ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তুহিন আহমদ পায়েল

শাহজালাল থেকে সুবর্ণভূমি...

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

শাহজালাল থেকে সুবর্ণভূমি...

বিশ্বের পর্যটন শিল্পের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ থাইল্যান্ড। সাজানো গোছানো, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মনোরম দেশ। তাই যে কোন পর্যটকের জন্যই থাইল্যান্ড ভ্রমণ একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। একজন পর্যটক হিসেবে চেষ্টা করি প্রতি বছর কোন না কোন দেশ বা দেশের যে কোন ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে আসতে। থাইল্যান্ডে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। সেই মতো ঢাকা থাই দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করি। থাইল্যান্ড যাবার এক সপ্তাহ আগে বিমান টিকেট, হোটেল বুকিং সব সম্পন্ন করে রাখি। এরপর একদিন নয়নাভিরাম দেশটি দেখার জন্য উড়াল দেই থাইল্যান্ড। শাহজালাল থেকে সূবর্ণভূমি : অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঢাকা থেকে ব্যাংককের উদ্দেশে রওনা হই। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট ছাড়ার প্রায় ৩ ঘণ্টা আগে উপস্থিত হলাম। পাসপোর্ট, ভিসা, লাগেজ ইত্যাদি সব চেকিংয়ের পর সকাল ৯টা ২০ মিনিটে বাংলার মাটি ছেড়ে বিমান আমাকে নিয়ে আকাশে ওড়ে। ঢাকা-ব্যাংকক মাত্র আড়াই ঘণ্টার উড়াল। কিন্তু ঢাকা থেকে ব্যাংকক সরাসরি যাবে না। তাই চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাময়িক যাত্রা বিরতি। সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে ফের যাত্রা। আধাঘন্টা পর আমাদের বিমানে হালকা খাবার পরিবেশন করা হয়। যাত্রীরা সবাই বেড়ানোর জন্য ব্যাংকক যাচ্ছেন। অনেকই পরিবার বা বন্ধুরা মিলে আনন্দ করতে যাচ্ছেন। আমার বুঝতে বাকি ছিল যে, আজকাল বাংলাদেশ থেকে প্রচুর লোক ভ্রমণের জন্য বাইরে যান। ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা ছিল খুবই মনোরম। ব্যাংকক সময় দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে বিমান সূবর্ণভূমি বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে। শুনেছি এটি বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক বিমানবন্দর। এতে সব ধরনের সুয়োগ-সুবিধা রয়েছে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন নির্দেশনা, কোথায় চলমান রাস্তা, কোথাওবা চলমান সিঁড়ি, ক্যাপসুল লিফট, যে যেভাবে যেতে চায়! বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত বেশ অনেকখানি পথ। ক্লান্তিকর বিমানযাত্রার পর হাঁটতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, দাঁড়িয়ে পড়লাম চলমান রাস্তার ওপর, বিনাক্লেশে পৌঁছে গেলাম জায়গা মতো। বিমানবন্দরের জায়গায় জায়গায় রয়েছে আরামদায়ক সোফা। আছে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। যাত্রীদের যত রকমের সুবিধা প্রয়োজন সবই আছে এখানে। দেয়ালে লাগানো আছে টেলিফোন, চাইলে কয়েন দিয়ে ফোন করতে পারেন আপনার বন্ধু বা আত্মীয়কে। এক সময় ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠিকতা শেষ করে বাইরে আসি। প্রথমবার এসেছি, পথঘাট চিনি না, তাই ট্র্যাক্সি নিয়েই হোটেল রওনা দেই। এয়ারপোর্টের আঙ্গিনা পেরিয়ে মেইন রাস্তায় উঠেই ড্রাইভার জিপিএস অন করে দিল। অনেক ক্লান্ত ছিলাম কিন্তু তারপরও অনেক ভাল লাগছিল। গাড়ি চলল আর রাস্তার দু’পাশের আকাশচুম্বী অট্টালিকা দেখতে দেখতে চললাম। পুরো শহরটা দু-তিন তলা ফ্লাইওভার দিয়ে ঘেরা। আমার গাড়িটাও ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে চলল। ঢাকার মতো কোথাও কোন জ্যাম নেই। গাড়ি ১০০/১২০ কি.মি. স্প্রিডে চলছে। প্রায় ৪৫ মিনিটি সময় লাগল হোটেলে পৌঁছতে। তখন স্থানীয় ব্যাংকক সময় বিকালে ৫টা হয়। তাই হোটেলে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নেই। সন্ধ্যার পর বের হয়ে রাতের ব্যাংকক শহরের চারপাশ পায়ে হেঁটে দেখে নিলাম। রাতের সৌন্দর্য বেশ মনোমুগ্ধকর। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে ইন্টারনেট থেকে ব্যাংকক ঘুরে বেড়ানোর মতো জায়গাগুলো খুঁজে বের করলাম। প্রথমেই গেলাম থাইল্যান্ডের রাজকীয় মন্ত্রিসভার গবর্নর বিভাগে। বিভাগটি জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক সংহতি এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা বজায় রাখার জন্য রাজকীয় সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখাÑ রয়েল থাই আর্মি, রয়েল থাই নেভাল ফোর্স এবং রয়েল থাই এয়ার ফোর্স। থাইল্যান্ডের রাজা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান। মন্ত্রণালয় এবং বাহিনী থাইল্যান্ডের মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রথমে পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখতে শুরু করি। এসব জায়গা ঘুরে দেখতে পর্যটকদের কোন সমস্যা নেই। বরং সাদরে আমন্ত্রণ জানাবে সবাই। একা একাও ঘোরা যায়। আমি একা একা ঘুরেই ছবি তুলি। আমার নিজের ছবি তোলার জন্য কেউ সাঙ্গে ছিল না। তাই যখন যাকে কাছ পাই, তাকেই অনুরোধ করি, আমার একটা ছবি তুলে দিতে। তারাও হাসিমুখেই আমার ছবি তুলে দেয়। হেঁটে হেঁটে পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রবেশ মুখেই রয়েছে সশস্ত্র নিরাপত্তা সৈনিক। একটি কামান রয়েছে, যে কেউ চাইলে তার সামনে থেকে ছবি নিতে পারেন। ন্যাশনাল ডিফেন্সের আশপাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন অনেক প্রশাসনিক ভবন। যা মুগ্ধ করে আমাকে। সেখান থেকে চলে যাই ওয়াট ফো বা ওয়াট পো দেখতে। ওয়াট ফো মন্দির : বৌদ্ধ মন্দির বা ওয়াট ফো চেপুটান পুরনো বৌদ্ধ মন্দিরের পেছনে অবস্থিত। ব্যাঙ্কক প্রথমবারের মতো এসেছেন, এমন যে কোন দর্শনার্থীর জন্য তা অবশ্যই দেখা উচিত। এটি ব্যাঙ্ককের রাজা রামা আইর রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। মূলত এর নামকরণ করা হয়েছিল ওয়াট পাতারাম বা পাদরাম, যার নাম ওয়াট ফো বা পো। ২২ একর জমির ওপর মন্দির কমপ্লেক্সের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। বর্তমানে বেশিরভাগ কাঠামোই ওয়াটফোতে নতুন করে নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। মার্বেল চিত্রাবলী এবং শিলালিপিগুলো স্মৃতিসৌধে রক্ষিত আছে। বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষা, সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য ইউনেস্কোর বিশ্ব প্রোগ্রাম এখানে হয়। গ্র্যান্ড প্যালেস : নাম শুনলেই শিহরণ জাগে। দূর থেকে দেখেই শুরু হয় ভাললাগা। কাছে গেলে সেই ভাললাগা বাড়তেই থাকে। স্থাপত্যকর্ম সৃজনশীলতার অন্যতম প্রতিমা, যার প্রতিফলন মিলবে থাইল্যান্ডের গ্র্যান্ড প্যালেস বা মহাপ্রাসাদে। গ্র্যান্ডপ্যালেস থাই স্থাপত্যশৈলীর সর্বোচ্চ প্রতীক। ওয়াট ফো থেকে গ্র্যান্ড প্যালেসে যেতে একটু হাঁটতে হয়। চাইলে টুকটুক নিয়েও যাওয়া যায়। টুকটুক আমাদের দেশের সিএনজির মতোই দেখতে, কিন্তু ভাড়া অনেক। আমি হেঁটেই গ্র্যান্ডপ্যালেসে যাই। যেতে যেতে চারপাশ দেখতে দেখতে যাই। রাস্তার ম্যাপ দেখে দেখে অনেক বিদেশী পর্যটক হেঁটে চলেছেন। রাস্তার পাশে অনেক খাবারের দোকান। বিশেষ করে ফলের দোকান অনেক বেশি। তাছাড়া অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসও পাওয়া যায়। গ্র্যান্ডপ্যালেসের মুখেই অনেক কাপড়ের দোকান। এখানেও ঢুকতে হলে উপযুক্ত পোশাক পরতে হবে। শর্ট প্যান্ট, শর্ট টি-শার্ট, শর্ট জিন্স (মেয়ে), শর্ট টপসÑ এগুলো পরে ঢুকতে মানা। টাকা চেঞ্জ করার জন্য প্রতিটি পয়েন্টে রয়েছে এক্সচেঞ্জ কাউন্টার। তাই কোন অসুবিধা নেই। লাইনে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে গ্র্যান্ডপ্যালেসে ঢুকতে হবে। এখানে সহযোগিতার জন্য রয়েছে রয়েল থাই পুলিশ। ভেতরে ঢুকেই দেখি এর মধ্যেই অনেক পর্যটকে সমাগম হয়েছে। অনেকে গ্রুপ ট্যুরে এসেছে। সবাই মিলে ছবি তুলছে। আমি নিজে কয়েকটা সেলফি তুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাই টিকেট করার জন্য। টিকেট কাউন্টার থেকে মূলভবনে ঢোকার জন্য ৫০০ বাথ দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করি। পরে মূল ভবনের গেটে টিকেট চেক করে ভেতরে প্রবেশ করি। মূল ভবনে ঢুকতেই মনেস্ট্রির মধ্যে ম্যুরালের অনন্য কাজ দেখা যায়। ভেতরের আলো-আবছায়া পরিবেশ মনকে যেন কোন সুদূর অতীতে নিয়ে যায়। সময় অল্প, বিকেল হয়ে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাবে তাই দ্রুততার সঙ্গে প্রাসাদ দেখতে শুরু করলাম। এত রঙের বাহার চারদিকে! মনেই হয় না পৃথিবীতে ‘মন খারাপ করা বিকেলের’ কালো মেঘ থাকতে পারে। গাঢ় সুনীল আকাশও আমার সারাদিনের বেড়ানোর সঙ্গী। চমৎকার ঐতিহাসিক ভবন কমপ্লেক্স সত্যিই সবচেয়ে জাঁকজমক কাঠামোর মধ্যে একটি, যা আপনি ব্যাংককে এলে খুঁজে পাবেন। এটি থাইল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোর একটি। স্থাপত্য সৌন্দর্য ও প্রাচীন মূল্যবান সংস্কৃতির জন্য ব্যাংকক একটি আবশ্য দর্শনীয় স্থান। জাতীয় জাদুঘর : ব্যাংকক একজন উদ্যমী পর্যটকের জন্য সত্যিকারেরই একটি স্বর্গ। এটি অধিকাংশ মানুষের জন্য একটি স্বপ্নের গন্তব্যস্থান। এখানে আপনি থাইল্যান্ডের রাজধানী হিসেবে যা যা আশা করেন, সব কিছু উপভোগ করতে পারবেন! উজ্জ্বল মন্দির, ভাসমান বাজার, চমৎকার স্থান এবং আরও অনেক অনেক কিছু। এসব দর্শনীয় স্থানগুলো পর্যটকদের অবশ্যই দেখা উচিত। কিন্তু সময়স্বল্পতা এবং অর্থের সীমাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশই এসব দেখার সুযোগ করে উঠতে পারেন না। ব্যাংককে ভ্রমণের সময় অবশ্যই পরিদর্শন করতে পারেন ব্যাংকক জাতীয় জাদুঘর। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম জাদুঘর। এর সংগ্রহশালাটি বিশাল। সৌভাগ্যক্রমে, জাদুঘরের প্রতিটি প্রদর্শন থাই এবং ইংরেজী লেবেল করা রয়েছে। যখন জাদুঘরটি দেখতে যাবেন, একটু সময় নিয়ে যাবেন। কারণ এর সংগ্রহ এত বিশাল যে, কখন আপনার সময় শেষ হয়ে যাবে তা টেরই পাবেন না! প্রবেশ মুখ থেকে ২০০ বাথ দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করি। টিকেটের সঙ্গে একটি মিউজিয়াম ম্যাপ দেয়া হয় ঘুরো দেখার জন্য। ব্যাগ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ নিষেধ, তাই ব্যাগ জমা রাখতে বলা হলো। বললাম ব্যাগে আমার প্রয়োজনীয় অনেক কিছু আছে। বললো কোন সমস্যা নেই, ব্যাগ লক করা থাকবে। তাই কাউন্টারে ব্যাগ জমা রেখে লকের চাবি ধরিয়ে দিল। আমি শুধু ক্যামেরাটি নিয়ে গেলাম। শুরু হলো মিউজিয়াম দেখা। মিউজিয়ামে ১৪টি স্তরে ভাগ করা রয়েছে। প্রতিটি ভাগে অনেক গ্যালারি রয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তাই হোটেল এ ফিরতে হবে। মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে ট্যাক্সির জন্য দাঁড়ালাম। কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালা ভাড়া অনেক চায়, তাই ভাবলাম ট্যাক্সিতে না গিয়ে টুকটুকে যাই। ৩০০ বাথ দিয়ে ঠিক করলাম টুকটুক যাত্রা হলো আমার হোটেল সুকুমভিট নানা ছই-৪। ব্যাংকক শহরের রাস্তাঘাট ছিমছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। অনেক রাস্তা-ফ্লাইওভার থাকার পরও প্রচুর ট্র্যাফিক জ্যাম। কিন্তু তা শুধু কিছু সময়ের জন্য। পৃথিবীর সব বড় শহরেই জ্যাম থাকে। এটা তারই চিত্র। ঢাকার রাস্তায় ফ্লাইওভার কম। এখানে তো চওড়া রাস্তা, ফ্লাইওভারেরও অভাব নেই। তারপরও জ্যাম কেন? এসব ভাবনার মধ্যেই গাড়ি সামনে চলছিল। হোটেল আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে গেছে। পরের দিন সকালে ট্যুর ছিল পাতায়া। অসমাপ্ত
×