ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আসাদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা

প্রকাশিত: ১১:১২, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯

আসাদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে রিপোর্ট প্রকাশ করায় দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক আবুল আসাদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। মামলায় সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলায় আটক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। রিমান্ডে নিয়ে আবুল আসাদকে প্রকাশিত রিপোর্টের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এদিকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে রিপোর্ট প্রকাশ করায় সংগ্রাম পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানসহ সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা এমন প্রতিবেদনের কড়া সমালোচনা করে পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ‘মিরপুরের কসাই’ খ্যাত কাদের মোল্লার ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। মৃত্যুদ- কার্যকরের ছয় বছর পূর্তি ছিল ১২ ডিসেম্বর। এদিন জামায়াতের দৈনিক সংগ্রামের প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনামে উল্লেখ করা হয়, ‘শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার ৬ষ্ঠ শাহাদাত বার্ষিকী আজ’। গত ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার বিকেলে এই রিপোর্টের প্রতিবাদে বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামে সংগঠনের ব্যানারে শত শত মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পক্ষশক্তির লোকজন মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকায় সংগ্রাম কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। বিক্ষোভকারীরা পত্রিকার কয়েকটি কপি পুড়িয়ে দেন। এক পর্যায়ে নিরাপত্তার স্বার্থে পত্রিকার প্রধান গেট তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়। পরে সেখানে ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে। বিক্ষোভকারীরা পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। শুক্রবার রাতেই পত্রিকার সম্পাদক আবুল আসাদকে পুলিশী হেফাজতে নেয় হয়। শুক্রবার রাতেই ঢাকার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আফজাল হাতিরঝিল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন। মামলাটি থানা পুলিশ আমলে নিয়ে রাতেই পুলিশী হেফাজতে থাকা আবুল আসাদকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলার বাদী তার দায়েরকৃত এজাহারে বলেছেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করে উস্কানিমূলক তথ্য প্রচার করে, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে ও সংবিধানকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছ। মামলায় পত্রিকাটির প্রধান প্রতিবেদক বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সাদাত হোসেনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৬/৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) গোলাম আজম জানান, ওই মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আবুল আসাদকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে সোপর্দ করা হয়। বিচারক শুনানি শেষে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে আবুল আসাদকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এদিকে হাতিরঝিল থানার ওসি আব্দুর রশীদ জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি আপাতত হাতিরঝিল থানা পুলিশ তদন্ত করছে। তবে এ মামলার তদন্তভার শেষ পর্যন্ত পুলিশের অন্য কোন সংস্থা, যারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ভাল কাজ করে তাদের কাছে হস্তান্তর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার জানান, মামলাটি তারা তদন্ত করছেন। সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে। ভাংচুরের নেপথ্যে কোন কারণ আছে কিনা তার তদন্ত চলছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ লেখায় সংগ্রামের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। শনিবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী বধ্যভূমিকে শ্রদ্ধা জানানোর পর মন্ত্রী সাংবাদিকদের আরও বলেন, ওরা একাত্তর সালে যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে, তা এখনও অব্যাহত আছে। এ ঘৃণ্য কাজের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এদিকে ঢাকা ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি কার্যকর হওয়া কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ বলায় চরম প্রতিবাদ জানিয়েছেন। শনিবার রাজধানীর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, সেই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হয়েছে এবং তাদের কোনক্রমেই ‘শহীদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করার যে ধৃষ্টতা দেখিয়েছে এটি ঘৃণা করা এবং প্রতিবাদ জ্ঞাপনের কোন ভাষা আমাদের জানা নেই। ভবিষ্যতে আর এমন ধৃষ্টতা কেউ যেন আর না দেখায়। তিনি বলেন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যাতে এ ধরনের আস্ফালন, এ ধরনের ধৃষ্টতা যেন আর কেউ কখনও দেখাতে সাহস না পায় সেটিই হবে আজকে আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের দৃঢ় প্রত্যয়। আমাদের সৌভাগ্য, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে একটি বড় আকারের জাগরণ ঘটেছে। নতুন প্রজন্ম তাদের মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিক এবং উদারনৈতিক মূল্যবোধ ক্রমান্বয়ে গভীরভাবে প্রবেশ করছে। সেটি আমাদের শক্তির একটি বড় উৎস। আশা করব, তরুণ প্রজন্ম এ জিনিসগুলো তাদের যে মনোবল, তাদের যে দৃঢ়তা এবং তাদের যে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সেটি দ্বারাই এ ধরনের অপশক্তিসমূহ আর কখনোই এ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, আমরা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। শহীদের একটা সংজ্ঞা আছে। যাকে তাকে শহীদ বলা যায় না। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম ফয়সল চিশতী, আলমগীর সিকদার লোটন, নাজমা আখতার এমপি, রওশন আরা মান্নান এমপি, ইকবাল হোসেন রাজু, নুরুল ইসলাম নুরু, আমানত হোসেন আমানত, আহসান আদেলুর রহমান এমপি প্রমুখ। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, ‘রাজাকার কীভাবে শহীদ হয়। তীব্র ভাষায় ধিক্কার ও নিন্দা জানাই।’ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল জানান, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে শহীদ বলার মাধ্যমে তারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদদের অবমাননা করেছে। দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত করেছে। তারা সরকারীভাবে পত্রিকাটি বন্ধের দাবি জানান। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ (ঢাবি) শাখার সভাপতি মাহমুদ জানান, বিজয়ের মাসে একজন রাজাকার, দেশদ্রোহী কাদের মোল্লাকে সংগ্রাম পত্রিকা ‘শহীদ’ অভিহিত করে সংবাদ প্রকাশ করে। তারই প্রতিবাদে পত্রিকা অফিসের সামনে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এমন ঘৃণ্য কাজের জন্য পত্রিকা সম্পাদককে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
×