ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় স্বর্ণপদক জিতে বাজিমাত তীরন্দাজদের

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯

ছয় স্বর্ণপদক জিতে বাজিমাত তীরন্দাজদের

রুমেল খান, কাঠমান্ডু, নেপাল থেকে ॥ নাম তার ইতি, পুরো নাম ইতি খাতুন। কিন্তু যে কীর্তি গড়ছেন, তাতে বলা যায়, এখনই তার ইতি নয়, বরং সূচনা! রবিবার মাত্র ১৪ বছর বয়সী এই কিশোরী তীরন্দাজ জিতে নিয়েছেন দু-দুটি স্বর্ণ পদক। পোখরার রঙ্গশালা আরচারি রেঞ্জে অনুষ্ঠিত তারবাজি প্রতিযোগিতায় এই কীর্তি গড়েন তিনি। তবে একক নয়, যথাক্রমে রিকার্ভ নারী দলগত এবং রিকার্ভ মিশ্র ইভেন্টে। রিকার্ভ নারী দলগত ইভেন্টে ইতির সঙ্গে ছিলেন মেহনাজ আক্তার মুনিরা ও বিউটি রায়। আর রিকার্ভ মিশ্র দলগত ইভেন্টে ইতির সঙ্গে ছিলেন তারকা আরচার রোমান সানা। দুপুরে মিশ্র দলগত ইভেন্টের ফাইনালে রোমান-ইতি জুটি ৬-২ সেট পয়েন্ট ও ৩-১ সেটে হারিয়ে দেন ভুটানের সোনাম দেমা ও কিনলে শেরিংকে। প্রথম সেট বাংলাদেশ জেতে ৩৬-৩৪ ব্যবধানে। দ্বিতীয় সেটে বাংলাদেশ জেতে ৩৭-৩৪ ব্যবধানে। তৃতীয় সেটে হেরে যায় ৩৪-৩৭ ব্যবধানে। এরপর শেষ সেটে তারা জয় পায় ৩৭-৩৪ পয়েন্টের ব্যবধানে। এর আগে সকালে ইতি রিকার্ভ মেয়েদের দলগত ইভেন্ট থেকেও প্রথম স্বর্ণটি জিতে নেন ইতি। মেহনাজ ও বিউটিকে সঙ্গে নিয়ে ফাইনালে ৬-০ সেট পয়েন্টের ব্যবধানে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে অর্জন করেন স্বর্ণ পদক। শ্রীলঙ্কার হয়ে লড়েন থিসারি মাদুশিখা, রেহানা তায়াবালি ও মাইসা দিলহানি। প্রথম সেট ইতিরা জিতে নেন ৫১-৪৭ ব্যবধানে। দ্বিতীয় সেটেও জেতে ৫৩-৪৮ ব্যবধানে। শেষ সেটেও তাই (৫৫-৫২)। ইতি এক বিস্ময়কন্যা। কারণ এত অল্প বয়সে এই আসরে কেউ খেলেনি। বয়স মাত্র ১৪। ওকে চুয়াডাঙ্গা থেকে পেয়েছিল বাংলাদেশ আরচারি ফেডারেশন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আরচারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজিবউদ্দিন আহমেদ চপল বলেন, ‘আমরা ট্যালেন্ট হান্টের মাধ্যমে ইতিকে পেয়েছি। চুয়াডাঙ্গায় যখন আমরা ক্যাম্প করি, তখন আমাদের বোর্ড মেম্বার সোহেল আকরামের সঙ্গে তীরন্দাজ সংসদের কর্ণধার আমার বড় ছেলে রাফি আমাকে বলে, আমরা একটা ভাল মেয়ে পেয়েছি। তার স্কিল অনেক ভাল। তাকে তৈরি করা যাবে। আমি বললাম ঠিক আছে তুমি চেষ্টা কর। আমি কী বলব অবিশ^াস্যভাবে এই মেয়েটি উন্নতি করেছে। আরচারিতে এমনটা এর আগে করেছিল সজীব। আর এবার করেছে ইতি। সজীবের যে গতি এবং মেধাটা ছিল, সেটা ইতির মধ্যেও দেখছি।’ চপল আরও যোগ করেন, ‘ইতি যেভাবে খেলছে, একদিন সে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতে পারবে।’ চাঞ্চল্যকর তথ্য হচ্ছেÑ ইতির বয়স যখন ১১ (২০১৭ সালে), তখন তাকে জোর করে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের আসর থেকে উঠে পালিয়ে গিয়েছিলেন ইতি! কারণ তার স্বপ্ন ছিল পড়াশুনা করা। শনিবার দারুণ এক কীর্তি গড়েন ইতি। ভুটানের আরচার কারমা অলিম্পিক কোয়ালিফাই করেছেন। সম্প্রতি ব্যাঙ্ককে গিয়ে একটি প্রতিযোগিতায় তার কাছে হেরে এসেছিলেন ইতি। শনিবার বাছাইপর্বের খেলায় কারমাকে হারিয়ে কড়ায় গ-ায় প্রতিশোধ নিয়েছেন ইতি, তাকে সরাসরি ৬-০ সেটে হারিয়ে দেন। চপল বলেন, ‘বিয়ে ভ-ুল করে দেয়ার পর ইতি সুযোগ খুঁজছিল। আমাদে ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামটা তার জন্য যেন একটা দারুণ সুযোগ হিসেবে আসে। কিন্তু সে যে ভাল আরচার হবে, তার দাঁড়ানোর স্টাইল দেখেই তখনই আমাদের কোচরা বুঝে গিয়েছিলেন যে তাকে দিয়ে হবে।’ তখন তীরন্দাজ সংসদ ইতিকে তাদের দলভুক্ত করে। তাকে কোচিং করানো হয়। ইতির কোচ ছিলেন নিশীথ দাস। ইতিকে তৈরির করার মূল অবদান তার। তিন বছর হয়েছে আরচারিতে এসেছেন ইতি। এর আগে আন্তর্জাতিক আসরের ফল খুব একটা ভাল ছিল না তার। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে একটা মাত্র ব্রোঞ্জ আছে। তারপরও জার্মানি থেকে ফ্রেডরিক মার্টিন বাংলাদেশে এসে (জাতীয় আরচারি দলের প্রধান কোচ) তো ইতির খেলা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যান। ঘোষণা দেন, ‘ইতিকে আমি গড়ে তুলব।’ রবিবার জোড়া স্বর্ণজয়ের পর ইতি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভাল লাগছে স্বর্ণ জিতেত পেরে। আমরা কখনই আশা করতে পারিনি যে দুটি স্বর্ণ জিতব। একটা পদকের আশা করেছিলাম মাত্র।’ অতীতে কখনোই আরচারিতে স্বর্ণ জিততে পারেনি বাংলাদেশ। এবার ভারত না থাকায় স্বর্ণজয়ের পথ সহজ ছিল। প্রথম স্বর্ণটি রোমানদের হাত ধরেই। আরচারি ডিসিপ্লিনের তৃতীয় দিনে রিকার্ভ পুরুষ দলগত ইভেন্টে ফাইনালে বাংলাদেশ (রোমান সানা, তামিমুল ইসলাম ও হাকিম আহমেদ রুবেল) ৫-৩ সেট পয়েন্টের ব্যবধানে শ্রীলঙ্কার প্রতিযোগীদের হারিয়ে স্বর্ণ পদক জয় করেন। শ্রীলঙ্কার হয়ে লড়েন রবিন কাভিশ, সজীব ডি সিলভা ও সান্দান কুমার হেরাথ। প্রথম সেট বাংলাদেশ জিতে নেয় ৫৫-৫১ পয়েন্টে। দ্বিতীয় সেটে বাংলাদেশ হারে ৫৫-৫৭ তে। তৃতীয় সেটটি বাংলাদেশ জেতে ৫৪-৫১-এ। আর শেষ সেটটি ৫৪-৫৪ তে ড্র হলেও আগেরগুলোতে এগিয়ে থাকার সুবাদে ৩-২ সেটে জিতে যায় বাংলাদেশ। এসএ গেমসে এবারই প্রথম আরচারিতে স্বর্ণ জিতল বাংলাদেশ। এমন সাফল্যের পর রোমান বলেন, ‘ভাল লাগছে। স্বর্ণ জিতে দিন শুরু হলো। এটাতে জেতায় বাকিগুলোতেও আত্মবিশ্বাস পাব। আমরা দশ ইভেন্টেরই ফাইনালে উঠেছি। আশা করছি ভাল করতে পারব।’ গত এসএ গেমসে চোটের কারণে খেলতে পারেননি রোমান। এবার অংশ নিয়ে বাজিমাত করেছেন। রোমান আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে এই আসরকে ধরা হয় অলিম্পিকের মতো। আমরা অন্য বড় আসরে পদক জিততাম না। আমাদের জন্য এটাই সবকিছু। আমাদের এই রেজাল্টের মূল কারিগর হলেন কোচ ফ্রেডরিক।’ রোমান স্বীকার করেন এই আসরে ভারত থাকলে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। ‘তবে তারা থাকলেও আমাদের যে লক্ষ্যটা ছিল, সেটাও পূরণ করতে পারতাম। তাদের চেয়ে আমরা কিন্তু পিছিয়ে নেই। তারা আসেননি বলে আমাদের পথটা একটু সহজ হলেও আমি মনে করি প্রতিপক্ষ যেই হোক তাকে শক্ত ভাবাই উচিত।’ কম্পাউন্ড পুরুষ দলগত ইভেন্টে ফাইনালে বাংলাদেশ (সোহেল রানা, অসীম কুমার দাস ও আশিকুজ্জামান) ২২৫-২১৪ স্কোরের ব্যবধানে ভুটানকে হারিয়ে, কম্পাউন্ড মহিলা দলগত ইভেন্টে ফাইনালে বাংলাদেশ (সুস্মিতা বণিক, সুমা বিশ্বাস ও শ্যামলী রায়) ২২৬-২১৫ স্কোরের ব্যবধানে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে, কম্পাউন্ড মিশ্র দলগত ইভেন্টের ফাইনালে বাংলাদেশ (সোহেল রানা ও সুস্মিতা বণিক) ১৪৮-১৪০ স্কোরের ব্যবধানে নেপালকে হারিয়ে স্বর্ণপদক জয় করে। এবার জানা যাক বাংলাদেশের অন্য আরচারের প্রতিক্রিয়া। বিউটি বলেন, ‘আসলে এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সাফল্য। এর আগে আমরা এসএ গেমসে খেলেছি কিন্তু কোন স্বর্ণ আসেনি। আমাদের এই খেলাটা এমন একটা খেলা যে তিন দিন কিংবা এক সপ্তাহ বিশ্রাম করলে ফর্ম খারাপ হয়ে যায়। এজন্যই আমাদের দীর্ঘদিন অনুশীলনের মধ্যে থাকতে হয়।’ তামিমুল বলেন, ‘অনেক ভাল লাগছে। ২০১৬ আসরেও খেলেছিলাম, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে স্বর্ণ আসেনি। এবারই আমার প্রথম স্বর্ণ। যেভাবে কাজ করে আসছি, তার ফল পেয়ে আমরা খুশি।’ রুবেল বলেন, ‘আমার আন্তর্জাতিক বেশকিছু পদক রয়েছে। তবে এসএ গেমসে এবারই প্রথম গোল্ড জিতলাম। ভাল লাগাটা অন্যরকম। এর আগে ২০১৬ সালে রাশিয়ায় গোল্ড জিতেছিলাম। ইসলামিক সলিডারিটি গেমে রৌপ্য জিতেছি। ফিলিপিন্সে একটা গেমসে ব্রোঞ্জ জিতেছিলাম।’ৃ
×