অবশ্যই, সেই সঙ্গে স্টেনগান এমনকি টার্গেট দিয়ে গুলি করা পর্যন্ত, যাকে সম্ভবত আর্মি ল্যাঙ্গুয়েজে চানমারি বলা হয়। এমনকি পিস্তল থেকে এলএমজি পর্যন্ত পার্ট বাই পার্ট খুলে আলাদা করা আবার জোড়া লাগানো, ক্লাসে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার শিক্ষা, পাশাপাশি এই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পড়ানো হতো। সবটাই আকারে ইঙ্গিতে ভারতবিরোধী। এমনকি ট্রেনিং পিরিয়ডের মাঝে একদিন আর্মি ড্রেস, বুট, পিঠে হ্যাভারচেক, কোমরে পানির বোতল, কাঁধে রাইফেল এসব নিয়ে হালকা দৌড় (যদ্দুর মনে পড়ে) ১৫ থেকে ২০ মাইল ঘুরে আবার ক্যাম্পে ফিরতে হতো। ওই দেড় মাসে ওজন কতটুকু কমেছিল মেপে দেখিনি কিন্তু গা’র রং এত কালো কয়লার মতো হয়ে গিয়েছিল যে, ফিরে এসে ক্যাম্পাসে গেলে অনেকে প্রথম দেখায় চিনতে পারেনি। আমি জানি না কতজন UOTC ক্যাডেট মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। যারা নেয়নি তাদের সম্পর্কে বলার কোন মানে হয় না। যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তারা তাদের তারুণ্যের ধর্ম পালন করেছেন। স্বাধীনতার পর দ্বিতীয়বার কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে গিয়েছিলাম সম্ভবত ১৯৭৪ সালে। তখন দৈনিক ইত্তেফাকের স্টাফ রিপোর্টার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী। কয়েকজন সাংবাদিককে নেয়া হলো বঙ্গবন্ধুর নিউজ কাভারেজের জন্য কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট। আজ সব কিছু মনে নেই শুধু এটুকু মনে আছে বঙ্গবন্ধু কি একটা উদ্বোধন করেছিলেন। এবার দেখলাম মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সৈনিকদের বীরত্বগাথা যেমন সংরক্ষণ করা আছে তেমনি শহীদদের নামের তালিকাসহ গণকবরও। একটা কথা স্বীকার করতেই হবে শহীদদের আত্মত্যাগের লক্ষ্য আজ অর্জনের পথে। জাতির পিতার কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ। মানুষ ভাল আছে। বিশ্ববাসী অবাক তাকিয়ে আছে। প্রীতি সম্মিলনী শেষে ঢাকায় ফেরার পথে গাড়িতে বসে ভাবছিলাম পাকিস্তানীরা আমাদের ট্রেনিং দিয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবার জন্য, সেই ট্রেনিং নিয়েই আমরা তাদের তাড়িয়েছিলাম। ঢাকা- ২২ নবেম্বর, ২০১৯ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও এমপি সদস্য, মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি [email protected]
×