ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মীম মিজান

বিজয় ব্যঞ্জনা

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

বিজয় ব্যঞ্জনা

পৃথিবীর প্রারম্ভ থেকে আজ অবধি আমরা অসংখ্য মুক্তি-সংগ্রামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস পাই। আর এসব মুক্তি-সংগ্রামের পর লহুধারার ওপর উদিত হতে দেখি বিজয়ের এক তেজোদীপ্ত ভাস্কর। ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেয় পূর্ববর্তীগণের ত্যাগ। আর তাদের ত্যাগ কেন এবং কি ক্ষেত্র তৈরি করেছে। আমাদের এই প্রিয় মাতৃকা বাংলাদেশেও অনুরূপ দুটো বিজয়ের রৌদ্রকরোজ্জ্বল রবির উদয় আমরা ইতিহাসে দেখি। একটি স্বল্পদূরবর্তী বিলেতি উপনিবেশের নিগড় হতে বিজয় সূর্য। অপরটি নিকটতম অতীতে অর্থাৎ আজ থেকে ৪৯ বছর দূরের পাকিস্তানীদের থেকে মুক্ত লাভের আবির রাঙা অরুণের উদয়। । একজন কবি তার সময়কে ধারণ করেন। তিনি দূরদর্শী। তাই তার সমকালকে ধারণের মাধ্যমে তিনি কালোত্তীর্ণ পঙ্ক্তিমালা গাঁথবেন। দূরভবিষ্যতে একজন পাঠক যখন পাঠ করবেন কবিতাখানি তখনই তিনি ভাববেন, কবি বুঝি আমাকে নিয়েই লিখেছিলেন কবিতাখানি। কবি বুঝি আজকের এই বাস্তবতাকে তখন অনুধাবন করে পদবন্দী করেছিলেন এই পদাবলির। বিজয় মনে। বিজয় প্রাণে। বিজয় ভোরের শিশিরে খুঁজে পায় সবাই। আর বিজয়ের সব থেকে বড় প্রতীক হলো একটি কেতন। আমরা দীর্ঘ নয় মাস শেষে এক অনন্য বিজয় পেয়ে তার মুখকে এঁকে দিয়েছি এক সবুজ জমিনের বুকচিরে উদিত হওয়া গোলাকার রাতুল সূর্যে। যা প্রমাণ করে আমাদের দামাল, দেশপ্রেমে উন্মাদ ছেলেদের অনমনীয়তা। এক একটি অর্জন অনেক ত্যাগের। একজন বিজয়ী যখন মুকুট পরে তখন অন্যেরা তাকে জানাই অভিনন্দন। নিমিষেই মানুষ মন্তব্য জুড়ে দেয় ‘খুব পরিশ্রমী’, ‘মেধাবী’ ইত্যাদি। দেখে না তার এই বিজয় অর্জনের পেছনে কত প্রিয়জনের চোখের অশ্রু। অথবা সেই মুকুটের ঝলকানিতে ফুটে উঠে সব থেকে কাছের মানুষগুলোর অন্তিম মুহূর্তের ছটফটানি। আর আমাদের বিজয়ের পেছনে যারা করেছেন দান। যারা বিলিয়েছেন সম্মান। তাদের প্রতীকী হিশেবে পাই বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত উৎসব ও সম্মানে। একটি বিজয় ঘরে তুলতে কত না যাতনা সহ্য করতে হয়েছিল। একটি বিজয় নিজের করতে কতনা নির্ঘুম রাত পোহাতে হয়েছিল। বিজয় পেতে ছেড়ে যেতে হয়েছিল ঘর। অন্যের ঘরে থেকে, অন্যের পাহাড়ায় দেশের জন্য রাতের আঁধারে হামলা চালিয়ে আবার নিশাচরের মতো গুটিয়ে থাকা অপরিচিত পরম কোন আত্মীয়ের কুটিরে। বিজয়ের রশ্মি যখন ঢুকে পড়ল অপরিচিত পরম কোন আত্মীয়ের ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে। তখন সেই মহাজন বলেন, ভুলে যেও না। আমাদের এ ঘর তোমার জন্য সর্বদা অপেক্ষা করবে আজ যে বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করছি তা এসেছে এক পরিচিত-অপরিচিতের মধ্যে যুদ্ধ থেকে। আর সেই যুদ্ধকে বিশ্বের অনেক শক্তিই গৃহযুদ্ধ বলে চালিয়েছিলেন। যেহেতু একটি দেশের একাংশ পৃথক হতে চায় তাদের স্বাধীকারের জন্য । ফলে মুক্তিকাক্সক্ষা থেকে সেই গৃহযুদ্ধ রূপ নেয় মুক্তিযুদ্ধে। আর সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহুমাত্রিক লেখক ও প্রতিভা আব্দুল মান্নান সৈয়দ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামক কবিতার শেষ পঙ্ক্তিগুলোতে লিখেছেন, ‘নারকেল সবুজ পাতার বালির-ঢাকা চাঁদের সোনালি কামান নিঃশব্দ ওঙ্কারে গর্জে উঠে তুমুল জ্যোৎস্না ছুরে মারে এই চলে সারারাত জ্যোৎস্নায় তমাসায় বাদানুবাদ ভোরের দিকে গৃহযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে যায়। গৃহযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে যায়।’ কবি রফিক আজাদ। তার কবিতা মানে অন্য স্বাদ, অন্য ব্যঞ্জনা। তিনি কোন রক্তচক্ষুকে পরোয়া করতেন না। তার কাব্য লক্ষ্যভেদী। তিনি একজন লেখক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে করেছেন ঋদ্ধ। তার কাব্য বিজয়কে এনে দিয়েছে অন্যরকম এক অর্থ। সে অর্থ নিজের ক্ষমতাকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যয় নয়। সামগ্রিক স্বার্থকে সমুন্নত করতে নিজের প্রেম, ভালবাসা, প্রিয়ার সান্নিধ্য উপভোগকে জলাঞ্জলি দেয়ার। আর এই জলাঞ্জলি শুধু একজন বীর পুরুষই দিতে পারেন। তেমনি ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ’ কবিতায় বীরোচিত মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছেÑ ‘তোমার মুখে হাসি ফোটাতে দামি অলঙ্কারে সাজাতে ভীরু কাপরুষ তোমার প্রেমিক এই আমাকে ধরতে হলো শক্ত হাতে মর্টার, মেশিনগান- শত্রুর বাঙ্কারে, ছাউনিতে ছুড়তে হলো গ্রেনেড আমার লোভ আমাকে কাপুরুষ হতে দেয়নি’ কবি আসাদ চৌধুরী বিজয়কে দেখেছেন ফাগুনের রাঙ্গা পুষ্পে। ঝিরিঝিরি সমীরণে দোলায়িত কচিপাতার আনন্দে। বালিকার পায়ের নূপুরের নিক্কনে। তবে এই ফাগুনের রাঙ্গা পুষ্প, সমীরণে দোলায়িত কচিপাতার আনন্দ, বালিকার পায়ের নূপুরের নিক্কন যে পেয়েছি তার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। আর সেই চরম মূল্যের একটি তালিকা বা রিপোর্ট তৈরি করে জানাচ্ছেন তিনি, ‘দশ লক্ষ মৃতদেহ থেকে দুর্ঘন্ধের দুর্বোধ্য জবান লিখে রিপোর্ট লিখছি- পড়, পাঠ কর। কুড়ি লক্ষ আহতের আর্তনাদ থেকে ঘৃণায় জেনেছি- পড়, পাঠ কর। চল্লিশ হাজার ধর্ষিতা নারীর কাছ থেকে জুলুমের সবক নিয়েছি- পড়, পাঠ কর।’ (রিপোর্ট-১৯৭১, আসাদ চৌধুরী) ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ এই তিনটে কথা শ্রবণেন্দ্রিয় শুনলে সেই মানুষ শিহরিত হয়। বিজয়কে সম্যকভাবে বুঝে নেয়। আর নিজেকে শাণিত করে বিজয়ের জন্য যারা এ রকম আত্মত্যাগ করেছেন তাদের ভাবাদর্শে। স্বাধীনতা, বিজয়, শহীদ কী প্রেরণা জাগায় মনে! এ স্বাধীনতা, এ বিজয় মায়ের কোল খালি হওয়ার। এ বিজয় এসেছে নববধূর বাসর রাতে প্রাণনাথ বিয়োগের ব্যথায়। চোখের সামনে সহোদরার সম্ভ্রমহানির লজ্জা থেকে। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাই জানাচ্ছেন এ বিজয় আসল কিসের সিঁড়ি বেয়ে। এ বিজয় পেলাম কি হারানোর মাধ্যমে, “স্বাধীনতা- সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন স্বাধীনতা- সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।’ (‘বাতাসে লাশের গন্ধ’, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) এই যে বিজয়। এই যে মুক্তি ও স্বাধিকারের উন্মাদনা। এসবের পেছনে একটি উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হচ্ছে পরাধীনতার নিগড় থেকে মুক্তি হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা। আমরা যারা সবাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জন্মেছি তারা খুবই কম জানি আমাদের সেই সময়ে (১৯৭১) কারা শত্রু কারা মিত্র ছিলেন। কেননা আমরা বিজয় ভোগ করছি কিন্তু অজ্ঞ থেকে যাব স্পর্শকাতর সেই সময়ের সম্যক পরিবেশ সম্পর্কে। স্বাভাবতই মুক্তিযুদ্ধকালীন বটবৃক্ষতুল্য প্রাজ্ঞজন তদবিষয়ে সম্যকভাবে জ্ঞাত। তাই তারা আমাদের শত্রু-মিত্রদের চিনিয়ে দিয়েছেন স্নেহবৎসল বাক্যে। প্রাজ্ঞ কবি সাযযাদ কাদির তার ‘শত্রু-মিত্র’ কবিতায় বিজয়ের প্রজন্মকে পরিচয় করাচ্ছেন এভাবে, “অনেক কিছুই তুমি জানবে না, বুঝবে না কোনো দিন। যেমন, শত্রু বলতে ঠিক কী বোঝায়- তাদের চোখ দুটো কেমন তাদের মুখের ভাষা কেমন আর তাদের হাত দুটো? না, তুমি বলতে পারবে না জানি। একইভাবে বন্ধু মানে ঠিক কী তা-ও তোমার জানা হবে না কোনো দিন। তুমি তো একাত্তরে ছিলে না বাংলাদেশে।” দুঃখবাদের কবি হিশেবে দুঃখ উদযাপনকারী কবি হেলাল হাফিজ। তিনি বিজয় বা একটি বিজয়ের নিশান পতাকার জন্য কায়মনোবাক্যে আগ্রহী। তার দুঃখবাদের কবিতা তিনি আর লিখবেন না যদি বিজয়ের ঝা-া পান। ব্যর্থ ও বঞ্চিতজনেরা খুশি হবে অনেক না পাওয়ার পরে কিছু প্রাপ্তির জন্য। আবার সেই বিজয়রূপী পতাকা ঘুচিয়ে দেবে প্রান্তিক মানুষের ভাগ্য। যেমনটি তার আকাক্সক্ষা, “কথা ছিল একটি পতাকা পেলে আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা। কথা ছিল একটি পতাকা পেলে ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্টেস ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন, - ‘পেয়েছি, পেয়েছি’। কথা ছিল একটি পতাকা পেলে পাতা কুড়োনির মেয়ে শীতের সকালে, ওম নেবে জাতীয় সঙ্গীত শুনে পাতার মর্মরে।” (একটি পতাকা পেলে -হেলাল হাফিজ) স্বাধীনতার ও বিজয়ের এই প্রায় অর্ধশতক কালে এসেও প্রজন্ম খুঁজে ফিরে স্বাধীনতা ও বিজয়ের অর্থ। বিজয় কী সত্যি সকলের মুখে ফুটাতে পেরেছে নির্মল হাসি? বিজয় কী সুনিশ্চিত করতে পেরেছে মানুষের দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন? কিংবা মায়ের কোলে নিষ্পাপ শিশুর নিরাপদ আশ্রয়?
×