ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রকিবুল হাসান

ওমর আলী ॥ স্বতন্ত্রধারার কবি

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

ওমর আলী ॥ স্বতন্ত্রধারার কবি

কবি ওমর আলীর সবচেয়ে সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি (১৯৬০)। এ গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক মহলে যেমন ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, তেমনি বাংলা কাব্যসাহিত্যে ওমর আলীর স্থায়ী আসনটি সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। এ গ্রন্থটি বাংলা কাব্যধরায় ‘গ্রামজীবননির্ভর আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে।’ বাংলা কবিতায় নানামাত্রিক বাঁক ঘটেছে। প্রথম মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতেই বাংলা কবিতার আধুনিক যাত্রা ঘটে। এর পর রবীন্দ্রনাথ কবিতায় একক রাজত্ব ও ঐশ্বর্য নিয়ে আসেন। রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রবৃত্ত ভেঙে কবিতায় নতুন ধারা আনেন নজরুল। অক্ষয়কুমার দত্ত এবং মোহিতলাল মজুমদারও কিছুটা নতুনত্ব সংযোজন করেছিলেন। তিরিশের কবিরা রবীন্দ্রবৃত্ত সম্পূর্ণভাবে ভেঙে কবিতায় এক নতুন ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। সেক্ষেত্রে তাঁরা ‘হয়ে উঠেছিলেন নগরমনস্ক’। এই নগরমনস্কতায় তাঁরা শুধু নিজেদের নগরেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নগরযন্ত্রণাকে কবিতায় এনে নতুন এক ধারা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। এ ধারাতেই পরবর্তী কয়েক দশক প্রবাহিত হয়েছে। ওমর আলী স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ‘আধুনিককালের কবিতার মেজাজমর্জি সচেতনভাবে ধারণ’ করেই তিনি ‘গ্রামীণ জীবনসংস্কৃতিকে অবলম্বন’ করে কবিতা লিখেছেন। ওমর আলীই একমাত্র কবি যিনি গভীর মমতায় গ্রাম আর গ্রামের মাটিকে কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন আপাদমস্তক, বলতে পেরেছেন ‘লোকটা সূতী কাপড় পরেনি, পরেছে শুধু মাটি’। তাঁর সব কবিতাগ্রন্থ গ্রামের নিখাঁদ গন্ধে ভরা। একই সঙ্গে গ্রামের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দুঃসহ জীবন যন্ত্রণাকে খুঁটে খুঁটে দেখেছেন, দেশ-কাল, সমাজ-রাষ্ট্র-স্বাধীনতা, জৈবিকতা-প্রবৃত্তি নানা বিষয় উপজীব্য করেছেন কবিতায়। বেদনার্ত মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিজের করে পাশে থেকেছেন। তাঁর প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থই এর সত্যতা বহন করে। এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি, ডাকছে সংসার, হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড়, তোমাকে দেখলেই, আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে, ফেরার সময়, তেমাথার শেষে নদী, অরণ্যে একটি লোক, ছবি, স্বদেশে ফিরছি, যে তুমি আড়ালে, আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে, গ্রামে ফিরে যাই, অরণ্যে একটি লোক, তেমাথার শেষে নদী, আত্মার দিকে, নদী, নরকে বা স্বর্গে, এখনো তাকিয়ে আছি, নিঃশব্দ বাড়ী, ভালোবাসার প্রদীপ, প্রস্তরযুগ তা¤্রযুগ, স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন, লুবনা বেগম, একটি গোলাপ Ñ এভাবে যদি তাঁর সব কটি কাব্যের নাম করা যায়Ñ নাম থেকেই দু’দ- প্রাণভরে গ্রামের ঘ্রাণ নেয়া যাবেÑ এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা; সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকোয় রোদ্দুরে, রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা। আবার এ গ্রামের পরতে পরতেই যে লুকানো রয়েছে কষ্ট দীর্ঘশ্বাস, যা কবিকে বেদনার্ত করে। গ্রামীণজীবনে সাধারণ দরিদ্রমেয়েরা নানা কারণেযৌবনবতী হওয়ার আগেই তারা কৌমার্য হারিয়ে ফেলে। সমাজের নানারকম হিং¯্র্র ফণা এসব মেয়েদের দিকে ওঁৎ পেতে থাকে। সেসব থেকে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে না। যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই অনেকে বাল্য বিয়ের শিকার হয়। সেখানে অনাহার অপুষ্টিতে যৌবন আর কোনদিনই তাদের শরীরে ধরা দেয় না। সমাজে নষ্ট মানুষও আছে। যারা অসহায় মেয়েদের নানারকম প্রলোভন দিয়ে তাদের সঙ্গে শরীরী সম্পর্ক গড়ে তোলে। এসব মেয়েরা শেষ পর্যন্ত প্রতারণার শিকার হয়। কখনো শিকার হয় ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনার। কখনো আবার এসিডে ঝলসে দেয়া হয় এসব সরল মেয়েদের শরীর। যৌতুকের নির্মম শিকার হতে হয় এদের। নানামাত্রিক নির্যাতনের জীবন হয়ে ওঠে গ্রামের সহজ সরলা নারীদের। ওমর আলী গ্রামের মানুষ। এ সব তাঁর দেখা। গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণা প্রতিটি পায়ের শব্দ তার চেনা। প্রত্যেক নিঃশ্বাসের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। শব্দ বর্ণ গন্ধ যেন তাঁর আত্মার সঙ্গে বাঁধা। তাঁর কবিতাও গড়ে ওঠে সে-সব কেন্দ্র করেই- কুমারী আরো বেশি লাবণ্য কুমারী হবার আগেই তার ললিত যৌবনের ক্ষয় কিংবা নতি দেখতে শুরু করে কিংবা অনেকেই যুবতী হতে হতে আর যুবতী হয় না। ওমর আলী তাঁর কবিতায় প্রেম ও রোমান্টিকতার স্পর্শ গন্ধ বর্ণ যেমন প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ করেছেন, তেমনি প্রেমের দেবতী যে তার প্রতি অপরিসীম ক্ষোভ ক্রোধ ঘৃণাও ব্যক্ত হয়েছে। তিনি হয়তো বিশেষ কোন নারীর কাছে মানসিক কষ্টের শিকার হয়েছিলেন। ভালোবাসার অগ্নিতে পুড়েছেন আপন অন্তরে। সেই নারীর ছবিটি শিল্পীকে দিয়ে অবিকলরূপে এঁকে আগুনে পোড়ানোর ইচ্ছে ব্যক্ত হতে দেখি কবিতায়। একদিন একটি লোক এসে বললো, ‘পারো?’ বললাম, কি?’ ‘একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে,’ সে বললো আরো, ‘সে আকৃতি অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে- পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।’ ‘কেন?’ আমি বললাম শুনে। সে বললো, ‘আমি সেটা পোড়াবো আগুনে।’ ‘একদিন একটি লোক’, এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি) জৈবিকতা বা শরীরী সম্পর্ক কবি অনায়াসে কবিতার অনুষঙ্গ করেছেন। যেটি শুধু মানুষ নয়, প্রাণীমাত্রই অপরিহার্য একটি ব্যাপার। ওমর আলীও সেই অপরিহার্যতাকে অস্বীকার করেননি। বরং অকপটে তা কবিতার শরীরে রূপ দিয়েছেন। বোদলেয়ার, র্যাঁবো, ম্যুলেন, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান সকলেই কমবেশি জৈবিকতাকে কবিতার অনুষঙ্গ করেছেন। ওমর আলীও এই অনিবার্যতা এড়িয়ে যাননি। বরং অনেক গুরুত্বের সঙ্গেই তিনি কবিতায় জৈবিকতা বা কামগন্ধ-শরীরী বিষয় ধারণ করেছেন। ওমর আলী এক্ষেত্রে অনেক সাহসের পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। কবিতায় তখন মেয়েদের শরীর-বিষয়ক অনেক শব্দ ব্যবহার শালীনতার ভেতর গৃহীত হতো না। আদিরসনির্ভর কবিতা অনেক আগেই বিশেষ করে ঈশ্বগুপ্তেই প্রায় যবনিকা ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ কবিতায় দেহ-নিরপেক্ষ শুচিময় একটি ব্যাপার কবিতায় নিয়ে এলেন। যদিও আধুনিক কবিরা এ রুচি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও রক্ষণশীল একটি কাব্যরুচি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কবিতাচর্চা চলছিল। এ কাব্যরুচি থেকে বেরিয়ে কবিতা রচনা করে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমানরা সে সময়কালে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। ওমর আলীর আবির্ভাব প্রায় এ রকম একটি সময়কালেই। তিনি দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে লিখে ফেললেন ‘সযতেœ ছায়ার নিচে ঢাকা থাকে মেয়েদের স্তন’ (তোমাকে, এদেশে শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি)। কাব্যবিচারের ক্ষেত্রে যে ধরনের (রক্ষণশীল) মূল্যবোধ তখন পর্যন্ত অব্যাহত, উক্ত সময় পরিসরে রচিত ওমর আলীর অনেক কবিতাই সেই অনুশাসন অমান্য করেছে। শব্দ বিন্যাসে ওমর আলী গ্রামীণজীবন আর প্রকৃতি নির্ভর। প্রতিদিনের ব্যবহৃত শব্দ অনিবার্যভাবে গ্রহণ করেছেন তিনি। গ্রামীণ সমাজ-জীবন প্রকৃতির কাছেই কবি বার বার দ্বারস্থ হয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ঐতিহ্য অন্বেষণে সচেষ্ট ও সচেতন। কবিতায় নানাভাবে তিনি গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন। গাঁয়ের পথ, ঢেঁকির শব্দ, বাঁশঝাঁড়, কলাগাছ, পাখ-পাখালি, ডিঙি নৌকা, পদ্মবিল, পুঁটি, ট্যাংরা, বক, বটগাছ, শরবন, নারিকেল তলা, পুকুর, মুঠো মুঠো শস্য, আবডাল, বুনোলতা, ঘাস, বৃষ্টি, মৃত্তিকা, রোদ, বিটপী ছায়া, বনতল, কফিন, সাতভাই চম্পা, বেড়িবাঁধ, রূপসী মৃগয়া, হাইহিল জুতো, ভাত কাপড়, দেনমোহর, মেঠোফুল-এরকম অজস্র উদাহরণ তাঁর কবিতার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। স্বদেশপ্রেম ওমর আলীর কবিতায় একটি প্রধান প্রসঙ্গ। স্বদেশের জন্য কবির ভিতরে গভীর স্বপ্ন যেমন লালিত, আবার স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাও বিদ্যমান। কবি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও, দেশটা যে রাজনীতির নামে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে, সে-বিষয়ে তিনি সচেতন। অর্থাৎ গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করলেও কবি যে রাজনীতি সচেতন এবং তাঁর ভেতরে যে গভীর দেশপ্রেম রয়েছে তাঁর অনেক কবিতায় তা স্পষ্ট। তাঁর কবিতায় এদেশের মানুষের আত্মপরিচয়, রাজনৈতিক অধিকার, রাজনীতির নামে স্বদেশকে ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষতকরণ, এদেশের দেশপ্রেমী খেটে-খাওয়া মানুষের দুর্বিষহ জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। সমাজ সময় রাষ্ট্র ও অভিজ্ঞতাকে তিনি কবিতায় গ্রহণ করেছেন। ‘কিছুতেই মনে পড়ে না যে আমার স্বদেশ কোথায় রেখেছি/ কিছুতেই মনে পড়ে না যে এত কষ্টে পাওয়া যে স্বদেশ আমার/ শরীরেই বদরক্তে বন্দী হয়ে আছে’। রক্ত-কান্না-লাশ-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় এ স্বদেশভূমির করুণ এ অবস্থা কবিকে বেদনা ভারাক্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। স্বপ্নের কথাও আছে তাঁর কবিতায়। যে স্বপ্ন নিয়ে একদিন এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। সকলের মতো তিনিও সেই স্বপ্ন দেখেন ‘সংসারের দেউড়ী থেকে পেছনের খিড়কি দুয়ার পর্যন্ত শুধু সুখ’। সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েই তো এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সুখী-সমৃদ্ধ দেশ অর্জনের জন্যেই তো অনেক রক্ত আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে এদেশ কিনতে হয়েছে। কবিওতো এদেশের এক স্বপ্নবান মানুষ। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে সুন্দর সুফল সুখবতী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। আবেগ-প্রবণতা ওমর আলীর কবিতার একটি বিশেষ দিক। মানবিক-প্রবৃত্তি ও হৃদয়গত সম্পর্কে যে আবেগের মূল জায়গাÑ এ সত্য কবিও উপলব্ধি করেছেন। মানসপ্রিয়ার সবকিছুতেই আবেগ অনুভব করে প্রেমিকপুরুষ-হৃদয়তাড়িত হয়ে ওঠে-এক অন্যকেম ভালোলাগা যে তাকে মুগ্ধতায় বেঁধে রাখে-ওমর আলী কবিতায় সেই অপরিহার্য-আবেগ প্রবণতা উঠে এসেছে নানাভাবে। ওমর আলী কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। বাংলা কাব্যসাহিত্যে তিনি জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদদীন ও বন্দে আলী মিয়ার যোগ্য অনুসারী হলেও তিনি নিজস্ব স্টাইল ও ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর কবিতার বিষয়-বস্তু শব্দ অলঙ্কার বর্ণনায় মৌলিকত্বের শক্ত ছাপ রাখতে পেরেছেন। এ দেশের মাটির নিখাদ গন্ধ বুকে মেখে তিনি কবিতা সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কবিতাও হয়ে উঠেছে নিখাদ মাটির গন্ধভরা। ওমর আলী এখানেই অনন্য ও বিশিষ্টতার দাবিদার। ওমর আলীর কবিতার বিষয়বস্তু গ্রামীণ জীবন-সমাজ ও পরিবেশনির্ভর হলেও, চেতনাগতভাবে বহুমাত্রিকতা আছে। দৈনন্দিন বলা যেতে পারে ওমর আলী ত্রিশের যে স্রোত ত্রিশের সীমানা পেরিয়ে ষাটেও দিব্যি প্রভাব-রাজত্ব বিরাজ করে চলছিল, ওমর আলী সে-ধারা থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসা স্বতন্ত্রধারার এক কবি। যেখানে তাঁর দেশ-মাটি-মানুষই প্রধান ও আরাধ্য। তাঁর হাতেই এখান থেকে বাংলা কবিতা আর এক নতুন বাঁক পায়।
×