মনোয়ার হোসেন ॥ মায়াবী কণ্ঠস্বরে ভর করে এগিয়ে যায় সঙ্গীতাসর। স্বতন্ত্র গায়কীতে রবীন্দ্রনাথের গানের আশ্রয়ে শ্রোতার অন্তরে মুগ্ধতার বীজ বুনে দেন শিল্পী। ভাললাগার সেই অনুভবে ঝরে পড়ে মিলনায়তন পরিপূর্ণ শ্রোতার করতালি। এভাবেই আপন সঙ্গীতজীবনের কুড়িতম বছর উদ্যাপনের সঙ্গীতাসরে সুররসিকদের হৃদয় রাঙালেন অদিতি মহসিন। সময়ের আলোচিত ও শ্রোতানন্দিত এই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গীত সাধনার দুই দশক পূর্তির সঙ্গীতায়োজনটি অনুষ্ঠিত হয় শুক্রবার। ভেন্যু ছিল রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন। ঘণ্টাব্যাপ্তির সঙ্গীতাসরে গানের ফাঁকে ফাঁকে ছিল কথন পর্ব। নিবন্ধনের মাধ্যমে শ্রোতারা শামিল হন শিল্পীর সাফল্য উদ্যাপনের এই সুর দরিয়া। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে শিল্পী-সাহিত্যিক, নাট্যজনসহ নানা ভুবনের মানুষের উপস্থিতি আলোকিত করেছে আয়োজনকে। দুই বাংলার শ্রোতাকে সুরধারায় প্লাবিত করা শিল্পীর এ সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে ২০ বছর পূর্তি উদযাপন পর্ষদ।
ছয়টা থেকে প্রতীক্ষমাণ শ্রোতারা সন্ধ্যা সাতটায় শুনতে পান অদিতির চর্চিত ও পরিশীলিত কণ্ঠস্বরটি। অনুভূতি প্রকাশে বলেন, আমি মুগ্ধ ও আপ্লুত। আমার সঙ্গীত জীবনের ২০ বছর পূর্তির আয়োজনটিতে যারা এসেছেন আমি তাদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা। একজন শিল্পীর জন্য ২০ বছর খুব বেশি সময় নয়। কিন্তু এই অল্প সময়ে এত মানুষের ভালবাসা পাওয়াটা অনেক বড় প্রাপ্তি। স্বল্পকথন শেষে শুরু করেন পরিবেশনা। বিজয়ের মাসে দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমে পরিবেশনা পর্বের সূচনা। দরদী কণ্ঠে গেয়ে শোনান ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা/ তোমাতেই বিশ্বময়ীর আচল গাঁথা’। সুরের কাছে সমর্পিত কণ্ঠে পরিবেশিত দ্বিতীয় গানের শিরোনাম ছিল ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’। সেই সুর সফরে নিমগ্ন শ্রোতাদের কেউ কেউ কণ্ঠ মেলান শিল্পীর সঙ্গে। মুগ্ধ অনরাগীদের পিনপতন নীরবতার মাঝে শিল্পীর কণ্ঠটি মিলনায়তনে বিরাজ করে মোহাচ্ছন্ন পরিবেশ। হদয় গহীনে কড়া নাড়া কণ্ঠস্বরে তৃতীয় পরিবেশনায় শুনিয়েছেন ‘কোন সুদূর হতে’। এরপর গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদ আঙ্গিকের গান ‘কার মিলন চাও বিরহী’। পঞ্চম পরিবেশনায় গীত হয় ‘আজি বিজন ঘরে’। ষষ্ঠতম পরিবেশনায় শোনান খেয়াল আঙ্গিকের গান ‘কোথা হতে বাজে প্রেম বেদনা’। এরপর পরিবেশিত হয় কীর্তনের সুরে প্রেমের গান ‘হৃদয়ের একূল ওকূল দু’কূল ভেসে যায় হায় সজনী’। এরপর গেয়েছেন নানা ঘাত-প্রতিঘাতে আক্রান্ত রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সে রচিত দুটি গান আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে করবো নিবেদন’ ও চোখের জ্বলের লাগলো জোয়ার’। দুই পর্বে বিভক্ত সঙ্গীতায়োজনের প্রথম পর্বে শিল্পী গেয়েছেন নিজের পছন্দে। সেখানে অধিকাংশই ছিল আনন্দ ও প্রার্থনা পর্বের গান। দ্বিতীয় পর্বে শুনিয়েছেন শ্রোতার অনুরোধের গান।
সঙ্গীতাসরের শুরুতেই অদিতি মহসিনের কুড়ি বছরের সঙ্গীত জীবনের সাধনা ও চর্চার ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। সেই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে জানা যায়, মায়ের অনুপ্রেরণাতেই শিল্পী হিসেবে গড়েছেন বর্তমানের অবস্থানটি। বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশীকোত্তম সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে একক কণ্ঠে গান শোনানোর অনুভূতিসহ শিল্পীর নানা অর্জনের কথা মেলে ধরা হয় তথ্যচিত্রে। ছিল তাকে নিয়ে বিশিষ্টজনদের মূল্যায়ন। সেই সূত্রে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মিতা হক বলেন, অদিতি এখন বিশ্বনন্দিত শিল্পী। তার গাওয়ার ঢংটা একান্তই নিজস্ব।
প্রধান অতিথি হিসেবে সঙ্গীতানুষ্ঠানটি উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাস। সভাপতিত্ব করেন উৎসব উদ্যাপন পর্ষদের সভাপতি রামেন্দু মজুমদার। স্বাগত বক্তব্য দেন উদযাপন পর্ষদের আহ্বায়ক আপন আহসান। এই সন্ধ্যায় শিল্পী অদিতি মহসিন গেয়ে শোনান তার পছন্দের একগুচ্ছ গান । অতিথিদের বাইরে অদিতির সঙ্গীত জীবনের সাফল্য কামনা করে বক্তব্য দেন নজরুলসঙ্গীত শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক, অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অভিনয়শিল্পী ত্রপা মজুমদার।
বিজয়ের মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে শিল্পীকে শুভাশীষ জানিয়ে এইচটি ইমাম বলেন, একটি মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা অতিবাহিত হচ্ছিল। এই বিরতি আমার কাছে অনুষ্ঠানের ছন্দপতন বলে মনে হচ্ছে। কেউ তো বক্তৃতা শুনতে আসেনি, এসেছে গান শুনতে। অদিতি এক অদ্বিতীয় শিল্পী। এর নেপথ্যে রয়েছে শিল্পীর ধারাবাহিকতা। গানের মাঝে সে ডুবে আছে।
রিভা গাঙ্গুলি দাস বলেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক বিস্ময়কর শিল্পী অদিতি মহসিন। সঙ্গীত জীবনের ২০ বছরের মাধ্যমে আজ সে তার জীবনের একটি মাইলফলক স্পর্শ করল। ভবিষ্যতে সে এমন আরও অনেক মাইলফলক স্পর্শ করবে। এছাড়া আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত। কারণ, সে ভারতের আইসিসিআরের স্কলারশিপ পাওয়া শিক্ষার্থী।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, একজন শিল্পীর জীবনের কুড়ি বছর খুব বেশি কিছু নয়। তবে আমরা আনন্দের মাধ্যমে সেই অর্জনটি উদ্যাপনের জন্য এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি।
কথন শেষে অদিতির হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন এইচটি ইমাম। উত্তরীয় পরিয়ে দেয় রিভা গাঙ্গুলী দাস। বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান নিজের আঁকা চিত্রকর্ম উপহার দেন শিল্পীকে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: