ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যার কথা অস্বীকার, মামলা খারিজের দাবি সুচির

শেষ দিনের শুনানিতে দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন

প্রকাশিত: ১১:০০, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

শেষ দিনের শুনানিতে দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের (আইসিজে) জেনোসাইড ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার তৃতীয় ও শেষদিনের শুনানিতে দুই পক্ষের আইনজীবীরা তাদের যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচিও দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা গণহত্যার দায় এড়াতে সাফাই গাইতে সেখানে উপস্থিত আছেন। আইসিজেতে শেষদিনের শুনানিতে অংশ নিয়েছেন গাম্বিয়ার আইনজীবী পল রাইখলার। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টার দিকে মামলার শুনানি শুরু হয়। খবর রয়টার্স, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও দ্য সানের। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আউং সান সুচির প্রদত্ত বক্তব্যকে নজিরবিহীন মিথ্যাচার বলে আখ্যা দিয়ে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে আবারও বলা হয়েছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে। মামলার বাদী দেশ হিসেবে গাম্বিয়া যে ৬টি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশনা প্রদানের যে আহ্বান জানিয়েছে তার কোন বিকল্প পথ নেই। অপরদিকে, আন্তর্জাতিক আদালতের বাইরে বৃহস্পতিবার তৃতীয়দিনের মতো বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও রোহিঙ্গা সংগঠনের নেতাকর্মীরা সুচির মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। মার্কিন সিনেটের রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট পার্টির দশ সদস্য এক চিঠিতে নিজ দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়ে সুচি নিজেই তার অবশিষ্ট ভাবমূর্তি ঝুঁকিতে ফেলেছেন বলে বক্তব্য দিয়েছেন। শুনানিতে গাম্বিয়ার পক্ষে আইনজীবী পল রাইখলার বলেন, আদালত নিশ্চয়ই একটি বিষয় লক্ষ্য করেছেন, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি আদালতে রোহিঙ্গা বিশেষণটি ব্যবহার করেননি। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কথা বলতে গিয়ে তাদের মুসলিম হিসেবে তুলে ধরেছেন। মিয়ানমারের আইনজীবী গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য সাতটি নির্দেশকের কথা বলেছেন। যা গাম্বিয়ার আবেদনেও রয়েছে। এগুলো মিয়ানমার অস্বীকার করেনি। মামলার শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে রাখাইনে যেকোন ধরনের সহিংসতা থেকে বিরত রাখতে দেশটির বিরুদ্ধে আদালতের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চেয়েছে গাম্বিয়া। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের গণহত্যার উদ্দেশ্য অস্বীকার করেছে। এর আগে বুধবার আদালতে নিজ দেশের সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে মিয়ানমারের সুচি বলেন, রাখাইনে সন্ত্রাসবাদবিরোধী বৈধ অভিযান পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী। কিন্তু সেখানে কোন ধরনের গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটেনি। তবে রোহিঙ্গারা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন বলে স্বীকার করেন তিনি। সুচির এই যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে গাম্বিয়ার আইনজীবী রাইখলার বলেন, আদালত নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, সুচি তার বক্তব্যের সময় আদালতে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেননি। রাখাইনের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরসার বিষয়ে কথা বলেছেন। এ সময় তিনি তাদের মুসলিম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। গাম্বিয়ার আবেদনে গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণে সাতটি নির্দেশকের কথা উল্লেখ আছে। মিয়ানমারের আইনজীবী অধ্যাপক সাবাস এই সাতটি নির্দেশক অস্বীকার করেননি। মঙ্গলবার আদালতে সাবেক গণতন্ত্রের প্রতীক সুচিকে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধের জন্য বারবার আহ্বান জানায় মামলার বাদী গাম্বিয়া। গাম্বিয়ার আইনজীবী রাইখলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের বক্তব্য ‘ফ্রড’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার নিজেই স্বীকার করেছে যে খুব সামান্য সংখ্যায় উদ্বাস্তু ফিরেছে। মিয়ানমারের আইনজীবী ওকোয়া প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ এবং চীন, জাপান ও ভারতের সহায়তার বিষয়টিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এ দেশগুলো প্রত্যাবাসন চায়। কিন্তু প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব মিয়ানমারের। মিয়ানমার সেটি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আদালত নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আউং সান সুচি আদালতে রোহিঙ্গা বিশেষণটি ব্যবহার করেননি। শুধু বিচ্ছিন্নতাবাদী আরসা গোষ্ঠীর কথা বলার সময় ছাড়া তিনি তাদের মুসলিম হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আদালতের প্রেসিডেন্ট ইউসুফের নেতৃত্বে আদালতের শুনানি শুরু হয়। গাম্বিয়ার পক্ষে আইনজীবী বলেন, প্রথমত মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রতি আচরণে গণহত্যার উদ্দেশ্য অস্বীকার করেছে। দ্বিতীয়ত, গণহত্যার উদ্দেশ্য অনুমান করা হলেও তার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী আদেশ দেয়া যায় না। এরপর গাম্বিয়ার পক্ষে আইনজীবী পিঁয়ের দ্য আর্জেন বক্তব্য দিতে উঠে বলেন, গাম্বিয়া স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই মামলা করেছে। গাম্বিয়া ওআইসির প্রক্সি বা প্রতিভূ হিসেবে মামলা করেনি। গাম্বিয়া ওআইসির সাহায্য চাইতেই পারে। অন্যদেরও সাহায্য চাইতে পারে। সুতরাং গাম্বিয়া ওআইসির সহায়তা নেয়ায় বলা যাবে না যে ওআইসি এই মামলার আবেদনকারী। গাম্বিয়া ওআইসি মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর মামলা করেছে বলে মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকারের দাবি বিভ্রান্তিকর। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ ওআইসির নয়, গাম্বিয়ার। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে গণহত্যার কথা বলেননি বলে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, ওআইসির সিদ্ধান্তে পরই গাম্বিয়া মামলা করেছে কথাটি ঠিক নয়। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘে বক্তব্য দেয়ার পর জাতিসংঘ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে এবং সেই রিপোর্টের তথ্যের ভিত্তিতেই গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে গাম্বিয়া আদালতে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। মিয়ানমারের আইনজীবী স্টকার বলেছেন, কোন অপরাধ যদি ঘটেও থাকে, তাহলে গাম্বিয়ার সেই বিষয়ে মামলা করার অধিকার নেই। মামলা কূটনৈতিক ব্যবস্থায় তার আপত্তির কথা জানাতে পারে, কিন্তু আদালতে আসতে পারে না। স্টকারের এসব বক্তব্য সঠিক নয়। গাম্বিয়া সনদের স্বাক্ষরকারী হিসেবে সনদ লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদনের অধিকার রাখে। এরপর প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডস গাম্বিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেন, ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করছে কি না, সে প্রশ্ন তোলার অধিকার গাম্বিয়ার অবশ্যই রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি অতীতের রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক সনদের অংশীদার হিসেবে অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন করার অধিকার গাম্বিয়ার রয়েছে। গণহত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মিয়ানমারের আইনজীবী সাবাস একটি নতুন আইনগত মান নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন, যেটি পরীক্ষিত নয়। কিছু কিছু কার্যক্রম গণহত্যার নির্দেশিকার ধারণা তৈরি করলেও সব কার্যক্রম গণহত্যার ধারণা প্রমাণ করে না এমন দাবি ঠিক নয়। অধ্যাপক সাবাস শিক্ষাবিদ হিসেবে ২০১৩ সালে গণহত্যা কাকে বলে, তার ব্যাখ্যায় আল-জাজিরাকে কী বলেছিলেন, তা উল্লেখ করে বলেন, তিনি যে মত বদলাতে পারেন না, সে কথা আমি বলব না। উল্লেখ্য মিয়ানমারের আইনজীবী হিসেবে প্রফেসর সাবাস দাবি করেছিলেন যে মিয়ানমারে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু গণহত্যা নয়। গণহত্যার উদ্দেশ্য সেখানে অনুপস্থিত। অন্তর্বর্তী আদেশ পরিস্থিতির জন্য সহায়ক হবে না মিয়ানমারের এমন দাবির জবাব হচ্ছে, আমরা এ কারণেই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছি। বসনিয়ায় আদেশ দেয়ার পরও সেব্রেনিৎসায় যে গণহত্যা হয়েছিল, সেই দৃষ্টান্ত দিয়েই আমরা বলেছি, সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা কেন প্রয়োজন এবং তার বাস্তবায়নের সময় বেধে দেয়া জরুরী। সাবাস তার ২০১৩ সালের সাক্ষাতকারে গণহত্যা প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন বলেছিলেন, সেগুলো যদি আদালত তার নির্দেশে অন্তর্ভুক্ত করেন, তাতে আমরা আপত্তি করব না। গাম্বিয়ার পক্ষে সবশেষে দেশটির আইনমন্ত্রী আবু বকর তামবাদু বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে। গাম্বিয়া প্রতিবেশী না হতে পারে, কিন্তু গণহত্যা সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে গণহত্যা বন্ধ এবং তা প্রতিরোধে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে গাম্বিয়া ওআইসির কাছে সাহায্য চেয়েছে। সার্বভৌম দেশ হিসেবে গাম্বিয়া একা এই আবেদন করেছে। গাম্বিয়া গণহত্যা সনদের রক্ষক হিসেবে এই আদালতের কাছে জরুরী ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশনার দাবি জানাচ্ছে। তামবাদু ছয়টি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেছেন। এরপর আদালত হেগের স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটা (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে দশটা) পর্যন্ত মূলতবি করেছে। গাম্বিয়ার মামলা খারিজ করা হোক ॥ সুচি বৃহস্পতিবার শুনানির শেষ দিনে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি তার চূড়ান্ত বক্তব্যে সম্প্রীতির উদাহরণ দিয়ে বলেন, রাখাইনে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করার কাজ চলছে এবং আমরা তা চালিয়ে যেতে চাই। এসময় মংডু শহরের একটি ফুটবল ম্যাচে হাজির দর্শকদের ছবি দেখান সুচি। তিনি আরও বলেন, আদালতের কাছে আমরা সেই সুযোগ চাই। সামরিক বিচারব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর সুযোগ না দিয়ে তাকে দেশের বাইরে বের করা (আন্তর্জাতিকীকরণ) উচিত হবে না। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করার যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা খারিজ করার দাবি জানান সুচি। আর রাখাইনে গণহত্যার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন তিনি। হেগে শুনানির তৃতীয় ও শেষ দিনে সুচি আদালতের কাছে মামলার তালিকা থেকেও এটি বাদ দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিয়ানমারেও সামরিক অপরাধের বিচার সামরিক বিচার ব্যবস্থায় হয়ে থাকে বলে উল্লেখ করে সুচি বলেন, বুথিডং দ্বিতীয় আরেকটি সামরিক আদালতে বিচার চলছে। ওই বিচারকে বাধাগ্রস্ত করা ঠিক হবে না। সুচির বক্তব্যের পর আদালতের প্রেসিডেন্ট ইউসুফ জানান, খুব শীঘ্রই আদালত তার সিদ্ধান্ত উভয় পক্ষকে জানিয়ে দেবে। তবে কবে আদেশ দেয়া হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন দিন তারিখ ঘোষণা করেনি ১৭ সদস্যের বিচারক প্যানেল। প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা দেয়ার পরই শেষ হয় শুনানি। সুচিকে ১০ মার্কিন সিনেটরের চিঠি রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার পক্ষ নেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচিকে চিঠি দিয়েছেন ১০ জন মার্কিন সিনেটর। তারা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) সুচির দেয়া বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে আদালতকে সহায়তা করার জন্য তাকে অনুরোধ করেছেন। খবর বাংলানিউজের। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা শুরুর প্রেক্ষিতে ১০ মার্কিন সিনেটর মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচিকে চিঠি দিয়েছেন।
×