ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

বিজয়ের মাসে এক নজরে...

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯

বিজয়ের মাসে এক নজরে...

যাদের লালন-পালন-পরিচর্যায় তালেবানের জন্ম ও বিকাশ, শেষ পর্যন্ত তাদের সন্তানদের ওপরও নৃশংসতা চলেছে। কি অবলীলায় এক শ’ বত্রিশটি কচি প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল সন্ত্রাসীরা! কোন অনুশোচনা নেই, বরং আবার হুমকি এসেছিলÑ প্রধানমন্ত্রীসহ রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানদেরও হত্যা করা হতে পারে। এই তো সেদিনের কথা। আগুন নিয়ে খেলেছিল পাকিস্তান। প্রথমে আফগান মুজাহেদীন, পরে তালেবান গড়াপেটার কাজ সানন্দে ঘাড়ে নিয়ে জেনারেল শাসক জিয়াউল হক যে কর্মযজ্ঞের পালে হাওয়া লাগিয়েছিলেন তার পরিণাম যে এমনও হতে পারে তা সম্ভবত তার ভাবনাতেও ছিল না। আফগানিস্তানে মুজাহেদীনকে যুক্তরাষ্ট্রের লড়াকু সৈনিক হিসেবে দেখে তিনি তখন প্রীত। সত্তর দশকের শেষ দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হলে ব্যথানাশক বটিকা সরবরাহে কালক্রমে সদলবলে এগিয়ে আসেন জিয়াউল হক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সামরিক শাসকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যে চমৎকার দাওয়াই উৎপন্ন হলো তার ব্র্যান্ড নেম ইসলামী মুজাহেদীন। ততদিনে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আফগানিস্তানকে সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত করতে ডেডিকেটেড এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক-মতাদর্শিক প্রতিহিংসাকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আফগান ইস্যু কেন্দ্র করে ধর্মীয় উন্মাদনার জোয়ার বইয়ে দিল ‘মুক্তিযোদ্ধারা।’ এ নিয়ে আশির দশকে এ অঞ্চলে ইসলাম পন্থীদের যে মাখো মাখো সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাতে মসলা সরবরাহের অন্যতম ভূমিকা ছিল জেনারেল জিয়াউল হকের। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সংগ্রহ করার আন্তর্জাতিক আওয়াজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সময় ইসলামী জঙ্গী গ্রুপ গড়ে ওঠে জিয়াউল হকের সময় থেকে পাকিস্তানীমনা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা সেই যে যুক্তরাষ্ট্রের পকেটে ঢুকেছিল তারপর থেকে তাদের ইচ্ছাতেই উঠবস করেছে। আফগানিস্তানে মুজাহেদীন ও তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠা করার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে আবার তাদের উচ্ছেদেও ব্যবহার হয়েছে। ভারত ভাগের পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য সখ্য গড়ে উঠেছিল মূলত ওই অঞ্চলে সমাজতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে। ইরান ও তুরস্কও সহায়ক ছিল। একের পর এক সামরিক চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সামরিকীকরণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। তারপর ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত ইস্যু বা কাশ্মীর ইস্যু, মুজাহেদীনের জেহাদ বা উচ্ছেদ ইস্যুÑ সব কিছুতেই ব্যবহার হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান, আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠায় মার্কিনীদের মাথাব্যথার মূল কারণ ছিল আফগানিস্তানসহ আশপাশের এলাকায় সোভিয়েত প্রভাবের ভীতি। নতুন সরকারের সংস্কারমুখী নানান উদ্যোগ যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি ব্যবস্থাপনা, মালিকানা, আইন ইত্যাদি পুরনো ক্ষমতার নতুন বিন্যাসের উদ্যোগে ভয় পেয়েছিল মার্কিনীরা। কারণ এতে শুধু আফগানিস্তান নয়, এ গোটা অঞ্চলে তাদের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠবে। পাকিস্তানের ওপর ভর করে এগিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করছে তারা। কিন্তু পাকিস্তান কি পেল? জন্ম থেকে অপ্রকৃতিস্থ এ রাষ্ট্রের খুঁড়িয়ে হাঁটার হিম যুগ আর শেষ হয় না। করুণা করার যোগ্যতা হারাচ্ছে পাকিস্তান। সাতচল্লিশে ভাগ হওয়া অন্য রাষ্ট্র ভারতকে পকেটে পুরতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্ক তখন যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ। কিন্তু সোভিয়েতের পকেটস্থও ভারতকে হতে হয়নি, পাকিস্তান যেমন ষাষ্টাঙ্গে নতজানু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত ভৃত্য হয়েছে। এর অন্যতম কারণ ভারতের নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ভারতের নিজস্ব শিল্প ভিত্তি বুর্জোয়া অর্থনৈতিক কাঠামো ইত্যাদি ভারতকে মেরুদ- সোজা রাখতে ভূমিকা রেখেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিনী একক আধিপত্যেও তাই ভারতকে গ্রাস করতে পারেনি। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফের কাছে মাথা বিক্রি করতে হয়নি। তবে বিশ্ব পুঁজির নতুন বিন্যাসে গত শতকের নব্বই দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে ভিন্ন মাত্রা সংযোজিত হয়। এত বছরে এ সম্পর্কের হিসাব নিকাশ এগিয়েছে পুঁজির সম্পর্ক সূত্র ধরে। আজকের নরেন্দ্র মোদির ভারত নয়া উদারবাদী পুঁজির দৃশ্যমান প্রতিমা। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের আজন্ম স্বপ্ন। হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এলেও মোদির পক্ষে যে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা কতটা সহজ হচ্ছে তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি ভারতে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া কঠিন। পাক-মার্কিন যৌথ উদ্যোগে আশির দশকের সেই আন্তর্জাতিক জঙ্গীয়ায়ন প্রক্রিয়ারকালে আমাদের দেশও সামরিক শাসকের খপ্পরে। সামরিক শাসনের সহযোগী হয়েই জঙ্গীবাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভর করে। একাত্তরে যারা ধর্মের নামে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন চালিয়েছিল তারা সামরিক শাসকের সময়ই রাষ্ট্র ক্ষমতার কাছাকাছি আসে এবং রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে তাদের সাংগঠনিক শক্তি দ্রুত বাড়ে। মাদ্রাসা শিক্ষকদের চাঁদা আত্মসাত করা মাওলানা মান্নান এরশাদের সময় মন্ত্রিত্ব পান। দু’হাজার এক-এ রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে এল একাত্তরে এদেশ জন্মের বিরোধিতা করেছিল যারা সেই ঘৃণিত রাজাকার, আলবদরদের প্রতিনিধিরা। সরকারী প্রশাসনে তাদের ব্যাপক প্রভাব এদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে এনেছিল। বাংলাভাইয়ের উত্থান জেএমবির মতো সংগঠন এ সময় সরবে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। আফগান মুজাহেদীনের ডাকে সাড়া দিয়েছিল এদেশের অনেক তরুণ। শোনা যায় আইএসের ডাকেও সাড়া দিচ্ছেন অনেকে। আমাদের এখানে ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক খেলা হয়েছে, হচ্ছে। যে শক্তি পাকিস্তান রাষ্ট্রের ওপর ভর করে আছে যেন ওভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ভর করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
×