ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মুন্সীগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৬ জনসহ নিহত ৯

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২৩ নভেম্বর ২০১৯

  মুন্সীগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৬ জনসহ নিহত ৯

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, শ্রীনগর থেকে ॥ ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের ঘোলঘরে বাস ও মাইক্রোর সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে বরের পিতাসহ পরিবারের ৬ সদস্য রয়েছেন। শুক্রবার দুপুরে (পৌনে ২টা) শ্রীনগর উপজেলার উক্ত স্থানে মাওয়াগামী স্বাধীন পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে ঢাকাগামী মাইক্রোর বিকট শব্দে মুখোমুখি সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে হয়েস মাইক্রোটি একেবারে দুমড়ে মুচড়ে যায়। মাইক্রোতে থাকা ১৩ জনের নয়জনই নিহত হন। বাকি চারজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাসের সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাসেরও কমবেশি ১০ আহত হয়েছে। শ্রীনগর থানার ওসি হেদায়েতুল ইসলাম ভূঞা জানান, পার্শ্ববর্তী লৌহজং উপজেলার কনকসার থেকে বরযাত্রী বহরের মাইক্রোটি কেরানীগঞ্জের কামরাঙ্গীরচর যাচ্ছিল। পথিমধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তবে বর ছিল পেছনের মাইক্রোতে। ওসি জানান, ঘটনাস্থলেই ছয় জন নিহত হয়। শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে আরও দু’জন এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরও একজন মারা যায়। নিহতদের লাশ অনুমতি সাপেক্ষে ময়নাতদন্ত ছাড়াই সন্ধ্যায় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে দুর্ঘটনার পর প্রায় আধাঘণ্টা মহাসড়কটিতে যান চলাচল ব্যাহত হয়। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সেনা সদস্যরাও উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। মহাসড়কটির উন্নয়ন কাজের সঙ্গে সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত থাকায় দ্রুত আশপাশ থেকে ছুটে আসে সেনা সদস্যরাও। জেলা প্রশাসক মোঃ মনিরুজ্জামান তালুকদার ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম (বার) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এদিকে রেকার দিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত যান দু’টি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বাসচালক পলাতক রয়েছে। এই দুর্ঘটনার পর বরসহ বাকি বরযাত্রীরা বাড়ি ফিরে যায়। ওদিকে কনের বাড়িতেও বিয়ের আনন্দের পরিবর্তে শোকাতুর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কনে পক্ষের স্বজনরাও ছুটে আসে দুর্ঘটনাস্থলে। মর্মান্তিক এই সড়ক দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা হলো বর রুবেল ব্যাপারীর বাবা আবদুর রশিদ ব্যাপারী (৬০), বরের বোন লিজা আক্তার (২২), লিজার কন্যা তাবাসসুম আক্তার (৪), বর রুবেলের বড় ভাই সোহেলের স্ত্রী রুনা আক্তার (২২), রুনার ছেলে তাহসান (৩), বর রুবেলের মামাত বোন রানু আক্তার (১২), প্রতিবেশী কেরামত আলী (৭০), প্রতিবেশী মফিজুল ইসলাম (৬০) এবং চালক বিল্লাল হোসেন (২৮)। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশাদুজ্জামান রাতে নিশ্চিত করেছেন বর রুবেলের বড় ভাই সোহেলের স্ত্রী রুনা আক্তার চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। তার লাশও নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মোঃ মনিরুজ্জামান তালুকদার জানান, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং নিহতের পরিবারের কাছে ২০ হাজার টাকা করে তাৎক্ষণিক প্রদান করা হয়েছে। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম (বার) জানান, এ ঘটনায় শ্রীনগরের হাঁসাড়া হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে মামলার প্রক্রিয়া চলছে। এই দুর্ঘটনার প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। শ্রীনগর ফায়ারসার্ভিস স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পরপরই স্থানীয় লোকজন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মাইক্রোবাসের ভেতরে আটকে পড়া নিহত ও আহতদের উদ্ধার করে। লৌহজং উপজেলার কনকসার থেকে মুদি দোকানি রুবেল হোসেনের বরযাত্রী যাচ্ছিল কেরানীগঞ্জের কামরাঙ্গীরচর। ঘটনার পরপরই স্থানীয় লোকজন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মাইক্রোবাসের ভেতরে আটকে পড়া নিহত ও আহতদের উদ্ধার করে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মাওয়াগামী স্বাধীন এক্সপ্রেস পরিবহনের (ঢাকা মেট্রো ব- ১৪ ৮১৯৪) একটি যাত্রীবাহী বাস বেপরোয়া গতি ও ওভারটেকের কারণে ঢাকাগামী মাইক্রোবাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সময় মাইক্রোবাসটি (ঢাকা মেট্রো চ- ১৫ ৫৫৬৬) দুমড়ে মুচড়ে যায়। শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস স্টেশন সূত্রে জানা যায়, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজ করেন। হাঁসাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোঃ আব্দুল বাসেদ জানান, মাওয়াগামী স্বাধীন পরিবহনের বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঢাকাগামী মাইক্রোবাসের ওপরে গিয়ে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মাইক্রোবাসের আরোহীরা সবাই আত্মীয়-স্বজন ছিল। মাওয়া কর্মরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর কাওসার-ই-আলম বলেন, রাস্তার একপাশে কাজ চলছিল। তাই একপাশ দিয়েই দুই ধরনের গাড়ি চলছিল। এ সময় বাসটির ডান পাশের সমনের চাকা ব্লাস্ট হয়ে যায়। চাকা ব্লাস্ট হওয়ার পর বাসটি মাইক্রোটির ওপর ওঠে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বিয়ে বাড়িতে মাতম কয়েক ঘণ্টা আগেও যেখানে ছিল আনন্দ আর উৎসব। সেখানে এখন কান্নার রোল শোকের মাতম। স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদে এলাকার বাতার ভারি হয়ে উঠেছে। শুক্রবার বিকেলে লৌহজংয়ের কনকসার গ্রামে রুবেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এই দৃশ্য। বিয়ের আনন্দের পরিবর্তে বাড়িটির চারদিকে এখন শোকের ছায়া। সেখানে এখন শুধুই স্বজনদের আহাজারি। শত শত লোক ভিড় করছে। এতগুলো মানুষের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু কোনভাবেই যেন সহ্য করা যাচ্ছে না। কারো মুখে তেমন কোন কথা নেই। হাউ মাউ কান্না। স্বজনরা একে অপরকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিল। কে কাকে সান্ত¡না দেবে? সে ভাষাও যেন ছিল না কারও মাঝে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে পরিবারের সদস্যরা। এতগুলো কবর করতে হচ্ছে। সন্ধ্যার পরে ছয়টি লাশ আনা হয় রুবেলের বাড়িতে। এরপর লাশগুলো বাড়ি আসার পর এক বেদনাবিধুর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আমার সব শেষ বরের বাবা নিহত রশিদ ব্যাপারীর ভাইয়ের কন্যা রেহানা বেগমের আহাজারি যেন কিছুতেই থামছিল না। ভাতিজি রেহানা বেগম বুক চাপড়ে বলছিলেন, আমার সব শেষ। আমার কাকাকে (রশিদ বেপারি) পেয়ে বাবাকে ভুলে গেছিলাম। কাকার মধ্যেই ছিল বাবা। অহন সবই গেলোরে...। আমার বইনেরা (বোনরা) সুদ্ধা (সহ) সবাই একবারে চইলা গেলোরে...। আমরা অহন কি নিয়া বাঁচুম...। স্বজনদের এমনসব আহাজারিতে বাড়িতে উপস্থিত শত শত মানুষ হয়ে যায় নির্বাক। তাদের কারও কারও চোখেও দেখা যায় অশ্রুর রেখা। অনেকেই আবার বোবা কান্না কেঁদেছেন। নির্বাক বর রুবেল এ দুর্ঘটনার পরই বর রুবেল ব্যাপারী নির্বাক হয়ে পড়েছেন। তার মুখে কোন কথা নেই। শুধুই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। একই অবস্থা রুবেলের ভাই সোহেল ব্যাপারীর। সোহেল তার স্ত্রী ও সন্তানকে হারিয়ে নির্বাক। ফেল ফেল করে কাঁদছেন। বরের মাইক্রোতে থাকা কনকসার গ্রামের শফিকুল সিকদারের পুত্র নজরুল ইসলাম জানান, তারা দুইটি মাইক্রো নিয়ে রুবেলের বিয়ের কাবিন করতে কামরাঙ্গীরচরে যাচ্ছিলেন। তাই পেছনে থাকায় এ দুর্ঘটনায় রুবেলসহ তারা প্রাণে বেঁচে যান। তদন্ত কমিটি এদিকে এ দুর্ঘটনা কারণ খুঁজতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দীপক কুমার রায়কে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্যান্যরা হলেন- শ্রীনগরের ইউএনও, সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক, শ্রীনগর থানার ওসি, হাঁসাড়া হাইওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ এবং স্থানীয় ষোলঘর ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম। মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ মনিরুজ্জামান তালুকদার রাতে এই তথ্য দিয়ে বলেন, কমিটি আগামী সাত কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। অজানা কথা স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূলত শুক্রবার ছিল রুবেলের বিয়ের কাবিন অনুষ্ঠান। তাই বাড়িতে তেমন একটা ধুমধাম না থাকলেও পরিবারের মাঝে ছিল উৎসব আমেজ। রুবেলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল লৌহজংয়ের নওপাড়া গ্রামের মেয়ে নিশি আক্তারের সঙ্গে। কিন্তু নিশির বিয়ের বয়স এখনও হয়ে উঠেনি। অর্থাৎ নিশির বয়স ছিল ১৮ বছরের নিচে। তাই গোপনে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল নিশির এক আত্মীয়ের বাসায় ঢাকায় কেরানীগঞ্জের কামরাঙ্গীরচরে। তবে এ ব্যাপারে রুবেলের পরিবারের কোন সদস্য কথা বলতে রাজি হয়নি। বাসের চাকা ব্লাস্ট হয়ে যায় ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কটির ৮ লেনের এক্সপ্রেসওয়েসহ ৮ লেনে উন্নীত করণে কাজ চলছিল। এক পাশে উন্নয়নমূলক কাজ চলমান থাকায় পূর্বপাশ দিয়ে উভয়মুখী যান আসা যাওয়া করছিল। ধারণা করা হচ্ছিল যান দুটিই অন্তত ৭০/৮০ কিলোমিটার বেগে চলছিল। যেহেতু এই লেনে উভয়মুখী গাড়ি চলাচল করছে, সেখানে এমন বেশি গতিই বিপদ ডেকে আনে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাদ দিয়ে মাওয়া ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ঘটনাস্থল পরিদর্শ করে বলেন, দুর্ঘটনার আগেই স্বাধীন পরিবহনের বাসটির সামনের ডান দিকের চাকা ব্লাস্ট হয়ে যায়। এতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা মাইক্রোর সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। মাইক্রোটিতে বসার ব্যবস্থা ছিল চালকসহ ১১ জনের। সেখানে ছিল ১৩ জন। এতে মাইক্রোটির প্রায় পুরো অংশই বিধস্ত হয়। আর বাসের সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে কারও কারও ধারণা বেপরোয়া গতির কারণেই এই দুর্ঘটনা। সামনের চাকাটি দুর্ঘটনার পরেও পাঞ্চার হতে পারে। তবে ঢাকার মীরপুরের ১০ নম্বর থেকে মাওয়ার শিমুলিয়ায় চলাচলকারী এই স্বাধীন এক্সপ্রেসের বাসের ফিটনেস এবং চালকের দায়িত্বশীলতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত চালকের পরিচয় জানা যায়নি। তবে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, বাসের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে চালকও আহত। হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি চলছে। তবে পরিবহন কর্তৃপক্ষের কোন বক্তব্য এখনও পাওয়া যায়নি।
×