ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সাজু আহমেদ

নাগরিকের ৫০ বছর ও নতুনের উৎসব

প্রকাশিত: ১৩:১০, ৫ ডিসেম্বর ২০১৯

নাগরিকের ৫০ বছর ও নতুনের উৎসব

দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যতম পথিকৃত নাট্য সংগঠন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। বাংলাদেশে মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই সংগঠনটি ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে বাদল সরকারের লেখা ‘বাকী ইতিহাস’ নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চা শুরু করে নাট্য দলটি। এই সংগঠনটি ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর এবং দর্শনীর বিনিময়ের নাট্যচর্চার ৪৫ বছর উদযাপন করেছে উদযাপন করেছে। এ উপলক্ষে বছরব্যাপী চলছে নানা কর্মসূচী। চলতি বছরের শেষ উদ্যোগ হিসেবে ‘নতুনের উৎসব’ শীর্ষক নাট্য উৎসবের আয়োজন করছে দলটি। বলা হয়ে থাকে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় দেশের নাট্যধারায় অভিভাবক এবং দিক নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছে। নাট্যচর্চার দীর্ঘ ইতিহাসে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এ পর্যন্ত প্রায় চল্লিশটিরও বেশি প্রযোজনার কয়েক হাজার প্রদর্শনী করেছে। এসব প্রদর্শনী দেশে এবং দেশের বাইরে প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্ববরেণ্য নাট্যকারদের পাশাপাশি দেশের অনেক খ্যাতনামা নাট্যকারদের নাটক সফলভাবে মঞ্চায়ন করেছে। বাংলা নাটককে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করা এবং বিশ্ব নাটকের সঙ্গে বাংলা নাটকের যোগসূত্র তৈরিতে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। যা বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের জন্য অনেকটাই প্রেরণার উৎস। দলটি এ পর্যন্ত যেসব প্রযোজনা মঞ্চে এনেছে তা উপভোগ করতে দর্শক হুমরি খেয়ে পড়েছেন। মঞ্চনাটকের দর্শক বাড়াতে বড় রকমের ভূমিকা রেখেছে নাগরিক। নাট্যকর্মী বা মঞ্চকর্মীদের অনেকেই নাগরিকের বিভিন্ন কর্মকা-ে প্রণীত। তাদের প্রযোজনাগুলোর বেশিরভাগই নিরীক্ষাধর্মী ছিল বিধায় নাট্যকর্মীদের জন্য তা ছিল অনেকটাই অনুসরণীয়। নাগরিকের প্রযোজনাগুলোর মধ্যে রয়েছে কিংবদন্তি নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকের রচনায় ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, ‘ঈর্ষা’, ‘খাট্টা তামাশা’, ব্রেখটের ‘হের দি পুন্টিলা এ্যান্ড হিজ ম্যান মাট্টি’ অবলম্বনে আসাদুজ্জামান নূরের রূপান্তর এবং পরিচালনায় মঞ্চায়িত হয়েছে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’। বাংলাদেশের সর্বাধিক মঞ্চস্থ নাটকগুলোর মধ্যে এটি একটি। এছাড়া নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মঞ্চায়িত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সৎ মানুষের খেঁঁাঁজে’, ‘মাইল পোস্ট’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘মাইল পোস্ট’, ‘কবর দিয়ে দাও’, ‘গড়োর প্রতীক্ষায়’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘মোহনগরী’, ‘রক্ত করবী’, ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’, ‘বিসর্জন’, ‘বিদগ্ধ রমণীকুল’ ও ‘তৈল সংকট’, ‘মুখোশ’ ইত্যাদি। নানা কারণে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রশংসিত। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছে। চলতি বছরের শেষ আয়োজন হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ‘আয় নাটকের অঙ্গনে’ এ সেøাগানে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আয়োজিত আয়োজন করা হয়েছে ‘নতুনের উৎসব’ শীর্ষক নাট্য উৎসব। এ উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত ২৯ নবেম্বর প্রধান অতিথি হিসেবে নাট্য উৎসবের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। সভাপতিত্ব করেন নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন উৎসবের আহ্বায়ক অভিনেত্রী সারা যাকের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিদের নিয়ে প্রদীপ প্রজ্বলন করেন এ প্রজন্মের প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী বন্যা মির্জা, সামিনা লুফা নিত্রা, তনিমা হামিদ, আইরিন পারভীন লোপা, হৃদি হক ও সাধনা আহমেদ। মঞ্চে নারী নাট্যকর্মীদের অবদান তুলে ধরতেই তাদের দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। এর মাধ্যমে পুরাতনের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছে নতুনের। মঞ্চনাটক সবসময় নতুনদের হাত ধরে এগিয়ে গেছে। সেই লক্ষ্যে নতুনদের তুলে ধরতেই নিজেদের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় আয়োজন করেছে নতুন নাট্য নির্দেশকদের নির্দেশনায় ৭টি নতুন নাটক নিয়ে প্রদর্শনী। উৎসবের প্রথম দিনেই তরুণ নাট্য নির্দেশক পান্থ শাহরিয়ার নির্দেশিত নাটকে অভিনয় করেছেন স্বনামধন্য অভিনেতা সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর ও অপি করিম। এ উৎসবে স্থান পাওয়া সাতটি নাটকেরই প্রথম মঞ্চায়ন হচ্ছে। উৎসব উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সামনের উন্মুক্ত স্থানজুড়ে নতুন সব প্রযোজনা এবং নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পুরনো সব নাটকের পোস্টার সাটানো হয়েছে। ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রযোজনা ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘গ্যালিলিও’সহ অনেক নাটকের ছবি পোস্টার দেখে এ নাট্যদলের নাট্যচর্চার ইতিহাস কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছেন দর্শকরা। উৎসবের প্রথম দিন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নতুন প্রযোজনা ‘কালো জলের কাব্য’ মঞ্চস্থ হয়। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন পান্থ শাহরিয়ার। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিসের’ ভাবানুবাদে করা নাটকে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। পরদিন ৩০ নবেম্বর শনিবার মঞ্চস্থ হয় শামীম সাগর নির্দেশিত সুনামগঞ্জের বন্ধন থিয়েটার ও প্রসেনিয়াম থিয়েটার যৌথ নির্মাণ ‘রাধারমণ’। ১ ডিসেম্বর রবিবার মঞ্চস্থ হয় রতন সিদ্দিকী রচিত ও হৃদি হক নির্দেশিত নাগরিক নাট্যাঙ্গনের নাটক ‘আকাশে ফুইটেছে ফুল লেটো কাহন’। ২ ডিসেম্বর সোমবার প্রদর্শিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ও সাইদুর রহমান লিপন নির্দেশিত নাটক ‘অরূপ রতন’। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাসের নাট্যরূপে কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমনের নির্দেশনায় ৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার মঞ্চস্থ হয় নাটগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক ‘খোয়াবনামা’। আফ্রিকান গল্প অবলম্বনে শুভাশিস সিনহার নির্দেশনায় ৪ ডিসেম্বর বুধবার মঞ্চস্থ হয় মণিপুরি থিয়েটারের নাটক ‘ও মনপাহিয়া’। সমাপনী দিন আজ ৫ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার মঞ্চস্থ হবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিল্পীদের অভিনীত নাটক ‘লটারি’। মোস্তাফিজ শাহীন নির্দেশিত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনাটিতে উপদেষ্টার ভূমিকা রেখেছেন সারা যাকের। আজ উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে আজ চার জ্যেষ্ঠ নাট্যশিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, লাকী ইনাম ও শিমুল ইউসুফ বিশেষ সম্মাননা জানানো হবে। নাগরিক নানা কারণে বাংলাদেশের নাট্য অঙ্গনে খ্যাতি লাভ করেছে। তবে দলের সিংহভাগ প্রযোজনা বিদেশী নাট্যকারের হওয়ায় অনেকে সমালোচনাও করেছেন। তবে সমালোচনার খাতিরে সমালোচনা করলেও তারা এও স্বীকার করেছেন যে বিশ্বনাটকের মানদ-ে নিজেদের নাটকের অবস্থান জানার জন্য বিদেশী নাটকও মঞ্চায়ন করার প্রয়োজন আছে। সেক্ষেত্রে সাধুবাদ পেতেই পারে নাগরিক। অনেকটাই তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশের মঞ্চনাটক এগিয়েছে। তবে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নাট্য অঙ্গন সমৃদ্ধ করতে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় অনন্য ভূমিকা রেখেছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
×