ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এভাবেও ফিরে আসা যায়!

প্রকাশিত: ১২:৩০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

এভাবেও ফিরে আসা যায়!

স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে একজন মানুষ কতটা ধৈর্যশীল আর পরিশ্রমী হতে পারেন, ফাওয়াদ আলম তার বড় উদাহরণ। এক যুগ আগে, ২০০৭ সালে ২২ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় দলে অভিষেক। ২০১৫ পর্যন্ত খেলেছেন ৩ টেস্ট, ৩৮ ওয়ানডে ও ২৪ টি২০। একেবারে খারাপ করছিলেন না। তারপরও বাদ পড়েন দল থেকে। কিন্তু টেস্টে ফিরতে যে এতটা দেরি হয়ে যাবে, সেটি যেমন ফাওয়াদ নিজেও ভাবেননি, ভাবেননি দেশটির ক্রিকেট বিশ্লেষকরাও। তবে ক্রিকেট অন্তপ্রাণ ফাওয়াদ হাল ছাড়েননি। ছাড়বেনই বা কি করে? ক্রিকেটই যে তার ভালবাসা, রুটি-রুজি। ঘরোয়া প্রথমশ্রেণীর ক্রিকেটে বছরের পর বছর, রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, হাঁকিয়েছেন সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি, গড়েছেন রেকর্ডের পর রেকর্ড। অবশেষে দশ বছর পর প্রত্যাবর্তন। যে মিসবাহ-উল হক ছিলেন জাতীয় দলের সতীর্থ সেই তিনি এখন প্রধান কোচ, প্রধান নির্বাচকও! শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে দীর্ঘ দশ বছর পর পাকিস্তানে ফিরছে টেস্ট ক্রিকেট। সেখানেই ডাক পেয়েছেন ৩৪ বছর বয়সী ফাওয়াদ। আভিজাত্যের সাদা পোশাকে পুনর্জন্মের অপেক্ষায় থাকা বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের এ যেন ‘দ্বিতীয়’ অভিষ। ফাওয়াদের যখন টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তখনকার সতীর্থ ইউনুস খান, মোহাম্মদ ইউসুফ, উমর গুল, সাঈদ আজমলসহ বেশিরভাগই এখন সাবেক। কলম্বোয় দ্বিতীয় ইনিংসে খেলেছিলেন ১৬৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। এরপর আর দুইটি টেস্ট খেলেছিলেন, সর্বশেষটি সেই ২০০৯ সালেই। অবশেষে ডাক পেলেন, সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এমন একটি দিনের জন্য প্রায় এক দশকের অপেক্ষা! এ সময়ে কেটেছে কত বিনিদ্রা রজনী! কত উথাল পাতাল- ভিজছে স্মৃতির মেলায়! তবুও হাল ছাড়েননি! দৃঢ় মনোবল, জেদ আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থেকে করে গেছেন নিজের কাজ। তাতে ফল মিলল পাক্কা এক দশক পর, ‘আমার মনে হচ্ছে সামনে আমার অভিষেক। কেননা জাতীয় দলের হয়ে আমি অনেক আগে খেলেছি। টিম ম্যানেজমেন্ট আমাকে সুযোগ দেবে কিনা জানি না। তবে আমি পনেরো জনের স্কোয়াডে থাকতে পেরেই খুশি। তারা যদি আমাকে খেলানোর মতো মনে করে তাহলে আমি ভাল খেলার চেষ্টা করব। কন্ডিশন এবং উইকেট অনুযায়ী সেরা একাদশ মাঠে নামাবে ম্যানেজমেন্ট। আমার এখন এই মুহূর্ত উপভোগ করা উচিত। ইতিবাচক চিন্তা করা উচিত। আমি যদি এখন নেতিবাচক চিন্তা করি তাহলে আমার মনোসংযোগ নষ্ট হবে। আমি এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।’ ভাগ্যবিড়ম্বিত ফাওয়াদ আরও বলেন, ‘অভিষেকে যেভাবে পারফর্ম করেছিলাম, সেভাবেই পারর্ফম করতে চাই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।’ দীর্ঘ দশ বছর ফাওয়াদের জন্য ছিল খুবই কঠিন সময়। পরিবারের সমর্থনের কারণেই একদূর আসতে পেরেছেন বলের জানান তিনি, ‘দশ বছর একটি বড় সময়। এ সময় অনুপ্রাণিত থাকা খুবই কঠিন। তবুও সম্ভব হয়েছে পরিবারের সমর্থনের জন্য। আমার পরিবার সবসময় আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। আজ সুযোগ আমার সামনে এসে ধরা দিয়েছে।’ এত দীর্ঘ সময় জাতীয় দলের বাইরে থাকলেও কখনও ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবেননি ফাওয়াদ। ক্রিকেটই তার আহার জোগায় বলে জানিয়েছেন এই তারকা, ‘কখনও কখনও খুবই সংঙ্কীর্ণ মনে হতো, কেন নাম আসছে না। কিন্তু কখনোই ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার পরিকল্পনা করিনি। কারণ ক্রিকেট আমার রুটি-রুজি। আমার পরিবার এর উপর নির্ভরশীল।’ সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক রশিদ লতিফ ফাওয়াদ আলমকে ডাকেন ‘ফাওয়াদ আমলা’! প্রোটিয়া তারকা হাশিম আমলার মতো তিনিও ঘরোয়া প্রথশ্রেণীতে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, করেছেন সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি, গড়েছেন রেকর্ডের পর রেকর্ড। টেস্ট প্রত্যাবর্তনে ফাওয়াদের কেন দশ বছর লেগে গেল, সেটিই বড় প্রশ্ন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ফাওয়াদ আলম খেলেছেন ১৬৫ ম্যাচ, যেখানে তার ৩৪ সেঞ্চুরির পাশাপাশি আছে ৬০ হাফসেঞ্চুরি। ২৫৮ ইনিংসে করেছেন ১২ হাজার ২২২ রান। লিস্ট ‘এ’ (৫ ওভারের) ম্যাচে ২০৩ ম্যাচে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি রান করার পাশাপাশি করেছেন ৮ সেঞ্চুরি আর ৪০ হাফসেঞ্চুরি। সর্বশেষ ফাওয়াদের ইনিংসগুলো দেখুন: ১১৬, ২১১, ৬৫, ১০৭, ২৯*, ৯২, ১, ১১, ২৬, ৫, ১০০*, ১৮! অবিশ্বাস্য। ২০০৯ সালে ডুনেডিনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছেন ফাওয়াদ। যখন তার বয়স ছিল ২৪, এখন ৩৪। মাঝের এই সময়টাতে ঘরোয়া ক্রিকেটে বলতে গেলে সুপারম্যান হয়ে উঠেছেন তিনি। তার প্রথমশ্রেণীর সাফল্য ঠিক আমলাকেই মনে করিয়ে দেয়। ইংল্যান্ডে হওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন প্রোটিয়া তারকা। ১২৪ টেস্টে ২৮ সেঞ্চুরি আর ৪১ ফিফটিতে তিনি করেছেন ৯২৮২ রান। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৩১১। ১৮১ ওয়ানডেতে রান ৮১১৩। সেঞ্চুরি ২৭ আর ফিফটি ৩৯। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ২৪৩ ম্যাচ খেলে আমলা করেছেন প্রায় ১০ হাজার রান। যেখানে ৩০ সেঞ্চুরির পাশাপাশি আছে ৫২ ফিফটির ইনিংস। আর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ২৩৭ ম্যাচ খেলে করেছেন ১৭ হাজার ৭৬৫ রান। নামের পাশে ৫২ সেঞ্চুরি আর ৮৮ হাফসেঞ্চুরি ইনিংস। ফাওয়াদকে দলে ফেরানোর বিষয়ে প্রধান কোচ ও প্রধান নির্বাচক মিসবাহ বলেন, ‘আমরা বয়সকে গোনায় ধরছি না। আমরা খেলোয়াড়ের সামর্থ্যে বিশ্বাসী। তারা নির্দিষ্ট কন্ডিশনে কেমন পারদর্শী সেটা বিবেচনায় আনছি। এ মুহূর্তে ৬ নম্বরে আমাদের অভিজ্ঞ কাউকে দরকার। ফওয়াদ ফিট আছে। তাই তাকে ডাকা হয়েছে। ওর পারফর্মেন্স শুধুমাত্র এ মৌসুমেই ভাল হয়নি। সে তার পারফর্মেন্সের ধারাবাহিকতা রেখেছে। আগে কি হয়েছে তা আমি বলতে পারছি না। কিন্তু আমরা তার বর্তমান ফর্ম ব্যবহার করতে মুখিয়ে আছি।’Ñযোগ করেন তিনি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেই সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন ফাওয়াদ। সে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের পর নিউজিল্যান্ড সফরে খেলেছিলেন আরেকটি। ৩ ম্যাচে ৪১.৬৬ গড়ে ২৫০ রান- ফাওয়াদের ক্যারিয়ার থমকে গিয়েছিল সেখানেই। এরপর ২০১৫ সালে পাকিস্তানের হয়ে শেষ খেলেছিলেন। সেটি ওয়ানডে ম্যাচে, ঢাকায় বাংলাদেশের বিপক্ষে। তবে ক্রমাগত ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করে গেছেন, নিজের দাবিটা জানিয়ে গেছেন বারবার। এর আগে তাকে দলে না নেয়াতে বেশ সমালোচনার মুখেও পড়েছিলেন তখনকার প্রধান নির্বাচক ইনজামাম-উল-হক। এবার আর অগ্রাহ্য করতে পারেনি পাকিস্তান। দলে ডাক পাওয়ার আগে সিন্ধের হয়ে কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতে ছয় ম্যাচে তিনি করেছেন ৯২, ১, ২৯*, ১০৭, ০, ৬৫ রান। ফাওয়াদকে ফের দলে নেয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে মিসবাহ আরও বলেন, ‘তার পারফর্মেন্স শুধু এক মৌসুমের ব্যাপার নয়। সে কয়েক মৌসুম ধরেই পারফর্ম করছে, গড় ধরে রেখেছে। আমি জানি না অতীতে কী হয়েছিল, তবে আমরা তাকে বিবেচনা করছি এখন। তার ফর্ম কাজে লাগাব আমরা। ওকে নিয়ে আমি আশাবাদী।’
×