ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আজ যে সব এলাকা হানাদারমুক্ত

প্রকাশিত: ১২:০৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

আজ যে সব এলাকা হানাদারমুক্ত

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ আজ ৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের এই দিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হানাদারমুক্ত হয়। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের পাঠানো বরিশাল আজ ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস। ’৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের নীরব সাক্ষী নগরীর ওয়াপদা কলোনির টর্চার সেল। যেখানে পাক সেনারা বাঙালী মা-বোনদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাসহ বাঙালীদের ব্রাশফায়ার করে গণহত্যার পর লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে ওয়াপদার পাশর্^বর্তী খালে। আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সেই টর্চার সেল, বাঙ্কার আর বধ্যভূমির ব্রিজটি। যা স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের সেই লোমহর্ষক ঘটনা। যেখানে পা রাখতেই শিউরে উঠছে শরীর। দীর্ঘ বছর অবহেলা আর অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সেই টর্চার সেল ও বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতি বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। তার নিরলস প্রচেষ্টায় ’৭১’র নির্মম নির্যাতনের অবয়ব ফিরিয়ে আনতে নতুন আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে বধ্যভূমি। আর এতে সহযোগিতা করছে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর ও মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধের অবয়ব সাজে সজ্জিত নতুন এই বধ্যভূমির আজ রবিবার ‘বরিশাল হানাদার মুক্ত দিবসে’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উদ্বোধন এবং উন্মুক্ত করবেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে মুক্তিকামী বাঙালীর ওপর গণহত্যা শুরু করে। তবে বরিশালে পাকিস্তানী বাহিনী প্রবেশ করে ২৫ এপ্রিল। ওইদিন গানবোট ও হেলিকপ্টারে করে হানাদার বাহিনীর একাধিক গ্রুপ স্টিমার ঘাট, বিসিক ও চরবাড়িয়া এলাকা দিয়ে শহরে প্রবেশ করে। চরবাড়িয়া থেকে আসা গ্রুপটি লাকুটিয়া সড়ক ধরে শহরে আসার পথে নির্বিচারে বাঙালীকে হত্যা করে। ওই গ্রুপটি সন্ধ্যায় এসে ওঠে নতুন বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে। অন্য দুটি গ্রুপ দখল করে শহরের অশি^নী কুমার টাউন হল ও জিলা স্কুল। পাকিস্তানী সেনাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ওঠে সার্কিট হাউসে। ২৯ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনী শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিপরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা কলোনি দখল করে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। নড়াইল আজ ৮ ডিসেম্বর রবিবার নড়াইলের লোহাগড়া থানা হানাদারমুক্ত দিবস। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান, পতাকা উত্তোলন, র‌্যালি, আলোচনাসভা, দোয়া মাহফিল, শহীদদের কবর জিয়ারতের আয়োজন করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের এ দিনে ৮ নং সেক্টরের অধীনে লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে লোহাগড়া থানাকে পাক হানাদার মুক্ত করেন। দৌলতপুর, কুষ্টিয়া দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর আজ ৮ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর হানাদার মুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে দৌলতপুরকে শত্রুমুক্ত করে থানা চত্বরে বিজয় পতাকা ওড়ানোর মধ্য দিয়ে মুক্তিকামী বীর সূর্য সন্তানেরা দৌলতপুরকে হানাদারমুক্ত করেন। দৌলতপুরকে হানাদারমুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সম্মুখ যুদ্ধসহ ছোট-বড় ১৬টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ সকল যুদ্ধে ৩৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েক’শ নারী-পুরুষ শহীদ হন। ৮ ডিসেম্বর সকালে উপজেলার আল্লার দর্গায় পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস। এদিন পাকহানাদার মুক্ত হয় সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি স্মরণীয় নাম। ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংস হামলার পর ৮ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত পুরো জেলা ছিল রণাঙ্গন এলাকা। ১৯৭১ সালের এদিনে ৯ মাসের যুদ্ধশেষে স্বজন হারানো ব্যথা ভুলে গিয়ে জয়বাংলা স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত রক্তলাল পতাকা উত্তোলন করা হয়। ভালুকা, ময়মনসিংহ ৮ ডিসেম্বর, আজ ভালুকা পাক হানাদারমুক্ত দিবস। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মেজর আফসার বাহিনীর কাছে ১৯৭১’র এই দিনে ভালুকা ক্যাম্পের কয়েক হাজার রাজাকার আলবদর ও পাক সেনার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ভালুকা পাক হানাদার মুক্ত হয়। ব্রিটিশ ভারত সেনাবাহিনীর (অব) সুবেদার তৎকালীন ভালুকা থানা আওয়ামী লীগেরসহ সভাপতি আফসার উদ্দীন আহম্মেদ ৭১ এর ১৭ এপ্রিল ১টি মাত্র রাইফেল ও ৮ জন সদস্য নিয়ে ভালুকার মল্লিকবাড়ি বাজারের খেলু ফকিরের বাড়িতে মুক্তি বাহিনীর একটি গেরিলা দল গঠন করেন। পরবর্তীতে ভালুকা থানা দখল করে ১৫/১৬টি রাইফেল ও একটি এলএমজিসহ প্রচুর গোলাবারুদ সংগ্রহ করেন। এর কয়েক দিনের মাথায় কাউরাইদ হতে খীরু নদী দিয়ে ভালুকা থানায় আসার পথে পনাশাইল নামক স্থানে পাকবাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ একটি নৌকা আটক করে মুক্তিযোদ্ধারা। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে গেরিলা দলটি শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়। সাঘাটা, গাইবান্ধা ৮ ডিসেম্বর গাইবান্ধার সাঘাটা হানাদারমুক্ত দিবস। এ উপলক্ষে রবিবার সকালে উপজেলা পরিষদ চত্বরে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া। পরে সেখান থেকে একটি শোভাযাত্রা বের হয়ে উপজেলা সদরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ এবং আলোচনা সভা। ম্যুরাল চত্বরে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবীর। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানা মুক্ত করার পর ৭ ডিসেম্বর মুক্তিনগর ইউনিয়নের বেলতলী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়। সেখান থেকে ৮ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় সাঘাটা থানা সদর বোনারপাড়ায় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর হামলার পরিকল্পনা করে। এ খবর পেয়ে বোনারপাড়ায় অবস্থানরত হানাদার বাহিনী এবং অবাঙালীরা একটি বিশেষ ট্রেনে করে রংপুরের উদ্দেশে পালিয়ে যায়। পটুয়াখালী ৮ ডিসেম্বর পটুয়াখালী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় পটুয়াখালী জেলা। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও জেলার মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে রয়েছে বিভ্রান্তি। আর যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে শহীদদের গণকবরসহ স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো আজও রয়েছে অরক্ষিত। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টা। পাকহানাদার বাহিনীর অতর্কিত বিমান হামলায় পটুয়াখালী শহরে। নির্বিচারে চলে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে থাকলে ১৮ নবেম্বর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টিতে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে ৭ পাক সেনা নিহত ও আহত হয় আরও বেশ কয়েকজন। পরিস্থিতি বুঝে সেখান থেকে পালিয়ে যায় পাক সেনারা। এই বিজয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আরও বেড়ে যায় তারা বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করে। ৭ ডিসেম্বর তারা হানাদারদের কোনঠাসা করে ফেলে। ওই রাতেই একটি লঞ্চে করে পটুয়াখালী থেকে পালিয়ে যায় পাকবাহিনী। ৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় পটুয়াখালী। মুক্তিযোদ্ধারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। মীরসরাই ১৯৭১ এর ৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের এই অঞ্চল মীরসরাই হানাদার মুক্ত ঘোষিত হয়। একাত্তরের এই দিন সকালে ওয়ারলেস স্টেশন থেকে পাক বাহিনীর একটি জিপ দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে প্রচ- শব্দে ওয়ারলেস স্টেশনটি বিস্ফোরিত হয়। শত্রুর অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পৌঁছে। সকাল ১০টা, বিএলএফ গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় দুই শ’ মুক্তিযোদ্ধা মীরসরাই সদরের পূর্বদিক ছাড়া বাকি তিন দিক ঘিরে ফেলে। বেলা ১১টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে একযোগে আক্রমণ শুরু করে। গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে পাক সেনাদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ বন্ধ হয়ে যায়। সতর্কতার সঙ্গে শত্রুদের অবস্থানে পৌঁছায় মুক্তিযোদ্ধারা। পাক বাহিনী এর আগেই উক্ত স্থান ত্যাগ করেছে এমন নিশ্চিত হলে মুক্তিযোদ্ধারা থানায় প্রবেশ করে পাক সেনাদের আটটি রাইফেল উদ্ধার করে। কালকিনি কালকিনি উপজেলা হানাদার মুক্ত দিবস আজ ৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানী হানাদারদের ওপর। এতে করে পাকহানাদারবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজয় বরণ করে। সেদিন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের তোপের মুখে পরে কালকিনি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। উপজেলা হানাদার মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাস উপজেলার বিভিন্নস্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কয়েকটি মুখোমুখি যুদ্ধসহ ১৫টি দুঃসাহসিক অভিযান চালায়। যেমন উপজেলার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু লালপোল পাকহানাদার বাহিনীর শক্তঘাটিতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালায়। পরে পাকহানাদাররা দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পাকহানাদারবাহিনীর দখলে থাকা উপজেলার করিমগঞ্জবাজার ঘাটি গুড়িয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা।
×