ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রাকৃতির দুর্যোগে টনক নড়ল উন্নত দেশগুলোর

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ৮ ডিসেম্বর ২০১৯

প্রাকৃতির দুর্যোগে টনক নড়ল উন্নত দেশগুলোর

কাওসার রহমান, মাদ্রিদ থেকে ॥ বিশ্বজুড়ে দুর্যোগের তান্ডব মাদ্রিদে জলবায়ু সম্মেলনেও একটি মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় একের পর এক দুর্যোগ আঘাত হানায় উন্নত দেশগুলোরও টনক নড়েছে। প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও এখন বলছে, ‘উই আর ইন’। অর্থাৎ তোমাদের সঙ্গে আমরাও আছি। মাদ্রিদ জলবায়ু সম্মেলনে এ ধরনের একটি স্লোগান উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বেসরকারী খাত ও এনজিওদের পক্ষ থেকে। ট্রাম্প প্রশাসনের কারণে জলবায়ু আলোচনায় সরাসরি তার প্রভাব না পড়লেও পুরো আলোচনার এর একটি ইতিবাচক প্রভাব কাজ করছে। যা মাদ্রিদ জলবায়ু আলোচনা থেকে একটি কার্যকরি ফল বের করে আনতে সহায়তা করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য এবং জলবায়ু বিশেষজ্ঞা ড. আতিকর রহমান বলেন, এবারের জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম পর্বের আলোচনার অর্জন হিসাবে এটিকে দেখা হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে গত দুই বছর ধরে পৃথিবীতে প্রকৃতির যে তান্ডব চলছে তার ফলেই আমেরিকার বেসরকারি খাত এবং এনজিওরাও স্লোগাল তুলেছে, ‘উই আর ইন’। তারা বলছে, আমাদের সরকার নেই, তোতে কী আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। এটা জলবায়ু আলোচনার একটি ইতিবাচক দিক। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বেসরাকারি খাতের বক্তব্য হলো ট্রাম্প প্রশাসন প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তারা কংগ্রেস কিংবা বিচার বিভাগের মতামত নেয়নি। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে নিজ দেশেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আতিক রহমান বলেন, গত দুই বছর ধরে পৃথিবীতে সাইক্লোন, বন্যা, খড়া, দাবানল এত বেশি বেড়ে গেছে যে উন্নত দেশগুলো ভাবতেই পারেনি। আগে উন্নত দেশগুলো ভাবত, তাদের নির্গত কার্বনের কারণে দরিদ্র দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের কার্বনে তারা নিজেরাই যে আক্রান্ত হবে তা তারা ভাবতে পারেনি। তারা এখন অনুধাবন করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা এক ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধির কারণেই পৃথিবীতে দুর্যোগের যে পরিমান তান্ডব চলছে, এই তাপমাত্রা ৩.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেলে কি ভয়াবহ অবস্তা দাড়াবে? উন্নত দেশগুলো ভাবতেই পারেনি বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেলে প্রকৃতি এত রুদ্র মুর্তি ধারণ করতে পারে। ফ্লোরিডার ঘুর্ণিঝড়ে ৬৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। ইউরোপের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ভেনিস বন্যায় ভেসে গেছে। ফলে তাদের বিলাসী কর্মকান্ড যে প্রকৃতি ও মানবজাতির বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে তা তারা অনুধাবন করতে পারছে। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত দেশগুলোর প্রতিনিধিরাও অনুভব করছে। যদিও দরকষাকষিতে গেলে তারা তাদের দেশের স্বার্থে বিরুদ্দে চলে যায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরারি খাত এখন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থায়ন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অর্থায়ন করার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা এখন ট্রেড রিজম করতে চায়। কিয়োটো প্রোটোকলে এই ট্রেড রিজমের কথা বলা হয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রই এই ট্রেড রিজমকে নষ্ট করেছে। এখন তারা অনুভব করছে। তবে এবারের আলোচনার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো এ্যাডাপটেশন কমিটিতে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তভ’চুক্তির আগ্রহ। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছে। কারণ এ্যাডাপটেশন অভিযোজন কমিটি হচ্ছে কিয়োটো প্রোটোকলের বিষয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কিয়োটো প্রোটোকল থেকে বেরিয়ে গেছে। ফলে এই দেশটি কিভাবে এ্যাডাপটেশন কমিটিতে থাকবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য হচ্ছে এই কমিটিতে তারা ভারসাম্য আনতে চায়। বর্তমানে এই কমিটিতে ১২ জন সদস্য আছে উন্নয়নশীল দেশ থেকে এবং ৬ জন সদস্য আচে উন্নত দেশের পক্ষে। এবারের জলবায়ু আলোচনার অন্যতম ইস্যু কার্বন মার্কেটিং। প্যারিস চুক্তির ৬ নম্বর আর্টিকেলে এ বিষয় আছে। এবারের সম্মেলনে কার্বন কেনাবেচার একটি গাইড লাইন তৈরি করার উদ্দেশ্যে আলোচনা চলছে। এ প্রসঙ্গে ড. আতিক রহমান বলেন, চাইলেই কার্বন মার্কেট হবে না। এই মার্কেট তৈরির টাকা দিবে কে? কারা এই বাজার তৈরি করবে, বাজার কিভাবে স্থিতিশীল হবে- এই বাজার থেকে কারা লাভবান হবে এসব বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশ এই বাজার থেকে কতটা লাভবান হবে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই মার্কেট থেকে গরীবের লাভ হবে না। যাদের টাকা আছে তারাই লাভবান হবে। আর লাভবান হবে যারা বেশি কার্বন দুষণ করে, যাদের সক্ষমতা আছে। কারণ তারাই কার্বন বিক্রি করতে পারবে। বাংলাদেশ তো কার্বন দুষণ বেশি করে না, তাহলে বাংলাদেশ কিভাবে কার্বন বিক্রি করব। চীন ভারত বেশি কার্বন দুষণ করে ফলে কার্বন কেনাবেচা থেকে বেশি সুফল তারাই পাবে। প্রকৃত অর্থে কার্বন মার্কেটে আমারা বেশি লাভবান হব না। হিউম্যান মার্কেট তৈরি করতে পারলে আমরা লাভবান হব। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম ইস্যু হলো ক্ষয় ও ক্ষতি বা লস এন্ড ডেমেজ। এবারের সম্মেলনে এই ইস্যুতে কতটা অগ্রগতি হতে পারে এ প্রসঙ্গে ড. রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের লস এন্ড ডেমেজ নিয়ে শুরু থেকেই উন্নত দেশগুলো বিরোধীতা করে আসছে। এবারের সম্মেলনে এ বিষয়ে অগ্রগতি হবে বলে আশা করছি। কিন্তু এ ব্যাপারে উন্নত দেশগুলো কোন টাকা পয়সা দেবে না। তিনি বলেন, এবারের সস্মেলনে কার্বন কমানোর ব্যাপারে সব দেশই সম্মত। তবে কমানোর পরিমান কোন পর্যায়ে হবে তা নির্ধারণই এবারেরর সম্মেলনের প্রধান ইস্যু। গত ২ ডিসেম্বর মাদ্রিদের ২৫তম জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়েছে। গত ৬ দিনের একটানা আলোচনা শনিবার শেষ হয়েছে। আজ রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে আলোচনা বন্ধ থাকবে। সোমবার থেকে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হবে। আর ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে সম্মেলনের ‘হাইলেভেল সেগমেন্ট’। এ সেগেমেন্টে বক্ততৃা করবেন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মোঃ সাহাবুদ্দিন।
×