ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ॥ ঢাকার আকাশে মিত্রবাহিনী

প্রকাশিত: ১১:৩৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৯

৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ॥ ঢাকার আকাশে মিত্রবাহিনী

১৯৭১ সালের ০৫ ডিসেম্বর দিনটি ছিল রবিবার। সর্বাত্মক লড়াইয়ের তৃতীয় দিনেই স্বাধীন বাংলার আকাশ শত্রুমুক্ত হয়। মিত্রশক্তির বিমানবাহিনী ঢাকার আকাশ পুরোপুরি দখল করে নেয়। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর প্রায় সব বিমান বিধ্বস্ত। সারাদিন ধরে ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলো অবাধে আকাশে উড়ে পাক সামরিক ঘাঁটিগুলোতে প্রচ- আক্রমণ চালায়। অকেজো করে দেয় বিমান বন্দরগুলো। ভারতের বিমানবাহিনীর হিসাব মতে বারো ঘণ্টায় দুশ’ বত্রিশবারে তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাটিতে পঞ্চাশ টনের মতো বিস্ফোরক নিক্ষেপ করা হয়েছে। পাকবাহিনীর কনভয়ের ওপর ভারতীয় জঙ্গী বিমানগুলোর আক্রমণে নব্বইটি গাড়ি ধ্বংস হয়। এছাড়াও পাকবাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়েকটি লঞ্চ এবং স্টীমারও ধ্বংস হয়। সাবমেরিন গাজী পাক নৌবহরের গর্বের বস্তু। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথকমান্ডের সফল আক্রমণে তা ধ্বংস হয়। সাবমেরিনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তান ধার হিসেবে পেয়েছিল। নৌবাহিনীর যৌথ কমান্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সব নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে বন্দর ত্যাগের পরামর্শ দেয়। তারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতেও অপারগতা প্রকাশ করে। প্রধান হুঁশিয়ারিটি ছিল চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে। বলা হয়, আপনারা সবাই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে চলে যান। আপনাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমরা শনিবার তেমন বোমা বর্ষণ করিনি। আজ আপনাদের বের হয়ে আসার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কাল আমরা প্রচ-ভাবে আক্রমণ চালাব। সুতরাং কাল থেকে আপনাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারব না। এ সতর্ক বাণীতে দুটি কাজ হলোÑবিশ্বের সব দেশ বুঝল বাংলাদেশের বন্দরগুলো রক্ষা করার কোন ক্ষমতা আর পাক বাহিনীর নেই। ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ ও বিমানগুলো সব বন্দরকে ঘায়েল করার সুযোগ পেল। মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসতে থাকে। পাক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। প্রধান সড়ক দিয়ে না এগিয়েও মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কের কতগুলো এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি করে। ফলে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের, নাটোরের সঙ্গে ঢাকা ও রংপুরের এবং যশোরের সঙ্গে নাটোর ও রাজশাহীর যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু ঢাকার সঙ্গে যশোর ও খুলনার যোগাযোগ ব্যবস্থা তখনও অব্যাহত ছিল। কতগুলো ঘাটিতে সেদিনও লড়াই হয়। একটি বড় লড়াই হয় লাকসামে। আরেকটি লড়াই হয় ঝিনাইদহের কাছে কোটচাঁদপুরে। দুটি লড়াইয়ে পাক বাহিনী ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়। এর ফলে বিধ্বস্ত অবস্থায় তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এখানে পাকবাহিনী মিত্র বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহী আমির হোসেন, লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামান, সিপাহী রুহুল আমীন, সিপাহী সাহাব উদ্দীন, সিপাহী মুস্তাফিজুর রহমান শহীদ হন। আখাউড়া মুক্ত হওয়ার পর কিছু পাকসৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং ১৬০ জন মিত্রবাহিনীর হাতে নিহত হয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সিলেট সেক্টরে বোমাবর্ষণ করে শত্রুর পাঁচটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়। জামালপুরে বিমান হামলায় হানাদার বাহিনীর কয়েকশ’ সৈন্য নিহত হয়। বিধ্বস্ত হয় বহু সামরিক যানবাহন। এদিন চট্টগ্রামে পাকিস্তান নৌবাহিনী ও যৌথ নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলোর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। বখশীগঞ্জে যৌথ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। মুক্ত হয় পীরগঞ্জ, হাতিবান্ধা, পঞ্চগড়, বোদা, ফুলবাড়ী, বীরগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ। আর জীবননগর, দর্শনা ও কোটচাঁদপুরে পাক হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চলমান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বন্দরনগরী করাচিতে ভারতিয় নৌবাহিনী একটি অপারেশন পরিচালনা করে, যা ইতিহাসে অপারেশন ট্রাইডেন্ট নামে পরিচিত। আর এই অপারেশন ট্রাইডেন্টের যুদ্ধে এই অঞ্চলের মানুষ প্রথমবারের মতো এন্টি জাহাজ মিসাইল (মিসাইল প্রতিরোধক জাহাজ) এর ব্যবহার দেখতে পেয়েছিল। এই অপারেশনটি ১৯৭১ সালের ৪-৫ ডিসেম্বরে গভীর রাতে পরিচালনা করা হয়েছিল। যার ফলে সে অপারেশনের কারণে পাকিস্তানের জাহাজের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। জাতিসংঘে বাংলাদেশকে নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। এদিকে বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন সরকারের বিশেষ উদ্যোগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন বসে। এতে যুদ্ধ বিরতির জন্য মার্কিন প্রতিনিধি সিনিয়র বুশের চেষ্টায় সোভিয়েত প্রতিনিধি কমরেড মালিক ‘ভেটো’ প্রয়োগ করেন। ‘ভেটো’ প্রয়োগের পূর্বে কমরেড মালিক বলেন, ‘পাক সামরিক জান্তার নিষ্ঠুর কার্যকলাপের ফলেই পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে।’ একই সময়ে এক বিবৃতিতে সোভিয়েত সরকার ‘পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানান। এই সংঘর্ষ সোভিয়েত সীমান্তের সন্নিকটে সংঘটিত হওয়ায় এর সঙ্গে সোভিয়েত নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, বলে উল্লেখ করে এবং পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের যে কোনটির সঙ্গে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান। মূলত বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াইটা ছিল দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে আর যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিষদে তৃতীয় প্রস্তাবটি পেশ করে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান। এদিকে জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধিরা বলেন, কোন শর্ত ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত অবস্থা চিন্তিত করে তোলে প্রবাসী সরকারকে। কারণ তখনও ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব শ্রী কেবি লাল ‘বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা বলে’ উল্লেখ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া শুধু সময়ের ব্যাপার বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন। রাজনৈতিক এ পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের যাতে দুর্বল না করে তোলে তাই মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন। এটি উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের নেতাদের উদ্বাস্তু সমস্যার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে তার দেশের অবস্থা তুলে ধরেন। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, গত ১৮ ঘণ্টায় তিনটি মিরাজ এবং দুটি এফ-১০৪ স্টার ফাইটারসহ ৩৩টি পাকিস্তানী বিমান ভূপাতিত অথবা ধ্বংস করা হয়েছে। গত রাতে ভারতীয় বিমান ঘাটিগুলির ওপর বিনা প্ররোচনায় পাকিস্তানের নির্লজ্জ আকস্মিক আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনী গতকাল মধ্য রাত থেকে আক্রমণ শুরু করেছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী প্রায় খতম হয়েছে। আর দুই-তিনটি বিমান সম্ভবত অক্ষত আছে। সেনগুপ্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, যুদ্ধের প্রথম দিনই ভারতীয় সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী বাংলাদেশের দখলদার পাক বাহিনীর ওপর প্রচ- আক্রমণ চালিয়েছে। চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগোচ্ছে। চূড়ান্ত লক্ষ্য ঢাকা দখল এবং পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। প্রথম দিনের প্রাথমিক ধাক্কাতেই বিভিন্ন সেক্টরে পাক বাহিনী বিপর্যস্ত। বাংলাদেশে পাক বিমান বাহিনীর অর্ধেকের বেশি বিধ্বস্ত এবং জলপথে তারা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। সর্বত্র ভারতীয় বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে এসেছে বীর মুক্তিবাহিনী। এই খবর যখন আপনি পড়ছেন ততক্ষণে পূর্ব বাংলার শত শত বর্গমাইল এলাকা থেকে পাক সেনাবাহিনী বিতাড়িত। আনন্দবাজার পত্রিকা পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার বরাত দিয়ে লেখে, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় বাহিনীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা সাংবাদিকদের বলেছেন, পূর্ববঙ্গ দখল করা ভারতীয় বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। এ সম্পর্কে আমার সরকারের নীতি খুবই পরিষ্কার। সরকার চায়, বাংলাদেশে যথার্থ জনপ্রতিনিধিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক। পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণার অব্যবহিত পরেই পূর্ব খ-ে ভারতীয় জওয়ানরা দুর্বারগতিতে পাকিস্তানী সেনাদের আঘাত দিয়ে চলেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যের মধ্যে ভারতীয় জওয়ানরা স্থলে, জলে ও অন্তরীক্ষে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে চলেছে বলে প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন জানান। দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত ‘নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ভেটো’ শিরোনামের সংবাদ থেকে জানা যায়, নিরাপত্তা পরিষদ আমেরিকা, ভারত ও পাকিস্তানের উদ্দেশে অস্ত্রসংবরণ ও সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে যে প্রস্তাব তুলেছিল, রাশিয়া তাতে ভেটো প্রয়োগ করেছে। পক্ষান্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং বাংলাদেশে পাক সেনাদের হত্যাকা- বন্ধ করা হোক। কারণ এইটাই মূল বিরোধের উৎস এবং এগুলো বন্ধ হলেই বর্তমান সংঘর্ষের অবসান ঘটবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×