ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু আলোচনার অগ্রগতিতে বাংলাদেশ হতাশা প্রকাশ কোন প্রকার বিলম্ব ছাড়াই ৩টি ইস্যু দ্রুত নিম্পত্তির জোর দাবি

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

জলবায়ু আলোচনার অগ্রগতিতে বাংলাদেশ হতাশা প্রকাশ কোন প্রকার বিলম্ব ছাড়াই ৩টি ইস্যু দ্রুত নিম্পত্তির জোর দাবি

কাওসার রহমান, মাদ্রিদ (স্পেন) থেকে ॥ মাদ্রিদে চলমান জলবায়ু আলোচনার অগ্রগতিতে বাংলাদেশ হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে এবারের আলোচনার ৩টি গুরুত্বপূর্ন ইস্যকে কোন অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে কোন প্রকার বিলম্ব ছাড়াই ইস্যু ৩টির দ্রুত নিম্পত্তির জোর দাবি জানিয়েছে। বুধবার বাংলাদেশ সময় সাড়ে ৭টায় সম্মেলনের প্রেস কনফারেন্সরুমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো: সাহাব উদ্দিন এ দাবি জানান। এ সময় তিনি বলেন, ‘মাদ্রিদ জলবায়ু সম্মেলনে গত ৮ দিন ধরে আলোচনায় এখন পর্যন্ত যে অগ্রগিত হয়েছে তাতে আমরা হতাশ এবং উদ্বিগ্ন। আমাদের হাতে আর মাত্র দুই দিন সময় আছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে কোন সমঝোতা না হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।’ মন্ত্রী বলেন, অভিযোজন, প্রশমন ও অর্থায়নের বেশির ভাগ এজেন্ডাতেই কোন অগ্রগতি নেই। যদিও বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডাগুলোতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসতে চাইছেন। আমরা তিনটি ইস্যুতে কোন প্রকার বিলম্ব ছাড়াই সমাধান চাই। এর প্রথমটি হচ্ছে কার্বন হ্রাস সংক্রান্ত আর্টিকেল, প্যারিস চুক্তির অন্যতম এই ইস্যুতে এখন পর্যন্ত কোন সমঝোতা হয়নি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে লস এন্ড ডেমেজ। অভিযোজনের বাইরে লস এন্ড ডেমেজের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পৃথক আর্থিক ম্যাকানিজম প্রতিষ্ঠার প্রধান বিষয়ই এই আলোচনা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি জরুরি ইস্যু। এই ইস্যুটিও এখন পর্যন্ত অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রী বলেন, ‘খুব স্বল্প সময়ে ২৫তম জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের জন্য চিলির প্রেসিডেন্সি এবং স্পেন সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এবারের জলবায়ু সম্মেলনকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরব উপস্থিতিই এর প্রমাণ করে।’ তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তব হুমকি মোকাবেলায় ব্যর্থতার কারণে পৃথিবীতে মারাত্মক সব প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে আমাদের জানিয়েছেন। ফলে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বিশেষ করে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ব্যাপক কমিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহন জরুী হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমরা এখনও শুনেই যাচ্ছি। এই সঙ্কটময় মুহুর্তে কোন ভ’ল করা যাবে না। আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। কারণ বসবাসের জন্য আমাদের রয়েছে একটিই মাত্র পৃথিবী। কোন জাতি কিংবা কেউই এর থেকে রেহাই পাব না। এই অবস্থা চলতে থাকে আজ হোক কাল হোক আমাদের ধংস অনিবার্য।’ তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ নিয়েই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এই কাজটি করছে পরিকল্পিতভাবেই। কারণ এর কোন বিকল্প নেই। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করেই বাংলাদেশ ৮ শতাংশ উচ্চ প্রবৃদ্দি অর্জন করছে। এটা অর্জন করতে হচ্ছে দারিদ্র ও ক্ষুধা দূর করার জন্য।’ বাংলাদেশের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী আরও বলেন, গত এক দশক ধরেই অভিযোজন ও প্রশামন কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ তার বাজেট থেকে প্রতি বছর ১০০ কোটি মার্কিন ডলার করে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে আসছে। খুব অল্প কিছু দেশের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে ৬০ লাখ সৌর বিদ্যুত প্যানেল স্থাপন করেছে। ৪০ লাখ উন্নত রান্নার চুলা বিতরণ করা হয়েছে কার্বন নির্গমন হ্রাস করার জন্য। আমরা জ্বালানি, পরিবহন ও শিল্প খাত থেকে কার্বন নির্গমন হ্রাস করার জন্য এনডিসি অনুমোদন করেছি। আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে আমরা আমাদের কার্বন নির্গমন কমাতে চাই। এ ব্যাপারে উন্নত দেশগুলো ইউএনএফসিসি কনভেনশনের আওতায় অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। ২০১৪ সালের জলবায়ু সম্মেলনে আরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা পূরণে বদ্ধপরিকর। আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমাদের কার্বন নির্গমন উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় কার্বন নির্গনের বেশি হবে না। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ ও সক্ষমতা নিয়ে জলাবায়ু পরিবর্তনের বহুমাত্রিক প্রভাব মোকাবেলা করে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কাছে একটি বিষয় এখনও পরিস্কার নয় যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ব্যাপারে যা করছে তা কী যথেষ্ট?’ মন্ত্রী দুটি সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘দুটি বিষয় এখন আমাদের সামনে বড় হয়ে উঠেছে। একটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে যারা দায়াবদ্ধ তারা কী বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার মতো কার্বন নির্গমন হ্রাস করছে? দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, যে সকল দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ ঝুকির মধ্যে রয়েছে তারা কী পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পাচ্ছে? বৈশ্বিকভাবে আমরা এখনও প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে জরুরি অবস্থা অনুধাবন ও প্রতিশ্রতি থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। যা আমাদের মতো দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাড়াতে পারে।’ এ সময় তিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের কিছু উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশ ক্ল্ইামেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আমারা গ্লোবাল কমিশন অন এ্যাডাপটেশনের আওতায় বাংলাদেশে আঞ্চলিক ক্লাইমেট চেঞ্জ এ্যাডাপটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। আমাদের জাতীয় সংসদ জলবায়ু পরিবর্তনের আসন্ন সঙ্কটকে বিবেচনা করে ‘পার্লামেন্টারি ইমারজেন্সি’ ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো অবস্থা বিবেচনা করে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য বিশ্ববাসীকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে আমাদের জাতীয় সংসদ এই বিবৃতি অনুমোদন করেছে। মানব জাতির টিকে থাকার জন্যই আমরা এসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। মন্ত্রীর বক্তব্য উপস্থাপনের পর পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশের সংসদে পাসকৃত ‘প্ল্যানেটারি ইমারজেন্সি’র বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন। জলবায়ু সংকটের তীব্রতা অনুধান করে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ প্ল্যানেটারি ইমারজেন্সি ঘোষণা করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমাত্রিক প্রভাব থেকে এই গ্রহকে বাচানোর জন্য আর কোন বিকল্প নেই। তিনি অন্যান্য দেশের সংসদকেও বাংলাদেশের দৃস্টান্ত অনুসরণ করে প্ল্যানেটারি ইমারজেন্সি ঘোষণার আহ্বান জানান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সংসদ সদস্য রেজাউল করিম, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব নুরুল কাদের প্রমুখ। এ সময় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য, এনজিও প্রতিনিধি ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায় কমনওয়েলথ বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা অন্য দেশে বিনিময় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে কমনওয়েলথ। বুধবার সকালে বাংলাদেশের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো: সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে কমনওয়েলথ মহাসচিব পেট্রিশিয়া স্কটল্যান্ড এই আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি বলেন, কমনওয়েলথ চারটি বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়। এগুলো হলো জলবায়ু পরিবর্তন, ব্লু ওশেন (নীল সাগর), ম্যানগ্রোভ (জলমগ্ন বন), উপক’লীয় এলাকা। এরমধ্যে ম্যানগ্রোভ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কমনওয়েল তার সদস্য দেশগুলোতে কাজে লাগাতে চায়। এ সময় বাংলাদেশের পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তণ বিষয়ক মন্ত্রী মো: সাহাব উদ্দিন কমনওয়েলথ মহাসচিবের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা অন্য দেশের কাজে লাগলে বাংলাদেশ খুবই আনন্দিত হবে। এছাড়াও কমনওয়েলথ মহাসচিব বাংলাদেশের সোস্যাল ডেভেলাপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জনের অভিজ্ঞতাও অন্য দেশে কাজে লাগানোর ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে সামাজিক খাতের উন্নয়নে অনেক এগিয়ে গেছে। এজন্য তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করেন। এ সময় দ্ইু নেতা ভবিষ্যতে আরও সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব ড. মঞ্জুরুল হান্নান খান উপস্থিত ছিলেন।
×