ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সেমিনারে বিশেষজ্ঞদের অভিমত

এখনকার সন্ত্রাসী জঙ্গীরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের উত্তরসূরি

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২৩ নভেম্বর ২০১৯

  এখনকার সন্ত্রাসী জঙ্গীরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের উত্তরসূরি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যার সঙ্গে বর্তমান সময়ের সন্ত্রাসী জঙ্গীদের একটি যোগসূত্র রয়েছে। আর সেটি হলো সে সময়ে গণহত্যায় পাকবাহিনীকে যারা সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছিল আজকের সন্ত্রাসী জঙ্গীরা তাদেরই অনুসারী। ক্ষমতার বৈধতার জন্য এসব গণহত্যা সন্ত্রাস জঙ্গীবাদকে সবসময় ধর্মের নামে জায়েজ করার অপচেষ্টা হয়েছে। অথচ ইসলাম কখনও এসব কর্মকান্ড অনুমোদন দেয় না। ‘১৯৭১-এর গণহত্যা, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে অনুষ্ঠানে আগত দেশ-বিদেশের প্রতিনিধিরা এ মন্তব্য করেন। তারা বলেন, ক্ষমতাসীনরা সব সময়ই নিজের অপরাধ ঢাকতে এসব গণহত্যার স্মারক চিহ্ন ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালায়। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তি দিতে এসব ঘটনা ধামাচাপা বা আড়াল করারও চেষ্টা হয়েছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে এসেও দেশের প্রায় ৩০ ভাগ লোক অপরাধীদের পক্ষে। জাতির জন্য এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে। বিশ্বে এমন কোন দেশ নেই যেখানে যুদ্ধাপরাধীরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে অথচ বাংলাদেশে সেটাও সম্ভব হয়েছে। সেমিনারে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গা সমস্যার আন্তর্জাতিক সমাধান করতে হবে। না হলে বাংলাদেশ ও আশপাশের দেশগুলো জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদে আক্রান্ত হবে। দেশে একাত্তরের মৌলবাদ এখনও যে বিদ্যমান, তা বোঝা যায় সম্প্রতি হলি আর্টিজনের হামলার মধ্য দিয়ে। একাত্তরের গণতহ্যা, হলি আর্টিজন ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার একসূত্রে গাঁথা। শুক্রবার সকালে বাংলা একডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে দ্বিতীয় দিনে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশসহ সাত দেশের প্রতিনিধিরা আলোচনা ও প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। ভারত ইতালি, তুরস্ক, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও যুক্তরাজ্য থেকে আগত ৩৪ বিশেষজ্ঞ গবেষক এতে যোগ দিয়েছেন। সকালের উদ্বেধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারবাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালী জাতি দমনে যে হীনপন্থা বেছে নিয়েছিল সেটি ছিল শেষ গণহত্যা ও দমন নির্যাতন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। গণহত্যায় সহায়তাকারী ঘাতক দালালদের এদেশে পুনর্বাসিত করা হয়। স্বাভাবিক করেছে গণহত্যা শব্দটি আড়ালে পড়ে যায়। একাত্তরের গণহত্যা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা কা হয়। যাতে ঘাতকরা সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত কম সময়ে এত মানুষ হত্যা আর হয়নি যা বাংলাদেশে ঘটেছিল। তিনি ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধকালের স্মৃতিচারতায় বলেন, একাত্তরে খুব কাছ থেকে গণহত্যা দেখেছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় একটি মাত্র উপজেলার ২০ কিমির মধ্যে সতেরোটি বধ্যভূমি রয়েছে। একটি বধ্যভূমিতে ১৬৫ জনকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়েছে, যাদের নাম ঠিকানা আমাদের কাছে রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের সুন্দরী ডোবায় শত শত মৃতদেহ আটকে থাকত। ময়মনসিংহের ডাকবাংলোয় এম এ হান্নানের নেতৃত্বে চালানো হয়েছে গণহত্যা। মূল প্রবন্ধে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, মাত্র ৯ মাসে এত অল্পসময়ে দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নজির ইতিহাসে নেই। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী ও তাদের এ দেশী দোসররা প্রায় ৩০ লাখ লোককে হত্যা করে, দুই লাখের অধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটায়। দেশের সব কারখানা রাস্তাঘাট সেতু কালভার্ট ধ্বংস করে দেয়। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে নির্বিকারে লুটপাট চালায়। এমন এক অসহনীয় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল যে এক কোটি লোক শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। অথচ এই গণহত্যা পৃথিবী ধীরে ধীরে ভুলে যেতে বসেছিল। ফলে এই অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলন কমিটির আহ্বায়ক হাশেম খান বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যে পথ চলা শুরু পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকা-ের মাধ্যমে তা স্তব্ধ করে দেয়া হয়। বিশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ আবারও পথচলা শুরু করে ধীরে ধীরে তার লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যায়। বিশ্বজুড়ে যেসব গণহত্যা হয়েছে বা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের মাধ্যমে গণহত্যার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম গণহত্যা রুখে দিতে শক্তি সঞ্চয় করবে। সম্মেলনের প্রথম দিনে পাঁচটি কর্ম অধিবেশনের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী অতিথিরা গণহত্যা বিষয়ে তার মূল্যবান প্রবন্ধও উপস্থাপন করেন। এসব কর্ম অধিবেশনে যোগ দিয়ে লেখক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী শাহরিয়ার কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান গণহত্যা চালাতে গিয়ে ইসলামকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, ঠিক তেমনি বৌদ্ধধর্মকে ব্যবহার করেছে মিয়ানমার। তাদের কাছে ধর্ম এখন দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মৌলবাদের মতো বিষয়। আর এজন্যই রোহিঙ্গাদের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং তা সমাধান না করলে বাংলাদেশেও এর গুরুতর প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের বৌদ্ধদের কাছে তাদের ধর্ম অত্যন্ত মানবতার। কিন্তু অধিকাংশ বৌদ্ধ মন্দির এখন জিহাদি মন্দিরে পরিণত হয়েছে। আমরা এখন মিয়ানমারের গণহত্যার স্বরূপ দেখতে পাই। এবারের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ ভারতে রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় নিলেও যুদ্ধশেষে তারা দেশে ফিরে এসেছে এবং সরকার তাদের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য একটি বোঝার মতো হয়ে উঠেছে। তাদের জন্য আমাদের একার পক্ষে জায়গা দেয়া সম্ভব নয়। এটি অনেকটা ‘থার্ড কান্ট্রি পজিশনের মতো হয়ে উঠেছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে হলেও তাদের পাঠানো উচিত। ’৭১ গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, হত্যা বা গণহত্যার সংখ্যা যাই হোক না কেন অপরাধীদের বিচার হতে হবে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এটার মাধ্যমে তিনি অপরাধীদের দায়মুক্তির চেষ্টা করেছেন মাত্র। কেই এর সংখ্যা কম করে বললেই অপরাধীরা দায়মুক্তি পেতে পারে না। জিয়াউর রহমান মহান স্বাধীনতার বিজয়কে যতটা সামন্যে এনেছেন। গণহত্যার বিষয়টা তিনি ততটাই আড়াল করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে দেশের আপামর জনসাধারণ অংশ নিলেও তাদের অবদান খাটো করে দেখা হয়েছে। সেনাবাহিনীকে বীরত্ব প্রধান করে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের কোন খেতাব দেয়া হয়নি। রাজনীতির কারণেই এটা করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন সুবিধাও দেয়া হয়নি। ঘাতকদের ক্ষমতা দেয়ার কারণে গণহত্যার বিষয়টি চাপা দেয়া হয়েছে। ফলে দেশে আজ মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করা হয় না। সশস্ত্র বাহিনী দিবস ঠিকই পালন করা হয়ে থাকে। জাতীয় দুর্ভাগ্য এই যে এখনও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দেশের ৩০ ভাগ লোক কথা বলেন। জামায়াত বিএনপি এবং মুক্তিযুদ্ধ একসঙ্গে চলতে পারে না উল্লেখ করেন। ভারত থেকে আগত প্রতিনিধি বিখ্যাত সাংবাদিক হিরন্ময় কার্লেকার অধিবেশনে যোগ দিয়ে বলেন, ’৭১ সালের গণহত্যার পর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কিন্তু গণহত্যার যারা সক্রিয়া সহযোগিতা দিয়েছে তারাই এই সন্ত্রাবাদ ও জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত। মুক্তিযুদ্ধে সময় রাজাকারদের দ্বারা গঠিত শান্তিবাহিনী ছিল এই নিপীড়নের হাতিয়ার। এর সঙ্গে জামায়াতের লোকেরাই বেশি জড়িত ছিল। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার মহানুববতায় ক্ষমা কললেও বঙ্গবন্ধুকে তারা মূল্য দেয়নি। অরাজকতা সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন সময়। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পর তারা রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে ভারত বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করে। মৌলবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের চেষ্টা করেছে। তাদের সেই ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তিনি বলেন, মৌলবাদীরা যে ইসলামে কথা প্রচার করে সেটা আসলে ইসলাম নয়। ইসলাম অন্য জিনিস। ইসলামে নারী মর্যাদা স্বীকৃত। অথচ তারা ধর্মের নামে লাখ লাখ মা-বোনকে নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছে। মিয়নমার থেকে আগত প্রতিনিধি খিন জ উইন বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যে সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। এই সঙ্কট যৌথভাবে মোকাবেলা করতে হবে। চরমপন্থী আন্দোলন মাদক পাচার, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ঘটনাগুলো একপাক্ষিক সমাধান সম্ভব নয়। তুরস্ক থেকে আগত প্রতিনিধি ফেরহাত আতিক বলেন, মানুষ কেন অন্যের ওপর গণহত্যা চালায়? এই প্রশ্নটি জটিল। আমাদের প্রতিটি কাজ মনে করিয়ে দেয় যে কোন গণহত্যার ঘটনায় আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। গণহত্যা এবং এতে আক্রান্তদের মনে করে আমরা বেশি মানবিক হয়ে উঠি। আমার জন্মস্থান সাইপ্রাসেও গণহত্যা হয়েছিল। পরিবারের প্রায় সকলেই এই গণহত্যায় প্রাণ হারান। এই কারণে গণহত্যা বিষয়ে জ্ঞান আহরণে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে দৌড়েছি। বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে জানা শোনা এই আগ্রহের কারণেই উল্লেখ করেন। এসব অধিবেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালযের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক ড. জয়তি শ্রীবাস্তব, ইতালির আন্না কোক্কিয়ারেল্লা ভারনতের সুস্নাত দাশ ড. উর্মি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
×