ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সারে ভর্তুকি

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

সারে ভর্তুকি

বর্তমান সরকার জনবান্ধবের পাশাপাশি কৃষকবান্ধবও বটে। এতে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই। এরই অংশ হিসেবে সরকার এবার ডাই এ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) সারের দাম প্রতি কেজিতে কমিয়েছে ৯ টাকা। আগে প্রতি কেজি ডিএপি সারের দাম ছিল ২৫ টাকা, এখন কৃষক তা পাবেন মাত্র ১৬ টাকায়। এর ফলে ডিএপি সারে সরকারের প্রতিবছর প্রণোদনা বাবদ ব্যয় হবে ৮শ’ কোটি টাকা, যা মেটানো হবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ ৯ হাজার কোটি টাকা থেকে। সরকার এ নিয়ে অন্তত পাঁচ দফায় সারের দাম কমাল। উল্লেখ্য, সরকার অন্যান্য সারেও প্রতি বছর ভর্তুকি দিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, ডিএপি ইত্যাদি। দেশে কৃষকদের মধ্যে ইউরিয়া সার ব্যবহারের প্রবণতা বেশি, যা কিছুটা ব্যয়বহুল। এর পরিবর্তে ডিএপি সার ব্যবহার করা হলে জমিতে একই সঙ্গে ইউরিয়া ও ফসফেটের জোগান দেয়া সম্ভব হয়। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে, একই সঙ্গে অর্থ ও শ্রমের সাশ্রয় হয়, খাদ্য উৎপাদন বাড়ে। সারের বাইরেও সরকার অন্যান্যভাবেও প্রণোদনা দিচ্ছে কৃষককে। ইতোপূর্বে কৃষিমন্ত্রী ঘোষিত প্রান্তিক ৭ লাখ কৃষকের জন্য প্রায় ৮১ কোটি টাকা মূল্যের প্রণোদনা দেয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক। এর আওতায় দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কৃষককে বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে বীজ, সার ও পরিবহন ব্যয় বাবদ নগদ অর্থ সহায়তা। বিশেষ করে খরিপ মৌসুমে গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম, শীতকালীন মুগ, পেঁয়াজ, তিল ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেয়া হয় এই সহায়তা। দেশের মানুষের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ সুষম খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শস্য বহুমুখীকরণসহ উন্নত ও আধুনিক কলাকৌশল অবলম্বন, উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাত প্রতিস্থাপন, সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনও জরুরী। তবে এবারের অভিজ্ঞতায় বলা যায় যে, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর চাষাবাদের জমির পরিমাণ বাড়ানোসহ হাইব্রিড বীজ সরবরাহ অত্যাবশ্যক ও অপরিহার্য। এর পাশাপাশি আমন মৌসুমকে সামনে রেখে ধানের দাম কমা নিয়েও শঙ্কিত সরকার। সত্যি বলতে কি, দেশে এবার বোরোর বাম্পার ফলন হলেও কৃষক ধান-চালের ন্যায্য দাম পায়নি আড়তদার ও চাতাল মালিকদের কারসাজিতে। সরকারের সংগ্রহ নীতি এবং গোডাউন নিয়ে সমস্যা রয়েছে। যে কারণে গুদাম খালি করতে দরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রির সময় আরও দুই মাস বাড়ানোর কথাও চিন্তা করছে সরকার। এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্যও একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বৈকি। এর পাশাপাশি সরকার আরও ১০ লাখ টন ধান-চাল কেনার ঘোষণা দিয়েছে। বর্তমান জনবান্ধব ও কৃষিবান্ধব সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এটি সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকারও বটে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের লাগসই কৃষিনীতির বাস্তবায়নসহ যথাসময়ে কৃষকের হাতে উন্নতমানের বীজ ধান, ধানের চারা, সেচ সুবিধা, ডিজেল ও বিদ্যুত সর্বোপরি বালাইনাশক পৌঁছে দেয়ায় গত কয়েক বছর ধরে ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশ আজ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যে ভরপুর। কিছু পরিমাণে চাল রফতানিও হচ্ছে বিদেশে। সর্বোপরি দেশের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছে বিশাল পরিমাণের খাদ্য মজুদ, যা অতিক্রম করেছে অতীতের সকল রেকর্ড। খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে ধান-চাল-গম মিলিয়ে খাদ্য মজুদের পরিমাণ ১৮ লাখ ৪৯ হাজার ৪০৬ টন। এর মধ্যে গম ৩ লাখ ২৮ হাজার ৯৮৪ টন এবং চাল ১৫ লাখ ২০ হাজার ৪২২ টন। বর্তমানে দেশে মোট খাদ্য মজুদের ধারণক্ষমতা ২০ লাখ টন। তবে সরকার তথা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নানামুখী আন্তরিক উদ্যোগ সত্ত্বেও দেশের কৃষক প্রায়ই এর ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। সরকার ধান-চালের সংগ্রহ মূল্য বেঁধে দিলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের লোকজন কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান-চাল কেনে না। বরং তাদের সমধিক আগ্রহ মধ্যস্বত্বভোগী ও চাতাল মালিকদের কাছ থেকে ধান-চাল কেনায়। বাস্তবতা হলো, দেশে গত কয়েক বছরে ধান-পাট-ফলমূল-শাক-সবজি, তরিতরকারি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, চা, চামড়া ইত্যাদির উৎপাদন বাড়লেও ত্রুটিপূর্ণ মার্কেটিংয়ের কারণে কৃষক ও উৎপাদক শ্রেণী প্রায়ই বঞ্চিত হয় ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে। এটি সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক যে, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পার হতে চললেও অদ্যাবধি আমরা একটি সমন্বিত ও আধুনিক কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে একদিকে উৎপাদিত ফসল ও পণ্যদ্রব্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় কৃষক, অন্যদিকে সেসব পণ্য উচ্চমূল্যে কিনতে হয় ভোক্তা তথা ক্রেতা সাধারণকে। সে অবস্থায় দেশে ধান-চাল-পাটসহ কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত একটি আধুনিক ও সমন্বিত মার্কেটিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরী ও অপরিহার্য।
×