ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দালালদের আস্তানা গবর্নর হাউস বোমায় লন্ডভন্ড

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

দালালদের আস্তানা গবর্নর হাউস বোমায় লন্ডভন্ড

মোরসালিন মিজান ॥ একাত্তরে আজকের এই দিনে দালালদের সবচেয়ে বড় আস্তানা গবর্নর হাউসে বোমা মারা হয়। বর্তমানে যেটি বঙ্গভবন, তখন সেখানে বাস করতেন পাকি শাসকগোষ্ঠীর নিয়োগ করা গবর্নর ডাঃ এ এম মালিক। দেশী গাদ্দার ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা সেদিন ইঁদুরের মতো গর্তে ঢুকে প্রাণ রক্ষা করতে পারলেও, ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের কাপুরুষতা ও নপুংসক চরিত্র বিশেষ করে প্রকাশিত হয়। এ কারণে আক্রমণের দিন (১৪ ডিসেম্বর) নানা ঘটনা ঘটতে থাকে গবর্নর হাউসে। ১৯৭১ সালের দুর্লভ নথি দলিলপত্র ও পত্রপত্রিকা থেকে সেদিনের ঘটনার খুঁটিনাটি জানা যায়। পাওয়া যায় চমকে ওঠার মতো দারুণ সব তথ্য। তবে পাকি দোসরদের সেদিনের আর্তনাদ, বেঁচে থাকার আকুতি কারও করুণার উদ্রেক করতে পারেনি। বরং ঘটনার কৌতুকপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায় সবখানে। জানা যায়, যুদ্ধ শুরুর মাঝামাঝি সময় ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট আবদুল মোত্তালেব মালিককে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর নিযুক্ত করা হয়। মতিঝিলের গবর্নর হাউসে থেকে পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে যান তিনি। কিন্তু বেশি দূর এগোতে পারেননি তিনি। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে পাকিস্তান বাহিনী। ডিসেম্বরে এসে একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। এ অবস্থায়, ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারত। ক্রমে যৌথ বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে থাকে। ৯ ডিসেম্বর নাগাদ পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রেক্ষাপট রচিত হয়ে যায়। দালাল গবর্নর ডাঃ মালিকের পায়ের নিচ থেকে সরে যেতে থাকে মাটি। ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থের লেখক সিদ্দিক সালিকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ডিসেম্বরের শেষদিকে যৌথবাহিনীর আক্রমণ ও পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য নিয়াজীকে গবর্নর হাউসে ডেকে পাঠান মালিক। নিয়াজী গবর্নরকে পাকবাহিনীর দুর্দশার কথা জানান। দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। তাকে সান্ত¡না দেন গবর্নর। জানান, তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে বার্তা পাঠাবেন যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে। সে অনুযায়ী, ৯ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর মালিক ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠাতে সক্ষম হন। এতে অতি দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান তিনি। উত্তরে ইয়াহিয়া খান গবর্নর মালিক ও নিয়াজীকে তাদের বিবেচনা মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার নির্দেশ দেন। এ অবস্থায় ডাঃ মালিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ১৪ ডিসেম্বর বেলা বারোটায় গবর্নর হাউসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠকে বসেন। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এ খবর পৌছে যায় ভারতীয় বাহিনীর সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লে. কর্নেল পি সি ভাল্লার কাছে। তিনি তৎক্ষণাৎ তা টেলিফোনে এয়ার ভাইস মার্শাল দেবাসেরকে জানান। এমন সময় গবর্নর হাউস আক্রমণ হলে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ক্ষণটি এগিয়ে আসতে পারেÑ এ বিবেচনা থেকে বিমান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় মিত্রবাহিনী। পরিকল্পনা মতো ভারতীয় বোমারু বিমান মিগ টুয়েন্টি ওয়ান থেকে গবর্নর হাউসে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বোমার আঘাতে ভবনের একাংশ বিধ্বস্ত হয়। আতঙ্কত ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। ঘটনার সময় গবর্নর হাউসের ভেতরের বিবরণ পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায়। সেখানে লেখা হয়েছে : ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমাবর্ষণের সময় গবর্নর মালেক তার মন্ত্রিসভা সদস্যদের নিয়ে বাঙ্কারে আটকা পড়েন। ডাক্তার মালেকের স্ত্রী ও তার কন্যা পার্শ্ববর্তী কক্ষে গুটিসুটি মেরে থাকেন। ভারতের মিগ ২১ জঙ্গী বিমানের বোমাবর্ষণে গবর্নর ভবন বিধ্বস্ত হলে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ডাঃ মালেক ওয়েস্টপেপার বাস্কেট থেকে ফেলে দেয়া কাগজ তুলে বলপেন দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পদত্যাগপত্র লেখেন। গবর্নর ডাঃ মালেক তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসন থেকে পদত্যাগপত্র জাতিসংঘ কর্মকর্তা জন কেলি এবং লন্ডনের রবিবাসরীয় পত্রিকা অবজারভারের প্রতিনিধি গ্যাভিন ইয়ংকে দেখান বলেও জানা যায়। সংবাদে লেখা হয়, সারা সকাল ডাঃ মালেক ও তার প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে কিনা এই অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝুলে থাকে। এ বিষয়ে তখনও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। ভারতীয় বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণ অবশেষে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দিল। পরের বর্ণনাগুলো আরও মজার : বেশ রম্য করে লেখা হয়েছে, মুহুর্মুহু রকেট গোলা ও বোমাবর্ষণের প্রেক্ষাপটে পদত্যাগের খসড়া শেষ করে বৃদ্ধ ডাঃ মালেক তার পায়ের জুতো মোজা খুলে অজু করে পরিষ্কার রুমাল মাথায় বেঁধে তার বাঙ্কারের কোনায় সেজদায় অবনত হন। নামাজ শেষ করে ডাঃ মালেক কেলিকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি রেডক্রসের নিরপেক্ষ এলাকা ঘোষণা করা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়ে তার স্ত্রী ও কন্যাকে পাঠাতে পারেন কি না। এর আগে পুলিশের মহাপরিদর্শক এমএ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ উর্ধতন সরকারী কর্মকর্তা ওই হোটেলে আশ্রয় নেন। ডাঃ মালেক চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করেন ভারতীয় সেনাবাহিনী তার মন্ত্রিদের হত্যা করবে কি না। মালিকের লেজ গুটিয়ে নেয়ার ঘটনার উল্লেখ আছে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র’ গ্রন্থ সিরিজেও। সরকারী দলিলে স্থান পাওয়া বর্ণনাটি এরকমÑ ‘পুতুল সরকারের লোভী, ক্ষমতালিপ্সু পালের গোদাটির যখন এই অবস্থা তখন বাংলাদেশের অবস্থায় পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেক। জঙ্গীশাহীর ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস করে একটি বালির প্রাসাদ গড়ে তুলেছিল চিরদিনের বাংলার জাতশত্রু পাক দালাল ডাঃ মালিক। পাকি সুবেদারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে তাঁতের মাকুর মতো নিয়াজী ও রাওফরমান আলী যাতায়াত করছিলেন, ঠিক তখনই কলজের ওপর প্রচ- আঘাত হানেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। চৈতন্যোদয় হলো বাংলার কলংক, জঙ্গীশাহীর পদলেহী তথাকথিত পাকিস্তানী সুবেদার ডাঃ মালিকের। চোখ থেকে ততক্ষণে গ্যালন গ্যালন জল ঝরতে শুরু করেছে। ঢাকার গবর্নর হাউসের ওপর বোমা আর কামানোর গোলা নিক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহাতীভাবে পাক প্রতিরোধের পতন অনুধাবন করেন ডাঃ মালিক। এ পর্যায়ে সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয় : আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির একটি খবরে প্রকাশ, ডাঃ মালিক কাঁপা কাঁপা হাতে তার ও মন্ত্রিপরিষদের পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেছেন। আজ জীবনের শেষপ্রান্তে ডাঃ মালিক নিজের জীবনের চুলচেরা হিসাব কষে দেখছেন। গবর্নর হাউসের বাংকারও আজ নিরাপদ নয়। তাই অতি মূল্যবান নিজের প্রাণটি বাঁচানোর জন্য স্ত্রী-কন্যার হাত ধরে ঢাকা নগরীর অপেক্ষাকৃত নিরাপদও নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। গতকাল অর্ধমৃত অবস্থায় পুলিশ প্রধান এমএম চৌধুরী উচ্চপদস্থ আরও ১৬ সরকারী কর্মচারীকে নিয়ে এখানে আশ্রয় নেয়। জানা যায়, এ এম মালিক শেষ পর্যন্ত প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিলেন। দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ১৯৭৭ সালে মৃত্যু হয় তার।
×