ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জমজমাট পার্বত্যমেলা শিল্পকলায়

পাহাড়ী সমাজ সংস্কৃতির নানা উপাদান, বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ১০:০৫, ৭ ডিসেম্বর ২০১৯

পাহাড়ী সমাজ সংস্কৃতির  নানা উপাদান,  বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনা

মোরসালিন মিজান ॥ অনেকদিন থেকেই/আমার একটা পাহাড় কেনার শখ/কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না...। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা। প্রিয় পঙ্ক্তিতে ঠিক পাহাড় কেনা নয়, বরং পাহাড়ের প্রতি নিজের গভীর ভালবাসার কথাই জানিয়েছিলেন কবি। আসলেই পাহাড় ভীষণ আলাদা। খুব টানে। আর তাই সুযোগ পেলেই সমতলের মানুষেরা খাগড়াছড়ি বান্দরবান বা রাঙ্গামাটি ছুটে যান। কিন্তু এখন রাজধানী শহরেই দৃশ্যমান হচ্ছে পাহাড়ী জীবন। আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতির নানা উপাদান চাইলেই খুঁটিয়ে দেখতে পারেন আপনি। পাহাড়ের বিভিন্ন সম্প্রদায়, তাদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, কৃষি- সব নিয়ে দারুণ এক মেলা এখন চলছে রাজধানী শহর ঢাকায়। শিল্পকলা একাডেমিতে এ মেলার আয়োজন করেছে পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া মেলা এখন যারপরনাই জমজমাট। আগামীকাল ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস। দিবসটি সামনে রেখেই মেলার আয়োজন। প্রতি বছরের মতো এবারও শিল্পকলা একাডেমির খোলা চত্বর লোকে লোকারণ্য। উন্মুক্ত মাঠে ১০০টির মতো স্টল। এসব স্টলে নানা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, গহনা, গৃহসজ্জা সামগ্রী। আছে নিজেদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য। ফলমূল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। চোখের সামনেই রান্না করা হচ্ছে সুস্বাদু সব খাবার। পিঠা তৈরি হচ্ছে। খাওয়া যাচ্ছে গরম গরম! পোশাকের মধ্যে বিশেষভাবে চোখে পড়ে কোমড় তাঁতে বুনা শাড়ি। পাহাড়ী নারীরা দু’পা লম্বা করে সামনের দিকে ছড়িয়ে দেন। কোমড়ে জড়িয়ে নেন তাঁত। তারপর নিবিড়ভাবে বুনে যান শুধু। স্টলে সাজিয়ে রাখা শাড়িগুলো তাঁতিদের দক্ষতা রুচি ও নিজস্বতাকে তুলে ধরছে। শাড়ির পাশাপাশি পাওয়া যাচ্ছে মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। এই যেমন রিপা হ্যান্ডিক্রাফট নামের একটি স্টলে গিয়ে দেখা গেল, চাকমা মেয়েদের বিখ্যাত পোশাক পিনন। বিক্রেতা তরুণী সুশভা নিজেও তা-ই পরেছিলেন। জামার নিচের অংশটি দেখিয়ে তিনি বললেন, এটাকে বলা হয় পিনন। আর ওড়নার মতো দেখতে ওপরের অংশটিকে বলা হয় খাদি। এটিতে চমৎকার জরির কাজ করা। বিশেষ পোশাকটির দাম অর্ধলাভ বা তারও বেশি হতে পারে বলে জানান তিনি। অন্যান্য স্টলে দেখা গেল পিননের ফর্ম ব্যবহার করে জামা তৈরি করা হয়েছে। বাঙালী ক্রেতারাও এগুলো কিনছেন। ‘স্রাব বৈক সেন্টার’ নামের একটি স্টলে গহনার ভাল সংগ্রহ চোখে পড়ল। স্টলে থাকা তরুণী নির্মলার কাছে প্রথমেই জানতে চাওয়া- স্টলের নামের বাংলা অর্থ কী দাঁড়ায়? উত্তরে তিনি জানান, স্রাব মানে আশীর্বাদ। আর বৈক মানে গাঁদা ফুল। তবে ফুলের মালা নয়, স্টলে বেশি দেখা গেল পুঁথির মালা। বড় করে টানিয়ে রাখা একটি ছবি দেখে বোঝা যায়, অনেক মালা একসঙ্গে গলায় জড়িয়ে নেন পাহাড়ী নারীরা। বেশ লাগে দেখতে। নির্মলা জানান, এর বাইরে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্য মেলায় তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তারা। মেলায় আছে শীতের পোশাকও। পাহাড়ে শীত বেশি অনুভূত হয়। গায়ে দেয়ার শালগুলো তাই বেশ মোটা। ভারি। তবে নরম ও মোলায়েম। হাতে তৈরি শালে সুন্দর কাজ করা। তবে খাওয়া-দাওয়ার আলাদা আনন্দ। পৌষের আগে আগে মেলায় চলছে পিঠা খাওয়ার ধুম। সব পিঠার নামধাম বানান করে লেখা সত্যি মুশকিলের কাজ হবে। তার পরও কিছু নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। চিরুনির মতো দেখতে একটি পিঠার নাম রিফ্রি মুং। কলাপাতা দিয়ে মোড়ানো ফাহ্নক্য। আছে মারমাদের প্রিয় চেঁছমা পিঠা, ক্যাইংকদ মুং, ঘিয়াং মুংসহ আরও কিছু জাত। স্বাদ জানতে পাটিসাপটার মতো দেখতে চেঁছমা পিঠাটি মুখে দিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। তার পর থেকে স্বাদটা যেন মুখে লেগে আছে! কারণ পিঠার বাহিরের অংশটি বিন্নি চালের। আর ভেতরে ঘন করে নারিকেল দেয়া। বিন্নি চালে আরও কয়েকটি পিঠা মেলায় পাওয়া যাচ্ছে। পাহাড়ী খাবারের মধ্যে বিশেষ আলোচিত ব্যাম্বো চিকেন। হ্যাঁ, মাংস প্রস্তুত করে কাঁচা সরু বাঁশের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে কাটা মুখটি কলাপাতা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর চলে যায় চুলোতে। চান্দবী নামের একটি স্টলে গিয়ে দেখা গেল, চোখের সামনে ব্যাম্বো চিকেন বানিয়ে দেখাচ্ছেন পাহাড়ী তরুণীরা। মেলায় কচি বাঁশও রান্না করে নিয়ে এসেছেন অনেকে। পাওয়া যাচ্ছে কাঁকড়া ভুনা। আর পাজন তো সবার চেনা। আছে প্রায় সবকটি খাবারের স্টলে। মেলার একাধিক স্টলে পাওয়া যাচ্ছে পাহাড়ে উৎপাদিত কৃষি পণ্য। লাউ কচু মিষ্টি কুমড়া পেঁপে কলা আনারস জাম্বুরা কাঁঠাল আখ হলুদ মরিচের গুঁড়ো- কী নেই! বিক্রেতারা নিশ্চিত করেই বললেন, এসবের কোনটিতেই ফরমালিন নেই। কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়নি। সবই অর্গানিক। রান্নে নামের একটি স্টলে কথা হয় বিক্রেতা জেনিটের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিদিন রাতে খাগড়াছড়ি থেকে এসব কৃষি পণ্য কিনে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সকালে চলে আসে ঢাকায়। ফলে এগুলো তাজা থাকে। মেলায় মাছ নেই। তবে নানা জাতের শুঁটকি পাওয়া যাচ্ছে। এসব দেখে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের মানুষের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। আর পুরো মেলা ঘুরলে ধারণা হয় আদিবাসী জীবন সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে। পাশাপাশি পাহাড় এবং সমতলের মানুষের মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটিও ঝালাই করার সুযোগ করে দিয়েছে পার্বত্যমেলা। বিশেষ আয়োজন আগামীকাল রবিবার পর্যন্ত চলবে। খোলা থাকছে সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। সন্ধ্যায় থাকছে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ পরিবেশনাও উপভোগ্য খুব।
×