ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটেনে নির্বাচনে টোরির বড় জয়;###;জনসনের নীতির পক্ষে গণজোয়ার

ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে বাধা কাটল

প্রকাশিত: ১০:৩২, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

  ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে বাধা কাটল

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেন। সেই ব্রিটেনের এবারের নির্বাচনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন খুবই সাধারণ এক স্লোগান দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিলেন। আর তা হচ্ছে, ‘ব্রেক্সিট সম্পন্ন কর’ (গেট ব্রেক্সিট ডান)। আর এখন নির্বাচনে জনসনের কনজারভেটিভ পার্টি যে বড় জয় পেয়েছে তাতে এটি স্পষ্ট যে, ব্রেক্সিটের পক্ষেই সমর্থনের বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়েছে। খবর বিবিসি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও দ্য সানের। স্থানীয় সময় শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ঘোষিত ৬৪৯ আসনের ফলে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি ৩৬৪ আসনে জয় পেয়েছে, যা গতবারের চেয়ে ৪৭ বেশি। আর প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি ৫৯ আসন হারিয়ে পেয়েছে ২০৩ আসন। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের ৬৫০ সংসদীয় আসনের মধ্যে জয়ের জন্য বরিস জনসনের দলের অন্তত ৩২৬ আসন প্রয়োজন ছিল। স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টোরি নেতা জনসনই ডাউনিং স্ট্রিটে থাকছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী জনসন ভোটের এই ফলকে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের জন্য ‘নতুন শক্তিশালী ম্যান্ডেট’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে ব্রিটেনের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন ভোটের এই ফলকে ‘হতাশাজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে তিনি আর পার্টির নেতৃত্বে থাকবেন না। ৬৪৯টি আসনের ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, সব দলের ভোটের হার বাড়লেও সমর্থন হারিয়েছে কেবল লেবার পার্টি। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ভোট এবার গড়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে, অন্যদিকে লেবারের ভোট গড়ে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। ব্রিটেনের তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটসের ভোটের হার সবচেয়ে বেশি ৪ দশমিক ২ শতাংশ বাড়লেও আসন কমে হয়েছে ১১টি। এ দলের নেতা জো সুইনসন নিজেই নির্বাচিত হতে পারেননি। স্কটল্যান্ডে এবারের নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছে স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (এসএনপি)। ৫৯টি আসনের মধ্যে ৪৮টিই জিতে নিয়েছে নিকোলা স্টারজেনের দল। যা গতবারের চেয়ে ১৩ আসন বেশি। এবার ৪৫ দশমিক এক শতাংশ ভোট পড়েছে এসএনপির পক্ষে। আগেরবারের চেয়ে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। এসএনপি নেত্রী স্টারজেন বলেছেন, ভোটের এই ফল স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে দ্বিতীয় গণভোট আয়োজনের পক্ষে একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে। এদিকে হারের ইঙ্গিত আসার পর লেবার পার্টির অভ্যন্তরেও কোন্দল দেখা দেয়। দলের অনেকেই করবিনের পদত্যাগ চাইছিলেন। ২০১৫ সালে দলের দুঃসময়ে হাল ধরা প্রবীণ লেবার নেতা করবিন ভোটার, পরিবার ও বন্ধুদের নির্বাচনে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘লেবারের নীতি’ এখনও জনপ্রিয়। তবু ব্রেক্সিটের পক্ষে সমর্থনের বিশাল ঢেউয়ের কাছে সেই নীতির পরাজয় হয়েছে। আগামীতে আর কোন নির্বাচনে দলের নেতৃত্বে ‘থাকবেন না’ জানালেও করবিন বলেছেন, দলের ভবিষ্যত নির্ধারণের জন্য আলোচনার সময়টায় তিনি দায়িত্ব পালন করে যাবেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ব্রেক্সিট সম্পন্ন করার জন্য তার সরকার নতুন করে শক্তিশালী ম্যান্ডেট পেয়েছে। পশ্চিম লন্ডনের অক্সব্রিজ আসনে জয়লাভের পর শুক্রবার জনসন বলেন, এখনকার পর্যায়ে যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, কনজারভেটিভ সরকার কেবল ব্রেক্সিট কার্যকর করাই নয় বরং দেশকে একতাবদ্ধ করা এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও নতুন করে শক্তিশালী জনাদেশ পেয়েছে। আমি মনে করি এ এক ঐতিহাসিক নির্বাচন। যা আমাদের নতুন সরকারে ব্রিটিশ জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে শ্রদ্ধা দেখানো, পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশকে আরও ভালোর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের জনগণের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়ার সুযোগ করে দেবে। এটাই আমরা এখন করব। কোন টালবাহানা নয়, ৩১ জানুয়ারির মধ্যেই ব্রেক্সিট হবেই। ব্রিটেনের এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি নারী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে বিরোধী লেবার পার্টি থেকে ১০৪ জন নারী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। এদের মধ্যে চারজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নারী প্রার্থী রয়েছেন। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ থেকে ৮৬ জন নারী প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। ৪০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ব্রিটেনে একজন নারী প্রার্থীও জয়লাভ করেননি। তবে ২০১৯ সালে এ সংখ্যা দুই শ’র বেশি হয়েছে। নির্বাচনে জয়ের জন্য বরিস জনসনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। টুইটারে দেয়া এক টুইটে ট্রাম্প লিখেছেন, ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনভাবে নতুন একটি বড় ধরনের বাণিজ্য করতে পারবে। ট্রাম্প উল্লেখ করেন, এই চুক্তি অনেক বড় এবং আকর্ষণীয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউউ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদের জন্য জনগণ জনসনের করজারভেটিভ ফর্মুলাতেই আস্থা রেখেছে বলে নির্বাচনের ফলাফলে মনে হচ্ছে। এই জয়ের ফলে পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করিয়ে নিতে সক্ষম হবেন জনসন। পার্লামেন্টে বেক্সিট নিয়ে সৃষ্ট যে অচলাবস্থার মধ্যে জনসনের প্রধানমন্ত্রিত্ব শুরু হয়েছিল, এবার তার অবসান ঘটবে। এমপিদের বিরোধিতায় ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করতে না পেরে এ বছরই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়া টোরি নেতা টেরেসা মে নির্বাচনে জয়ের খবরে বলেছেন, পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় তিনি খুব খুশি। এই নির্বাচনে ব্রিটেনের মানুষের সামনে একটি প্রশ্ন ছিল- তারা ব্রেক্সিট চায় কিনা। তারা এটাও বুঝতে পেরেছে যে কনজারভেটিভ পার্টি জয়ী হলেই ব্রেক্সিট হবে। পার্লামেন্টে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল এই নির্বাচনের মাধ্যমে তা কেটে যাবে। ব্রেক্সিট হবে এবং এগিয়ে যাবে। ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভ দলের জয় স্পষ্ট হয়ে ওঠায় জনসনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রধান চার্লস মাইকেল। একইসঙ্গে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দ্রুতই ব্রেক্সিট প্রশ্নে ভোটাভুটিতে যাবে- এমনটিই আশা করেন তিনি। শুক্রবার চার্লস মাইকেল বলেন, ইইউ ব্রিটেনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত। লন্ডনকে এ নিয়ে আস্থার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি। ইইউ নেতাদের এক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে মাইকেল সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আশা করি যত দ্রুত সম্ভব ব্রিটিশ পার্লামেন্ট (ব্রেক্সিট) ভোট গ্রহণ করবে। এটি একটি স্পষ্টতা যত দ্রুত সম্ভব পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এবং এমপিদের বিরোধিতার কারণে ব্রেক্সিট কার্যকর করতে পারেনি কনজারভেটিভরা। এ অচলাবস্থা কাটাতেই জনসন আগাম নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে জনসনের নেতৃত্বে ব্রেক্সিট অথবা ইইউ ছাড়ার সিদ্ধান্ত উল্টে দেয়ার মতো আরেকটি গণভোট- এই দুইয়ের মধ্যে একটি বেছে নিতে বৃহস্পতিবার পাঁচ বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো সাধারণ নির্বাচনে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছিল ব্রিটিশ নাগরিকরা। রাতভর গণনা শেষে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টিকে ১৯৮৭ সালের পর সবচেয়ে বড় জয়ের সুখবর এনে দিয়েছে শুক্রবারের ভোর। আর লেবার পার্টির জন্য এসেছে ১৯৩৫ সালের পর সবচেয়ে খারাপ ফল। সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় আসছে সোমবার সামান্য রদবদল আসতে পারে সরকারে। আর তারপর আগামী শুক্রবার পার্লামেন্টে এমপিদের সামনে তোলা হবে ব্রেক্সিট বিল। পার্লামেন্টের অনুমোদন পেলে নির্ধারিত ৩১ জানুয়ারিতেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ ঘটবে। পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়ে ব্রিটেনবাসী। এ জট কাটিয়ে দেশকে জানুয়ারির মধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বের করে আনার (ব্রেক্সিট) পক্ষে জনসনকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা কোন যদি বা কিন্তুরও অবকাশ রাখেনি। তাই ব্রেক্সিট এখন ঝড় পেরিয়ে বন্দরের আলো দেখছে। জনসন ক্ষমতায় ফিরলেই ইইউ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ হওয়া এখন কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার মাত্র। পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় এবং এমপিদের বিরোধিতার কারণে এ পর্যন্ত ব্রেক্সিট কার্যকর করতে না পেরে প্রধানমন্ত্রী জনসন আগাম নির্বাচনের আহ্বান করেছিলেন। এতে কাজও হয়েছে। আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার আগেই জনসনের দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার আভাস নির্ভুল বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। তার মানে জনসন খুব দ্রুতই ইইউর সঙ্গে করা তার ব্রেক্সিট চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করিয়ে নিতে পারবেন। সেটি খুবই আশাব্যাঞ্জক ব্যাপার। তবে হতাশা যে একেবারে দূর হয়ে গেল তাও নয়। কেননা ইইউ থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে এলেও অর্থাৎ ব্রেক্সিট সম্পন্ন হলেও এটি কেবল একটি প্রক্রিয়ার সূচনা মাত্র। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে ব্রিটেনকে পাড়ি দিতে হবে আরও দীর্ঘ পথ। বাস্তবিকভাবে বলতে গেলে, জনসনের ব্রেক্সিট চুক্তি কার্যকর করাটা কয়েক বছরের একটি লম্বা প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য ব্লক হয়ে ওঠা ইইউতে ব্রিটেনের প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে আছে।
×