ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নূরুল আম্বিয়া চৌধুরী

গ্রাফিক ডিজাইনের বার্ষিক প্রদর্শনী

প্রকাশিত: ০৯:৪৪, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯

গ্রাফিক ডিজাইনের বার্ষিক প্রদর্শনী

গ্রাফিক ডিজাইনকে মূলত কমিউনিকেটিভ আর্ট বলা হয়। কারণ, এর মূল উদ্দেশ্য কোন তথ্যকে জনগণের নিকট দৃশ্যগতভাবে উপস্থাপন করা। গ্রাফিক ডিজাইনের মূল উদ্দেশ্য- ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, সেবা, ভোক্তা এবং সমাজের প্রত্যেক স্তরে একটি সুষম যোগাযোগ তৈরি করা। তাই এ পুরো প্রক্রিয়াটি প্রচার-প্রচারণা ও প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। একজন ডিজাইনার লোগো ডিজাইন থেকে শুরু করে যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ ব্র্যান্ডিং ইমেজ ডিজাইন করে থাকেন এবং তখনই তিনি গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে স্বীকৃতি পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের ‘বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী-২০১৯’ দেখার পর বেশ কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হয় আমার, সেই বোধের জায়গাটি ভালো-মন্দ উভয়ের সংমিশ্রণ। পরবর্তী আলোচনাটির অভিপ্রায় মূলত সেই অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করা। প্রদর্শনীতে একষট্টিজন শিক্ষানবিস শিল্পীর পঁচাশিটি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল। চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারির দুটি কক্ষে, কম স্পেসে কিছুটা অনাড়ম্বরভাবে প্রদর্শিত হয় বৈচিত্র্যময় প্রণালীর কাজ। ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরিতে মোট তেরোজন শিক্ষার্থীকে পুরস্কার প্রদান করে বিভাগ। শিল্পকে মাপার কোন কাঠামো যেহেতু নেই, সেহেতু শ্রেষ্ঠত্ব নির্বাচনের এই ধারাটি শিক্ষানবিসদের উজ্জীবিত করার একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া বলে আমি মনে করি। একজন শিল্পী শিক্ষানবিস থেকেই মূলত ধীরে ধীরে বোধসম্পন্ন, বিশ্লেষণাত্মক ও দায়িত্বশীল পূর্ণ শিল্পী হয়ে ওঠেন। প্রদর্শনীতে বিভিন্ন প্রকারের ডিজাইন, ইলাস্ট্রেশন, অ্যাড আর্ট, স্টিল লাইফ, টাইপোগ্রাফি, নিসর্গ চিত্র, ক্যালিগ্রাফি, মোশন গ্রাফিক্স, পোস্টার ও এক্রিলিক রঙ এবং নতুন ডিজিটাল মাধ্যমের কাজ চোখে পড়ে। প্রথম গ্যালারির বেশকিছু পোস্টারের বিষয়বস্তু নির্বাচন, তাতে রঙের তাৎপর্যমূলক ব্যবহার ও রচনাশৈলী সত্যই ছিল প্রশংসনীয়। যেমন, তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাকিয়া সুলতানা জান্নাত কৃত নিরীক্ষাধর্মী পোস্টার, যার শিরোনাম ‘মৃৎশিল্প’। বিষয়বস্তু কুমোরের হাতে কাদামাটির পাত্র। কুমোরের হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে মিশে থাকা কাদামাটি ও মাটির পাত্রের ওপর ক্যানভাসের বাহির হতে আসা আলোকচ্ছটার যথাযথ উপস্থান কাজটিতে রঙের ব্যবহারকে করেছে অনবদ্য। মিশ্র রং ব্যবহারে আলোছায়ার যে অবিমিশ্রিত-অখণ্ড উপস্থাপন, সেটি পোস্টারের রচনাশৈলীকে করেছে বাস্তবধর্মী। দৃশ্যপটে মৃৎশিল্পীর হাতে পেশীর যে টান ও শক্তি প্রদর্শিত হয়েছে, তা মূলত মাটির সঙ্গে আমাদের লোকশিল্পের সম্পৃক্ততা ও লোকজসংস্কৃতির প্রতি গভীর আকর্ষণকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করে। মজার বিষয়- কুমোরের শীর্ণ হাতে পেশীর টান বর্তমান সময়ে মৃৎশিল্পের ক্ষয়িষ্ণুকালকে প্রকাশ করলেও, সে একই হাতে দক্ষ আঙ্গুলের আলতো ছোঁয়ায় মাটির পাত্রের নিপুণ গড়ন- শিল্পীর পেশাদারিত্ব, কৌশল ও কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধকে প্রদর্শিত করছে। এক্ষেত্রে বলা যায়, ভাবনার সঙ্গে শিল্প উপস্থাপনের যোগসাজশ রয়েছে। দর্শক হিসেবে কাজটি দেখে শাশ্বত মাটির ঘ্রাণ পাই, যেটি আমাদের সত্তা ও আত্মার সঙ্গে সম্পৃক্ত। জান্নাতের কাজের পাশেই ‘বাংলার ঐতিহ্যবাহী জামদানী’ শিরোনামের আরও একটি পোস্টার রয়েছে যা আমাদের লোকশিল্পের অন্যতম আরেকটি প্রধান ধারাকে নির্দেশ করে। অপরদিকে, অপেক্ষাকৃত কিছু তরুণ শিক্ষার্থীর চিত্রকর্মে রঙের ব্যবহার দেখে মনে হয়েছে তা অপূর্ণ। যেমন, খাজা শফিক আহমেদ স্মারক পুরস্কারপ্রাপ্ত পোস্টার ডিজাইনটির জমিনে রঙের অপেক্ষাকৃত অপূর্ণ ছাপ কাজের বিশুদ্ধতাকে করেছে কিছুটা বেমানান। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে কাজে আরও মনোযোগী হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি। একই কক্ষে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরান হাসান ‘বিভাগীয় সেরা পুরস্কার’ পায় তার করা শিল্পকর্ম ‘মেন’স ফ্যাশন’র ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি ডিজাইন করে। ব্র্যান্ডটি মূলত সমাজের মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর পণ্য সচেতনতাকে মাথায় রেখে করা। দৈনন্দিন স্টেশনারী সামগ্রীতে লোগোর ডিজাইনকে ফুটিয়ে তোলেন এই শিক্ষার্থী। গ্যালারির দ্বিতীয় কক্ষে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইরতিজা কাগজীর ‘রূপশৈলীর প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন’ চিত্রকর্মে সমুদ্রের ফেনিল ঢেউ দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন বাস্তবিক। শিল্পকর্মটি সম্মান চতুর্থ বর্ষ ক্যাটাগরিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত। শিক্ষার্থীদের প্রকৃতি থেকে শিল্পভাবনা সংগ্রহ করার এই প্রচেষ্টা সত্যই প্রশংসনীয়। একই গ্যালারিতে নিরীক্ষাধর্মী বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারজয়ী শিক্ষার্থী আবু ওবায়েদ বিন রশিদের (মাস্টার্স প্রথম পর্ব) কাজে ছিল পরিবেশগত চিন্তা। তার কাজের মূল বিষয় ‘ঙক’ নামক কোম্পানির পণ্য- বিশুদ্ধ পানির- লোগো ডিজাইন। ‘ঙক’ অর্থ ‘ঠিক আছে’, আর পানির বিশুদ্ধতা শরীর সুস্থ থাকার প্রধান শর্ত। আমার মতে ডিজাইনটি সম্প্রতি জুলাই মাসে ঢাকা ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দূষণের প্রতি একটি নীরব প্রতিবাদ। লোগোটি শিক্ষার্থী ইমরানের তৈরি লোগোর সঙ্গে দর্শনগত জায়গায় আলাদা। ইমরানের উদ্দেশ্য সমাজের নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রত্যাশাকে বাস্তবায়ন করা, আর ওবায়েদের ডিজাইন সমগ্র মানুষের সুপেয় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদিও এখানে উভয়েরই শিল্পকর্ম তৈরির পিছনের উদ্দেশ্য ছিল ‘ধারণাগত’ ডিজাইনে স্ব স্ব দক্ষতা ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করা, তবুও সেটি একই সঙ্গে ডিজাইনারদের সমাজের প্রতি নিজস্ব দায়বদ্ধতাকে মনে করিয়ে দেয়। অর্ধ-বিমূর্ত শিল্পের আঙ্গিকে নিরীক্ষাধর্মী কাজে মাস্টার্স (প্রথম পর্ব) অধ্যয়নরত শিল্পীদের মধ্যে শ্রেণী শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পায় সংযুক্তা বিশ্বাস মুমু। বর্গাকার ক্যানভাসে এক্রিলিক মাধ্যমে মোট তেরটি আধা-বিমূর্ত মুখাবয়ব রয়েছে, যাতে তিনি ফর্মকে নিজের ইচ্ছেমত ভাঙেন। ডিজাইনিংনির্ভর কাজটির মূল আকর্ষণ তার রং ও রেখার নিরীক্ষাধর্মী প্রয়োগ। তবে, সেটিতে এক্সপ্রেশনিস্ট আঙ্গিকে বিমূর্ত শিল্প তৈরির প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। প্রত্যেকটি মুখাবয়বই নারীর প্রতিকৃতি, যার প্রধান উদ্দেশ্য নারীর সৌন্দর্য প্রকাশ। কিন্তু, আপাত বিকৃত মুখাবয়বের আড়ালে কখনও হেসেছে সৌন্দর্য, কখনও মুচড়ে পড়া বিমর্ষ মুখ কেঁদে ওঠে, আর ক্ষণিককালে কতক মুখে উঁকি দেয় চিন্তা। উপস্থাপিত কয়েকটি চোখের গঠনে ভারতীয় বাঙালী শিল্পী (পটুয়া) যামিনী রায়ের প্রভাব পরিলক্ষিত। নিরীক্ষাধর্মী এই শিল্পকর্মটিতে রঙের ঐক্যতান, সুসঙ্গত রচনা ও ফর্মের ভারসাম্য যথোচিত মাপে পরিগণিত হয়েছে। লোকশিল্পের সঙ্গে অধুনা মাধ্যমের সংযোগের দেখা মেলে মাস্টার্স দ্বিতীয় পর্বের শিক্ষার্থী মোঃ রাসেল রানার পোস্টারে। অগ্রবর্তী (এডভান্সড) ডিজাইনে কৃত ‘বিশ্ব গ্রাফিক ডিজাইন ডে’র লোগোতে রাসেল যুক্ত করেন ট্যাপা পুতুলের ফর্ম। ফর্ম দেখে বুঝা যায়- আমাদের ঐতিহ্যবাহী ট্যাপা পুতুলের আকারেও রয়েছে সূক্ষ্ম শৈল্পিক পরিমাপ- রেখা, রচনা ও ভারসাম্যের যথার্থ প্রয়োগ। পাশ্চাত্যের চোখে আমাদের লোকশিল্পীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাপ্ত নন। কিন্তু শিল্প সম্বন্ধে তাদের প্রাকৃতিক জ্ঞান সম্পূর্ণ ও নিতান্তই সঠিক। একই কক্ষে মাস্টার্স দ্বিতীয় পর্বের আরেক শিক্ষার্থী ফখরুল ইসলামের পোস্টারটি শ্রেণী সেরা এ্যাওয়ার্ড পায়। কাজটির বিষয়বস্তু ছিল সেন্টমার্টিন (বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ), যেটি ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ নামেও অধিক সমাদৃত। সেই ভাবনা মাথায় রেখে শিল্পী অর্ধভগ্ন নারিকেলের রূপ ও নারিকেল গাছকে চিত্রের মধ্যখানে উপস্থাপন করেন। গাছের সবুজ পাতার পিছনে, জমিনে সামুদ্রিক নীল রং ব্যবহার প্রবাল দ্বীপের নান্দনিক সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে। শিল্পী সচেতন ভাবেই সবুজ ও নীল (বর্ণবৃত্তে সমবৃত্তীয়) বর্ণকে পাশাপাশি রেখে পোস্টারটিতে রঙের সমন্বয় সাধন করেন। ক্যালিগ্রাফি (হস্তলিপি শিল্প) ও টাইপোগ্রাফির (মুদ্রণশিল্প) কিছু কাজ ছিল চোখে পড়ার মতো। যেমন, সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র খালিদ আল আমিনের ক্যালিগ্রাফি যেটিতে গুরুত্বারোপ করা হয় ক্যালিগ্রাফিক রচনা ও রঙের নিটনেস বা অবিমিশ্রতার ওপর। ক্যালিগ্রাফি মূলত বিভিন্ন বর্ণের রূপ ভেঙে চিত্র হিসেবে উপস্থাপন করাকে নির্দেশ করে। সেক্ষেত্রে রেখার ভাঁজ, বর্ণের আকার, সুন্দর রচনা ও ভারসাম্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা চোখকে প্রশান্ত করে। প্রদর্শনীটি দেখে কিছু অনুভূতি হয়েছিল, যা না বললেই নয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন আধুনিক গ্রাফিক ডিজাইনারকে ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, মোশন গ্রাফিক্স, ভিডিও এ্যানিম্যাশনসহ ইত্যাদি নানা কাজে দক্ষ হতে হয়। অথচ আধুনিক ওয়েব ডিজাইন, অ্যাপ ডিজাইন কিংবা ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ‘ইউজার ইন্টারফেস’ ডিজাইনের মতো অগ্রগামী ডিজাইনে ঠিক কতজন ডিজাইনার সিদ্ধহস্ত; এমনকি যদি তা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও চিন্তা করি, সেটি বলা মুশকিল! বর্তমানে গ্রাফিক ডিজাইন এমন একটি শিল্পক্ষেত্র যার পরিব্যাপ্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবশ্যম্ভাবীভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেই গুরুত্বকে বুঝতে হলে বাংলাদেশের গ্রাফিক ডিজাইনকে বৈশ্বিক মানদণ্ডের সমসাময়িক করে তোলা এখন সময়ের দাবি। প্রশাসনিকভাবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত কম্পিউটার ল্যাব, নতুন নতুন নিরীক্ষাধর্মী গবেষণা, ফলো-আপ রিপোর্ট ও সেগুলো মূল্যায়নের জন্য অভিজ্ঞ ব্যক্তি দ্বারা নির্ভুল মূল্যায়ন প্রকাশনা খুবই জরুরী বলে আমি মনে করি। এমনকি, আজকের নতুন সূর্যোদয়ে বিশ্বের অপরপ্রান্তে আবিষ্কৃত সর্বশেষ করণকৌশল যেন শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচীতে প্রতিনিয়ত অন্তর্ভুক্ত হয় সেদিকে বিভাগের নীতিনির্ধারকদের সজাগ দৃষ্টি থাকা বাঞ্ছনীয়। অদূর ভবিষ্যতে যোগ্য নেতৃত্ব দেবার জন্য দরকার কুশলী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। আজকে যারা শিক্ষানবিস, আগামীতে নিঃসন্দেহে তারাই নেতৃত্বে আসবে। সুতরাং, তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ই হতে পারে আগামী দিনের সুন্দর একটি ভবিষ্যত পরিকল্পনার মূল হাতিয়ার। আর সেটিকে বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
×