ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান, কাঠমান্ডু, নেপাল থেকে

ফুটবলারদের কাছে দেশপ্রেম না ক্লাব বড়?

প্রকাশিত: ১২:২৩, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

ফুটবলারদের কাছে দেশপ্রেম না ক্লাব বড়?

২০ বছর আগে নেপালের মাটিতে সামির শাকিরের অধীনে প্রথমবারের মতো যে স্মরণীয় কীর্তি গড়েছিলেন আলফাজ-বিপ্লব-রজনী-হাসান আল মামুনরা, এবার সেই একই মাটিতে জেমি ডের অধীনে সেই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করার ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন জামাল-জিকো-সাদ-জীবনরা। কিন্তু সেটা যেন হেলায় নষ্ট করেছেন তারা। এসএ গেমসের ফুটবলের ফাইনালেই উঠতে পারেননি! এ পর্যন্ত যে ১৩টি এসএ গেমস ফুটবলের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার মাত্র দুটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্বর্ণপদক জিতেছিল তারা (১৯৯৯ ও ২০১০)। দীর্ঘ নয় বছর ধরে তারা শিরোপাবঞ্চিত। ২০১৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত একাদশতম আসরে ফুটবলে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল তাম্রপদক (২০১৯ সালেও তাই)। দু’বার স্বর্ণপদক জেতার পাশাপাশি বাংলাদেশ জিতেছে ৪টি রৌপ্যপদক এবং ৩টি তাম্রপদক। রানার্সআপ হয় ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৯ এবং ১৯৯৫ আসরে। অথচ এবারের এসএ গেমস ফুটবলে বাংলাদেশের শিরোপা জেতার ভাল সম্ভাবনা ছিল বলে ধরে নিয়েছিলেন ফুটবল বোদ্ধারা। কেননা এই আসরে এই প্রথমবারের মতো ভারত ফুটবল ইভেন্টে অংশ নেয়নি। ভারতের অনুপস্থিতি বাংলাদেশকে বিরাট সুবিধা দেবে বলে মনে করছিলেন সবাই। সেই সঙ্গে তারা এটাও ধরে নিয়েছিলেন, ভারতের অনুপস্থিতিতেও যদি বাংলাদেশ এবার নয় বছরের শিরোপাখরা ঘোচাতে না পারে, তাহলে এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, সেই লজ্জার সাগরেই ডুবেছে জেমি ডের শিষ্যরা! অথচ তারা যেন এই লজ্জার সাগরে নিপতিত না হয়, সেজন্য একটা অন্যরকম চেষ্টা করেছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। রবিবার দশরথের রঙ্গশালায় ‘অলিখিত সেমিফাইনাল’ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ দলকে একটি বার্তা পৌঁছে দেয় তারা। জানানো হয়, ‘নেপালকে হারালেই ৪০ হাজার ইউএস ডলার দেয়া হবে পুরো দলকে’। কিন্তু তাতে কোন সুফলই আসেনি! ড্র করা তো দূরে থাক, হেরেই বসে জামালরা। অথচ ওই ম্যাচে জিততে পারলেই নেপালকে দর্শক বানিয়ে ফাইনালে নাম লেখাতে পারত লাল-সবুজরা। ফুটবলপ্রেমীরা প্রশ্ন তুলেছেন, বোনাস ঘোষণার মাধ্যমে যদি জয় কুড়িয়ে নেয়া যাবে, এটা বাফুফের তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। এভাবে ম্যাচ জেতা যায় না। ম্যাচ জিততে হলে চাই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, যেটা তারা গেমস শুরুর আগে পারেনি। বসুন্ধরা কিংস তাদের আট ফুটবলারকে সময়মতো না ছেড়ে প্রথম গ-গোলটা বাধায়। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে ক্লাবটির সঙ্গে বাফুফের বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বন্দ্ব ছিল। সেটারই প্রতিশোধ তারা নিয়েছে তাদের ফুটবলারদের সময়মতো না ছেড়ে এবং জাতীয় দলের ক্যাম্পে না পাঠিয়ে। যে কারণে জাতীয় দলের ব্রিটিশ কোচ জেমি ডে সময়মতো ক্যাম্পই শুরু করতে পারেননি। ফলে তিনি হতাশ হন এবং ছুটি কাটাতে ইংল্যান্ড চলে যান। এ কারণে জাতীয় ফুটবল দলকে একটু আগেভাগেই নেপাল পাঠানোর যে পরিকল্পনা ছিল, সেটা পিছিয়ে যায়। যে ম্যাচে নেপালের কাছে হেরে ফাইনালে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ, সেই ম্যাচের পর নেপালের কোচ কোচ বালগোপাল মহারজন চরম বিস্মিত, ‘এটা আসল বাংলাদেশ নয়। তাদের তো চিনতেই পারছি না!’ কাঠমান্ডুতে আসা বাংলাদেশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবাই বলেছেন অভিন্ন কণ্ঠে, ‘ফুটবলে কেন এমন হলো?’ গোটা আসরে বাংলাদেশের ছন্নছাড়া খেলা দেখে বিশ^াস করতে কষ্ট হয়, এই দলটিই গত এক বছরে অসাধারণ খেলেছে। তারাই বিশ^কাপ বাছাইয়ে কাতারকে কাঁপিয়ে দেয়ার পর ভারতকে তাদেরই মাটিতে রুখে দিয়েছিল। এসএ গেমসের এই অ-২৩ দলে ছিলেন জাতীয় দলের ১৬ ফুটবলার। ৪ ম্যাচে ৩৬০ মিনিট খেলে বাংলাদেশ মাত্র একটি ‘জেনুইন’ গোল করেছে। কেননা মালদ্বীপের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র ম্যাচে মালদ্বীপ আত্মঘাতী গোল উপহার দিয়েছিল বাংলাদেশ। যে ভুটানের কাছে ২০১৬ সালে হেরে নিন্দা কুড়িয়েছিল বাংলাদেশ, এবার এসএ গেমসে প্রথমবারের মতো তাদের কাছেই হেরে সর্বনাশের বীজ রোপণ করে জীবনরা। পরের ম্যাচে কোনমতে মালদ্বীপের সঙ্গে ড্র। তার পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ঘাম ঝরানো জয়ে ফাইনালে যাওয়ার আশা বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু নিজেদের শেষ লিগ-ম্যাচে নেপালকে যেখানেই হারালেই ফাইনালে যাবার হাতছানি ছিল, সেখানে বাজে খেলে হেরেই যায় তারা। একটি ম্যাচেও বাংলাদেশ দলকে জয়ের জন্য খেলতে দেখা যায়নি। কোন ফুটবলারেরই ব্যক্তিগত স্কিল ছিল না। সবাই খেলেছেন আকাশে বল ভাসিয়ে, যেটা বাংলাদেশের খেলার ধরন নয়। মনে হয়েছে তারা যেন শরীর বাঁচিয়ে খেলছেন! এজন্য অভিযোগের আঙুল বেশি তোলা হচ্ছে কিংসের ফুটবলারদের ওপর। ক্লাবের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নেয়া এসব ফুটবলাররা ক্লাবের স্বার্থে গাঁ বাঁচিয়ে খেলেছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেকেই। ১৮ ডিসেম্বর শুরু হবে ফুটবলের নতুন মৌসুম। তার আগে বড় ধরনের ইনজুরিতে না পড়ার জন্যই মাঠে শতভাগ দেননি ক’জন ফুটবলার। আর এসব কিছু টুকে রেখেছেন এক কর্মকর্তা, ‘আমি নিজেও অবাক। এটা কোন ফুটবলই হয়নি। তারা এত বাজে পারফর্মেন্স করবে, বিশ^াসই করতে পারছি না। সব ম্যাচই পর্যবেক্ষণ করেছি।’ এছাড়া ফুটবলারদের জঘন্য খেলা দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন তাদের দেশপ্রেম নিয়ে। এ নিয়ে টানা দুটি এসএ গেমসে স্বর্ণের লড়াই থেকে ছিটকে পড়েছে জেমি ডের দল। আর এই ব্যর্থতার রিপোর্ট বাফুফেতে (ন্যাশনাল টিম ম্যানেজমেন্ট কমিটি) যাচ্ছে। ফুটবলাররা আজ দেশে ফিরবেন। দু’-একদিনের মধ্যেই ব্যর্থতার রিপোর্ট ন্যাশনাল টিমস কমিটির কাছে জমা হবে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা, ‘ন্যাশনাল টিমস কমিটির কাছে একটা রিপোর্ট জমা দিব। আসলে একটা কিছু হওয়ার দরকার। তা না হলে ভবিষ্যতেও ফুটবলাররা এমন শরীর বাঁচিয়ে খেলবে।’ আরও প্রশ্ন উঠেছে ফুটবল দলের লজ্জার এই ব্যর্থতার দায়ভার কে নেবেন? বাফুফে সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন বি বলবেন এখন? কিভাবে ও কোন্ মুখে ২০২২ বিশ^কাপে বাংলাদেশকে খেলতে দেখার স্বপ্ন দেখেন, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে তীব্র সমালোচনার ঝড় শুরু হয়ে গেছে। যে দলটি গত দুই বছরে দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখিয়ে নতুন আলোয় আলোকিত হয়েছিল, সেই দলটিই কিনা হিমালয়ের দেশে করছে অসহায় আত্মসমর্পণ! অথচ তারা যদি এই আসর স্বর্ণ জিততে পারত আর কোন কোন ডিসিপ্লিনে বাংলাদেশ কোন পদকও না জিতত, তারপরও এক ফুটবলেই স্বর্ণ জেতার জন্য বাকি সব অপরাধ ‘মাফ’ হয়ে যেতে পারত!
×