ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ॥ একাত্তরের পোস্টার লিফলেট

প্রকাশিত: ১১:১১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ॥ একাত্তরের পোস্টার লিফলেট

মোরসালিন মিজান ॥ আজকের যুগ ইন্টারনেটের হলেও একাত্তরের ছবি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যত রকমের প্রচার, তার সবই হয়েছিল পোস্টার লিফলেট পুস্তিকাসহ বিভিন্ন প্রচারপত্রের মাধ্যমে। একাত্তর পরবর্তী সময়ে এসব নিয়ে তেমন গবেষণা না হলেও, মুক্তিযুদ্ধের এসব অনন্য দলিল অমূল্য স্মারক হয়ে আছে পোস্টার লিফলেট ও পুস্তিকাগুলোর। অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত প্রচারপত্রই তখন হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের জোরালো ভাষা। কলকাতায় অবস্থিত অস্থায়ী সরকারের দফতর থেকেও এই মাধ্যমে জরুরী বার্তা প্রচার করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যোগানো ও বিশ্বজনমত গঠনে বড় ভূমিকা রাখে এসব ছোট ছোট প্রকাশনা। একইসঙ্গে রণাঙ্গনের বাইরের লড়াইকেও স্পষ্ট করে। ১৯৭১ সালের বিভিন্ন সময়ে লিফলেট পোস্টার পুস্তিকার মাধ্যমে বাঙালী তাদের তুলে ধরার চেষ্টা করে। বিভিন্ন সংঘ সমিতি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। কাজ করে প্রবাসী সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর। সরকারীভাবে প্রকাশিত পোস্টার লিফলেটের একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ এখন ঠাঁই পাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। সংরক্ষণের পাশাপাশি এগুলো নতুন করে ছাপানো হচ্ছে। একাত্তরে এসব পোস্টার বিভিন্ন মাপে বিভিন্ন ধরনের কাগজে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। বেশিরভাগই সাদা-কালো। কিছু আবার রঙিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে এসব লিফলেট পোস্টার ছড়িয়ে দেয়া হতো। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে বহির্বিশ্বে। কলকাতা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন শহরের দেয়ালে দেয়ালে, বাসের গায়ে লেপটে থাকব এসব পোস্টার। মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সবই এসব লিখিত বাণী ও বার্তা বহন করেছেন। ১৯৭১ সালে ভারতের কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের দফতর থেকে বহু পোস্টার ও লিফলেট প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছিল। কলকাতায় পাড়ি জমানো শিল্পীরা এই কাজের পুরোভাগে ছিলেন। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রচার বিভাগ প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন বরেণ্য শিল্পী কামরুল হাসান। সঙ্গে ছিলেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কু-ু ও জহির আহমদ প্রমুখ। মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালীর দাবি দাওয়া তুলে ধরে পোস্টার ইত্যাদি আঁকেন। এসব পোস্টারে জরুরী বার্তা বাণী ছাড়াও থাকত ক্যারিকেচার। অগণিত লিফলেট পোস্টারের কিছু এখনও বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষিত আছে। স্বতন্ত্র ভাষায় সেগুলো তুলে ধরছে মুক্তিযুদ্ধ ও মৃক্তিযুদ্ধের জানা অজানা ও অল্প জানা ইতিহাস। একাত্তরে প্রকাশিত পোস্টারগুলোর ভাষা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশে অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধুই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান অনুপ্রেরণা। বহু পোস্টারে লিফলেটে খুঁজে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। তাঁর নির্দেশনা। তেমন একটি পোস্টারের দেখা যায়, পুরো জমিনজুড়ে মুজিবের প্রতিকৃতি। তর্জনী উঁচিয়ে বাঙালীর উদ্দেশে অবিসংবাদিত নেতা বলছেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম... রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব...ঘরে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ সাত মার্চের ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ এসব নির্দেশ দিয়েছিলেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। কারা ঐতিহাসিক ভাষণ মুক্তিকামী মানুষকে আন্দোলিত করেছিল, সাহস যুগিয়েছিল। একই উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত পোস্টারে ভাষণটির মূল ভাব উদ্ধৃত করা হয়। কার ডাকে নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল বাঙালী, কে ছিলেন স্বাধীনতার মহানায়ক, আজও যেন সেই সাক্ষ্য দেয় এসব পোস্টার। ‘জয় বাংলাদেশ জয় মুক্তিবাহিনী’ শিরোনামের একটি লিফলেটে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি উদ্ধৃতি খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে তিনি প্রচা- আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তির অদম্য স্পৃহাকে কিছুতেই নিভিয়ে দেয়া যাবে না। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরেরা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সম্মানের সঙ্গে স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য আমরা সবাই প্রয়োজন হলে জীবন দিতে প্রস্তুত। যতদিন পর্যন্ত না আমরা আমাদের মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছি ততদিন আমাদের সংগ্রাম চলতেই থাকবে।’ অন্য একটি পোস্টারের শিরোনাম ‘আমাদের লক্ষ্য।’ এখানে বাঙালী নেতার বাণী তুলে ধরে বলা হয়, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সংকল্পবদ্ধ মানুষের কাছে অত্যাচারী শক্তি পরাজিত ও পরাভূত হতে বাধ্য। কিছু প্রচারপত্রে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দেয়া জরুরী বার্তা। ‘পাকিস্তান আজ মৃত’ শিরোনামে ছাপা পোস্টারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলছেন, পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার আশ্রয় নিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান নিজ হাতে পাকিস্তানের কবর খুঁড়েছে, এ কথা তার বোঝা উচিত।’ যুদ্ধ জয়ের বিষয়ে বাঙালীর আত্মবিশ্বাস কত প্রবল ছিল তাও বোঝা যায় এ প্রচারপত্র থেকে। ‘বিজয় আমাদেরই’ শিরোনামে ছাপা প্রচারপত্রে তাজউদ্দীনকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। পৃথিবীর কোন শক্তিই এই নতুন জাতিকে বিলোপ করতে পারবে না। দু’দিন আগে হোক বা পরেই হোক পৃথিবীর ছোট বড় সকল শক্তিই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে অবশ্যই স্থান দেবে। একাত্তরের লিফলেট পোস্টারে মুক্তিযুদ্ধের কারণগুলোও তুলে ধরা হয়। তেমনি একটি পোস্টারে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক নীতি সহজ ভাষায় স্পষ্ট করা হয়। পোস্টারের উপরের অংশে বড় করে লেখা হয় ‘সোনার বাঙলা শ্মশান কেন।’ আর নিচে দেখানো হয় প্রতিটি খাতে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় কত কম বরাদ্দ পেয়ে আসছিল পূর্ব পাকিস্তান। বরাদ্দের অঙ্ক পাশাপাশি লিখে তুলনামূলক আলোচনার সুযোগ করে দেয় পোস্টারটি। পোস্টারের দিকে কিছু সময় তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়, কীভাবে শ্মশানে পরিণত হয়েছিল সোনার বাংলা। বেশ কিছু পোস্টার লিফলেট হানাদার পাক বাহিনীর নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরে। খুব আলোচিত একটি পোস্টারে ইয়াহিয়া খানকে উপস্থাপন করা হয় নরপশুর চেহারায়। এই বর্বর জেনারেলের নির্দেশে ’৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ। ইয়াহিয়ার দিকে তাকিয়ে তাই শিল্পী কামরুল হাসান মানুষের মুখ দেখেননি-জানোয়ার দেখেছিলেন। ইয়াহিয়ার ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশে তার দাঁত ও চোখ তিনি এঁকেছিলেন লাল রঙে। বাকি অংশে ব্যবহার করেছিলেন কালো। উপরে নিচে লিখেছিলেন, ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে।’ মাত্র দুই রঙে সহজ করে আঁকা ক্যারিকেচারটি পরে শুধু ইয়াহিয়ার নয়, পাকি শাসকগোষ্ঠীর প্রতীকী উপস্থাপনা হয়ে উঠেছিল। ভেনিজুয়েলার ক্যাথলিক দৈনিক ‘দ্য রিলিজিয়ন অব ক্যারাকাস’র বক্তব্য স্থান পায় একটি পোস্টারে। সেখানে লেখা হয়, ‘এই বীভৎস নিধনযজ্ঞ, এই নৃশংসতম হত্যাকা-ের সামনে অন্য সব নৃশংসতাই ম্লান হয়ে গেছে। গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার কলঙ্কময় ইতিহাস খুঁজলে হিটলারের নিধন শিবির, চেঙিস খান কিংবা তৈমুর লঙের নৃশংসতার কাহিনীতেও এরূপ হত্যাকা-ের মিল পাওয়া দুষ্কর হবে।’ বক্তব্যের সঙ্গে মিল রেখে পোস্টারে ইয়াহিয়ার আরেকটি কাটুন আঁকেন পটুয়া কামরুল হাসান। এতে দেখা যায় বাঙালীর কঙ্কাল ও হাঁড়গোড়ের স্তুূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানী জেনারেল। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন আর সাহসের কথাও জানা যায় পোস্টার লিফলেট থেকে। শিল্পী নিতুন কু-ুর আঁকা একাধিক পোস্টারে মুক্তিযোদ্ধার মুখ ফুটে ওঠে। এই মুখ সাহসী। দেশরক্ষার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। শিল্পী তাই ছবির নিচে লিখে দিয়েছেন, ‘সদাজাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী।’ এই বাহিনী কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল তা জানা যায় আরেকটি পোস্টার থেকে। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক সবাই আজ মুক্তিযোদ্ধা।’ পতাকার লাল সবুজে লেখা অন্য একটি পোস্টারে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার আহ্বান জানিয়ে লেখা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করুন। এরা আপনাদেরই সন্তান।’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্ম থাকবে কিনা, থাকলে সেটি কী হবে তারও উল্লেখ পাওয়া যায় পোস্টারে। একটি পোস্টারে সকল ধর্মের উপাসনালয়ের ছবি পাশাপাশি আঁকা। তাতে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছেÑ ‘বাংলার হিন্দু/বাংলার খ্রীস্টান/ বাংলার বৌদ্ধ/ বাংলার মুসলমান/ আমরা সবাই বাঙালী।’ এভাবে মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক ওঠে আসে পোস্টার-লিফলেট-প্রচারপত্রে। ওই সময়ের অনন্য দলিল হয়ে ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একাত্তরের এই শৈল্পিক প্রয়াস সম্পর্কে জানতে কথা হয় বরেণ্যশিল্পী হাশেম খানের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী শিল্পীরা একাত্তরে নিজেদের করণীয় ঠিক করেছিলেন। সে অনুযায়ী লিফলেট পোস্টার ইত্যাদি আঁকার কাজ করেন তারা। এসব শিল্পকর্মে দেখার মধ্য দিয়ে সময়কে দেখা যায়। অল্প পরিসরে হলেও, জানা যায় ইতিহাসকে। পোস্টার লিফলেটের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডাঃ সারওয়ার আলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নানা মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। একই প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় পোস্টার লিফলেট পুস্তিকা ও প্রচারপত্রে। যুদ্ধদিনের অনেক খুঁটি নাটি এ মাধ্যমে ওঠে এসেছে। আজকের দিনে প্রকাশনাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। তবে এগুলো নিয়ে বিশেষ কোন গবেষণা হয়নি। এ কাজটির উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, গবেষণা হলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসগুলো থেকে ইতিহাসের অনেক বড় উপাদান উদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে।
×