নিজস্ব সংবাদদাতা, কেশবপুর ॥ কেশবপুরের মেধাবী ছাত্রী ও জাতীয় মহিলা হকি দলের সদস্য মুক্তা খাতুন। অচপাড়া গ্রামের দরিদ্র অসহায় পরিবার থেকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেকে একজন জাতীয় হকি দলের খেলোয়াড় তৈরী করেছেন। পিতৃহারা ও পরের বাড়ি ঝি এর কাজ করা মায়ের কন্যা মুক্তা নানা প্রতিকুলতার সাথে লড়াই করে দেশ থেকে বিদেশে হকি খেলায় নিজেকে স্থান করে নিয়েছেন। সেই ছোট বেলার মুক্তা আংঙ্গিনার বেড়া পেরিয়ে হাটিহাটি পায়ে এগিয়ে চলেছেন দেশ থেকে বিদেশে। ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে সবকিছুই জয় করা সম্ভব তা প্রমান করে এগিয়ে যাচ্ছেন মুক্ত খাতুন। মাত্র এক বছর বয়সে পিতৃহারা কেশবপুরের ঈমারনগর গ্রামের অসহায় দরিদ্র মুক্তা শত বাঁধা অতিক্রম করে কিভাবে সাফল্যতা অর্জন করেছেন তার বর্ননা করেছেন জনকন্ঠের সাথে।
দারিদ্রতার কষাঘাতে দীর্ঘ পথ চলার গল্প বর্ননা করতে মুক্তা খাতুন বলেন, মাত্র এগারো বছর বয়সে আমার বাবার ঘরে বৌ হয়ে আসেন আমার মা সখিনা বেগম। মাত্র ছয় বছর পর আমার বাবা নিছার গাজী আমার তিন বছরের ভাই এবং আমাকে রেখে ইহকাল ত্যাগ করেন। তখন আমার বয়স মাত্র এক বছর। আমাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় সহায়-সম্পদ সব কিছুর বিনিময়েও বাবাকে বাচাঁনো সম্ভব হয়নি। সহায়-সম্বলহীন ষোড়শী বিধবা সখিনার কাঁধে চেপে বসে দুই এতিমের লালন-পালনের ভার। অসহায় মাতা ঝাঁপিয়ে পড়লেন জীবন যুদ্ধে। নিরুপায় হয়ে মা শুরু করলেন পরের বাড়ীতে ঝি এর কাজ করা। সকালে ঘুম থেকে উঠে দুই সন্তানের মুখে যেনতেন কিছু তুলে দিয়ে বের হতেন কাজের সন্ধানে আর ফিরতেন প্রায় সন্ধ্যায়। এভাবে চলতে থাকলো আমাদের জীবনযাত্রা।
আমার মা দিনে ১৫ (পনের টাকা) রোজগার করে বাবার চিকিৎসার বকেয়া ঋণ পরিশোধ আর দুটি সন্তানের ভরন-পোষন ও লেখা-পড়া চালিয়ে যাওয়া যে কত কষ্টসাধ্য তা একমাত্র জানেন আমার অসহায় সম্বলহীন মা। ইতোমধ্যে একমাত্র ভাই ৭ম শ্রেণীতে উন্নীত হলো। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। অর্থভাবে ভাইয়ার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ৭ম শ্রেণী হতে ঝরে পড়া বালক শুরু করে পরের বাড়ীতে মুজুরের কাজ করা। মা ও ভাইয়ার স্বপ্ন ছিল আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করবেন। মানুষের মতো মানুষ বানাবেন।
পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর আমি ভর্তি হই আমাদের এলাকার গড়ভাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। যখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি তখন সমাজের কুসংস্কারের কাছে আমার মা ও ভাইয়ার লালিত স্বপ্ন হার মেনে যায়। আমাকে বিয়ের পিড়িতে বসানোর বন্দোবস্ত করা হয়। বিয়েতে রাজী না থাকার কারনে আমি স্কুল শিক্ষকদের বিশেষ করে আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং শহীদুল স্যারের সহায়তায় ২/৩ বার আমার বিয়ের আসর নষ্ট করতে থাকি। গ্রামের লোকেরা মা ও ভাইয়াকে বলতো গরীবের মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে লাভ কি ? চাকরি হবে না। আবার বয়স বেশী হলে বিয়ে দিতে সমস্যা হবে। সমাজের মানুষের এমন কানপড়া শুনে মা ও ভাইয়া এক পর্যায়ে আমার লেখাপড়ার খরচ বন্ধ করে দেন। তখন বটবৃক্ষের ছায়ার মতো আমার পাশে এসে দাঁড়ান আমার শিক্ষক মোঃ শহীদুল ইসলাম। তিনি সারাক্ষন আমার পাশে থেকে বাবার মত আগলে রেখেছেন আজ পর্যন্ত।
আমার খেলোয়াড়ী জীবনের হাতেখড়িও ওই শহীদুল স্যারের হাত দিয়েই। আমি ৭ম শ্রেণী থেকে খেলা শুরু করি। প্রথম থেকেই আমি খেলায় সুনাম করতে থাকি। স্যার আমার সকল খরচ দিয়ে আসছেন। স্যার কোন প্রকার কার্পণ্য করেননি আমার পিছনে খরচ করতে। নিজের পকেটের টাকা পর্যন্ত খরচ করে আমাকে দেশের এমন কোন জেলা বা বিভাগ নাই যেখানে খেলার উদ্দেশ্যে আমাকে নিয়ে যাননি। আমার জীবনের অগনিত সমস্যার মধ্যে ছোট একটি বাঁধার কথা বলি, যখন আমি ৮ম শ্রেণীতে পড়ি তখন একটি খেলায় আমার দল ফাইনালে উঠলো। কিন্তু আমার মা ও চাচারা মিলে খেলার দিন আমাকে ঘরে তালা দিয়ে আটকিয়ে রেখে দিলো। পরবর্তীতে আমার শিক্ষকরা মোকাবেলা করে বের করে নিয়ে যান। বার বার বিয়ে বন্ধ করাসহ সর্বক্ষণ উৎসাহ আর অভয় দিয়ে স্যারেরা বলে আসছেন, আমরা তোমার সাথে আছি।
আমি ৮ম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে ১ম বার জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা পার্যায়ে লৌহ গোলক নিক্ষেপে রৌপ্য পদক অর্জন করি। পরবর্তীতে লৌহ গোলকে স্বর্ন পদক, চাকতি নিক্ষেপে রৌপ্য পদক, জ্যাবলিন নিক্ষেপে রৌপ্য পদক, জুনিয়র কুস্তিতে স্বর্ণ পদকসহ একাধিক ব্যক্তিগত পদক অর্জনের পাশাপাশি দলীয় খেলাতে ও আমার অবস্থান ছিল খুবই ভাল। আমরা গড়ভাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, কাবাডি এবং হকি খেলায় কয়েকবার জেলা চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি। গড়ভাঙ্গা বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই অধিকাংশ দলীয় খেলার ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করেছি। আমি মনে করি আমার সময়ে বিদ্যালয়টি খেলার একটি সোনালী অধ্যায় রচিত হয়েছিল। যা এখন ও পর্যন্ত চলমান রয়েছে। হাটি হাটি পা পা করে বর্তমানে আমি বাংলাদেশ মহিলা হকি দলের সেরা এগারোর একজন সদস্য। আমাদের দলটি এ বছর (২০১৯ সালে) দক্ষিণ এশিয়া মহিলা হকি প্রতিযোগিতায় সিঙ্গাপুর ভ্রমন করে এলো।
জাতীয় হকি দলের সদস্য মুক্তা আরও বলেন, আমি ২০১৯ সালে এইচ এস সি পরীক্ষায় কেশবপুর কলেজ থেকে উর্ত্তীণ হয়ে আমার সখ অনুয়ায়ী যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালে Sporsts Science বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়েছি। আমার পৈত্রিক ভিটা কেশবপুর উপজেলার ইমাননগর গ্রামে। আমার বাড়ি মাত্র ০৫ (পাঁচ) শতাংশ জমির উপর জীর্ণ একটি মাটির ঘর। আমার একমাত্র ভাই স্থানীয় একটি আইসক্রীম কাঠি ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। মা এখানো পরের বাড়ীতেই কাজ করার বোঝা মাথার উপর থেকে সরাতে পারেননি। এমন পরিস্থিতিতে আমি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। যেদিন ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল সেদিন রাড়ীতে ফেরার মতো পর্যাপ্ত টাকাও আমার কাছে ছিল না। এরকম অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যেই আমাকে চলতে হয়।
মুক্তা বলেন, প্রথম থেকেই আমি দারিদ্রতার সাথে লড়াই করেই চলে আসছি। তবে কখনই সাহস হারায়নি। ইচ্ছেশক্তিটাই আসল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার কোন টাকাই আমার কাছে ছিল না। টাকার পরিমানও খুব বেশি। ভর্তি হতে ১৮ হাজার টাকার প্রয়োজন। কোথায় পারো এতো টাকা। কোনভাবেই টাকা যোগাড় করতে পারলাম না। তখন অটুট মনোবল ও দৃড়প্রত্যয়ে সাহস করে ২৮ শে নভেম্বর/১৯ আমার কাছে দেবতাতুল্য মহামানব কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব মোঃ মিজানূর রহমানের কাছে গিয়ে ভর্তির জন্য ১৮ হাজার টাকা চাই। তিনি আমাকে সন্তুষ্টচিত্তে আশ্বস্ত করলেন এবং ৩০ নবেম্বর আমার প্রধান শিক্ষককে ফোন করে আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে নগদ ১৮ হাজার টাকা প্রদান করেছেন। তিনি কেশবপুরে আসার পর থেকে আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাঁর হাত ধরে বহুবার সাবেক জনপ্রাসন প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান কেশবপুরের সংসদ সদস্য ইসমাত আরা সাদেক মহোদয়ের কাছ থেকে অনেকবার পুরস্কার গ্রহন করেছি। আমার মতো পিতৃহারা এতিম সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই দয়ালু উপজেলা নির্বাহী অফিসার খুব চেষ্টা করেছেন। তাঁর ঋন কোনদিন শোধ করতে পারবো না।
দেশবাসীর নিকট মুক্তা দোয়া ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বলেন, আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষক মন্ডলী ও আমার সকল পর্যায়ের হিতাকাঙ্খীদের নিকট আমি চিরঋণী ও চিরকৃতজ্ঞ। খেলাধুলায় উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য যে সকল ক্রীড়া কর্মকর্তা ও ক্রীড়াবিদরা আমাকে সরাসরি সহযোগিতা করেছেন তাদের মধ্যে সাবেক জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা খান মোঃ মকসুদুর রহমান, যশোরের হাসান রনি, নড়াইলের শান্ত স্যার, রজিবুল স্যার ও ক্রীড়া পরিদপ্তরের তারিকুজ্জামান নান্নু স্যারের নাম বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য। আমি তাঁদের সকলের নিকট ঋণী। অতীতের মতো আগামী দিনগুলো যদি এই ধরনের দয়ালু ব্যক্তিগণ আমার পাশে থাকেন তাহলে আমি আমার লক্ষে পৌছে যেতে পারব।
কেশবপুরের গর্ব মুক্তার ব্যাপারে কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মিজানূর রহমান জানান, মুক্তা কেশবপুর তথা বাংলাদেশের গর্ব। সে জাতীয় মহিলা হকি দলের সদস্য হয়ে বিদেশে খেলা করছে। দেশের মধ্যে অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছে। মুক্তার মতো অনেক অসহায় ও মেধাবী ছাত্রছাত্রী আমাদের চারপাশে রয়েছে। আমরা যদি তাদের খুজে বের করে সঠিক নির্দেশনা ও সহযোগিতা করতে পারি তাহলে মুক্তার মতো অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র তৈরী করতে পারি। আমি সব সময় এদের পাশে থাকবো। সমাজের সকলকে মুক্তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে মুক্তার বিশ্বজয় অবশ্যম্ভাবী।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: