ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল্লাহ হারুন জুয়েল

অভিমত ॥ নীতি ও নৈতিকতার রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

অভিমত ॥ নীতি ও নৈতিকতার রাজনীতি

৭ জুলাই, ২০১৮। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী নুরুল হক নুরুর বাবা এক সমাবেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তিনি জমি বিক্রি করে আহত নুরুর চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা জোগাড় করেছেন। বছরের ব্যবধানে নুরু আজ ডাকসুর ভিপি। সেই নুরুর ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপে জানা গেল, তিনি ১৩ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজের তদবির করেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের দ্বৈতনীতি ও ডানপন্থা সম্পর্কে সচেতন অনেকেই। নীতি ও নৈতিকতার দোহাই দিয়ে, ছাত্রলীগ-যুবলীগের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার করে, ‘আই হেট পলিটিক্স’-এ বিশ্বাসী প্রজন্ম, তৃতীয় শক্তির স্বপ্ন-বিলাসী ও নামধারী সুশীলদের কাছে যিনি নেতায় পরিণত হয়েছেন, সেই নুরুর মুখোশের আড়ালের চেহারা দেখে ভাবান্তর হবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়! নুরুল হক নুরুর উত্থান কোটা আন্দোলন থেকে। এতে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের সকলেই প্রায় দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কারও বাবা রিক্সাওয়ালা, মাঝি, কেউ ভূমিহীন কৃষক বা মুদি দোকানদার; কারও মা গার্মেন্টস কর্মী বা গৃহকর্মী। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও নীতিবান ও শিক্ষিত হওয়ার মাঝে যে মর্যাদা থাকে, সেটি পরিলক্ষিত হয়নি তাদের কর্মকা-ের কারণে। দেশ ও জাতির মহৎ উদ্দেশ্যের কথা বলে, ‘কোটা সংস্কার চাই’ লেখা গেঞ্জি বিক্রির টাকা থেকে লাভ নেয়ার ঘোষণা, এমন কি, ঈদের জামা ও ইফতারের জন্য অনুদান চাওয়ার প্রবণতা দেখে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন তখন। কিন্তু ডুবন্ত ব্যক্তি যেভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী-সমর্থকদের জন্য নুরুরা ছিল ঠিক তাই। নুরুর ফোনালাপের মাধ্যমে যে বার্তা আমরা পেয়েছি তা খাটো করে দেখার উপায় নেই। প্রচারিত কথোপকথন যে তার, সেটি নুরু স্বীকার করেছেন। খ-িত অংশ প্রচার করা হয়েছে বলে দাবি করে তিনি সাফাইও দিয়েছেন। তবে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে নুরুর সততা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন না তোলার অবকাশ নেই। বিষয়টি ব্যক্তি নুরুর প্রসঙ্গ নয়, ডাকসুর মতো একটি গৌরবময় প্রতিষ্ঠানের যিনি ভিপি, তাকে অবশ্যই কিছু বিষয়ে জবাবদিহি করা প্রয়োজন। ১. নুরুর বাবা একজন মুদিদোকানি। গত এক বছরে এমন কি ঘটেছে যে, তিনি সম্বলহীন অবস্থা থেকে এখন ১৩ কোটি টাকার দূতিয়ালি করছেন এবং পারিবারিক ব্যবসা বলে তার সাফাই দিচ্ছেন? ২. নুরুর কথিত আন্টি ৩০ হাজার টাকা দিয়েছেন বলে ফোনালাপে জানা যায়। কমিশন বাণিজ্য বা আর্থিক স্বার্থ না থাকলে এ টাকা তিনি গ্রহণ করেছেন কেন? ৩. আমি অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, কথিত আন্টি নুরুর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নন। কথিত সেই আত্মীয়ের ঠিকাদারি কাজে সহায়তা করার জন্য যাকে অনুরোধ করেছেন, তারা কারা? নুরুর জন্য ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে, এমন ধনাঢ্য শ্রেণীর সঙ্গে নুরুর যোগাযোগ কত দিনের? ৪. কথিত আন্টি ১৩ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি চাচ্ছেন। অর্থাৎ তিনি সেই কাজের জন্য যোগ্য নন। তার মানে নুরু তদবির করছে এমন ব্যক্তির জন্য, যার সেই কাজের সক্ষমতা নেই। ৫. সহজ ভাষায় নুরু কমিশন বাণিজ্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যে নুরুর চিকিৎসার টাকা ছিল না, তার কথায় এখন গ্যারান্টি দেবে কে বা কেন? ৬. ছাত্রনেতারা যখন ঠিকাদারি, তদবির বা বাণিজ্যিক কর্মকা-ে জড়িত হন, সেখান থেকেই সূত্রপাত হয় বিতর্কের। গত দেড় বছর যাবত যে কারণে ছাত্রলীগের সমালোচনা করেছিলেন, সেই কাজে নিজেই জড়িত হয়ে পড়লেন? ছাত্রলীগ, ছাত্রদলের রাজনীতির সমালোচনা করে নিজেকে কি আদর্শবান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন নুরু? ৭. একজন প্রবাসী নুরুকে আর্থিক সাহায্য দিতে চেয়েছেন। এতে তার করণীয় কিছু নেই, সেটা বুঝলাম। কিন্তু প্রবাসীর কথায় সায় দিয়ে ‘রাজনীতি করতে টাকা প্রয়োজন’ বলে সম্মত হলেন কেন? টাকা গ্রহণে সম্মত না হলে, ‘ফোনে সব কথা বলা যায় না’ বলে মন্তব্য করে ব্যক্তিগত নম্বর দিলেন কেন? আরেকটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিবাহিতদের ছাত্র রাজনীতিতে স্থান হয় না। এর লিখিত কোন নিয়ম না থাকলেও এটিই রাজনীতির সুস্থ ধারা। কিন্তু নুরু ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এই তথ্য গোপন করে। নুরু এখন একই সঙ্গে ছাত্র এবং একজন কন্যা সন্তানের পিতা। থাকছেন একটি বাসা ভাড়া করে। দান-অনুদান ছাড়া তিনি আয়ের অন্য কোন উৎস দেখাতে পারবেন না। কারা এই অনুদান দিচ্ছে তার তালিকা খুঁজলে যাদের পাওয়া যাবে তারা প্রায় সবাই বোধহয় বিএনপি-জামায়াতের হবে। অর্থাৎ তিনি কোন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তাকে এক চোখ দিয়েই দেখতে হবে। আর তা-ই যদি হয় তাহলে সবকিছুতে ছাত্র সমাজের নাম ব্যবহার বা নিরপেক্ষ সাজার ভ-ামি কেন? সচেতন ও বিবেকবান কারও বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় যে, নুরু গং দেশের প্রতিক্রিয়াশীল অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। নুরুদের প্রকৃত চেহারা অনেকে দেখেও না দেখার ভান করতে পারেন। কিন্তু কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ৯৬ সালে ছাত্র শিবিরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী যে প্রচারণা শুরু হয়েছিল, তা পূর্ণতা পায় নুরুদের মাধ্যমে। আমার মতো অনেকের এ ইস্যুতে আপত্তির মূল কারণ ছিল- সুকৌশলে ব্যক্তিস্বার্থের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধকে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে তাদের অপপ্রয়াস। এতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের বেশিরভাগ ছাত্রের বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও নিজেদের দাবি করেছে মেধাবী। কোটা আন্দোলন শুরুর যখন এক মাসও হয়নি, তখন আমি লিখেছিলাম যে, এ চক্রের উদ্দেশ্য ডাকসু নির্বাচন করা। কোটা নেতা রাশেদ, ফারুক ও আতাসহ কয়েকজন নেতা জামায়াত-শিবিরের সক্রিয় অনলাইন এ্যাকটিভিস্ট ছিলেন, এমন প্রমাণও উত্থাপন করেছিলাম। একটি বিষয় সুস্পষ্ট ছিল যে, কতিপয় রাজনৈতিক সুবিধাবাদী ও জামায়াত-শিবিরপন্থী ছাত্রছাত্রীর নেতৃত্বে যে কোটা আন্দোলন সংগঠিত হয়, তার চরিত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে হেয় প্রতিপন্ন করা। ‘আমাদের রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য নেই’, ‘দাবি মানলেই ক্লাসে ফিরে যাব’- ইত্যাদি কথা মুখে বললেও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামের সংগঠন গড়ে তোলা হয়। ফেসবুক গ্রুপের পর কয়েকটি অনলাইন প্লাটফরমও তৈরি করা হয়েছে, যেখানে গত দেড় বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও মিডিয়ার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়েছে, বাদ যাননি প্রধানমন্ত্রীও। পরিশেষে বলতে চাই, নুরুল হক নুরু কোন ছাত্র সংগঠনের নেতা নন। তিনি দেশের শীর্ষ ছাত্র সংসদের ভিপি বা জনপ্রতিনিধি। তার উদ্দেশ্য যে অসৎ ছিল, সেটি কথোপকথনে সুস্পষ্ট। অতএব তার বিতর্কিত কর্মকা- ও নৈতিক স্খলনের জবাবদিহি প্রয়োজন। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×