ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

ইটের তৈরি সোনারগাঁ

প্রকাশিত: ১০:০৮, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

ইটের তৈরি সোনারগাঁ

সেদিন ছিল শুক্রবার। আদি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ হাম্মাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ৯২ ব্যাচ বন্ধুদের বার্ষিক বনভোজন। কিন্তু আগের রাত হতেই বৃষ্টি শুরু। যা পরদিন ভোরে মূষলধারে ঝরে। মধ্য পৌষে বর্ষার বৃষ্টি। ঘরের বাইিরে কনকনে ঠা-া। তবুও দমিয়ে রাখতে পারেনি বৈরী প্রকৃতি। শৈশবের বন্ধুত্বের টানে লেপ-কম্বলের ওম ছেড়ে ছুটলাম, গাড়ি ছাড়ার স্থান বংশাল। নির্ধারিত সময় হতে প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরিতে পৌঁছি। গিয়ে দেখি সবাই হাজির। কা-জ্ঞানহীনতার কারণে নিজেকে অপরাধী ভাবতে চাইলেও, সে সুযোগ দেয়নি সতীর্থদের তেমন কেউ। ধন্যবাদ আয়োজক বন্ধু লেলিন। ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা, অপেক্ষায় থাকা নাছোড় বান্দা দোস্তদারদের প্রতি। ঘড়ির কাটা দশটা ছুঁই ছুঁই। বাস ছাড়ল বর্তমান রাজধানী হতে বাংলার সাবেক ঐতিহাসিক রাজধানী সোনারগাঁয়ের পথে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি ছুটতে ছুটতে, দেড় ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাই একদা বারো ভূইয়াদের রাজত্বে। নির্ধারিত স্পটে ঢুকে, সবাই পরটা-ভাজি ভক্ষণে ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। সেই সঙ্গে চলে সায়েম, মো. আলী ও ফরিদের অ্যারাবিক ডেন্স। নাশতা সেরে ঢুঁ মারি বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের বিশাল আঙিনায়। প্রথমেই চোখে পড়ে বড় সর্দারবাড়ি। এরপর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের করা ঐতিহাসিক গরুগাড়ির সংগ্রামী ভাস্কর্য। ক্লান্তি দূর করে দেয়ার মতো চারপাশে নানা ফুলের সৌরভ। কিছুটা এগিয়ে আমি আর মেহেদি বড় সর্দারবাড়ি প্রবেশ করি। সংস্কার কাজের প্রয়োজনে দীর্ঘদিন বন্ধ রাখার পর, ২০১৮ সালের ১ নবেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্ভাধন করেন। বর্তমানে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য, প্রবেশ ফির বিনিময়ে পর্যবেক্ষণের সুবিধা রয়েছে। ভেতরটা বেশ সাজানো-গোছানো। দেখে মনে হয়, এখনও বাড়ির হর্তা-কর্তারা জীবিত। ১০০ টাকার প্রবেশ ফির টিকেটে ৩০ মিনিটের সময় বাধা। তাই দ্রুত দেখতে থাকি। বড় সর্দারবাড়ি মুঘলস্থাপত্য, বারোভূইয়া অলঙ্করণশৈলী, ব্রিটিশ কলোনিয়াল ও হিন্দু স্থাপত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেয়ালের কারুকার্য ও আসবাবপত্র, সব কিছুই চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের। ভবনটি চারটি জেনারেশনের স্থাপত্যশৈলী দেখার জন্য, বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক বিরল স্থাপনা। যা বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের অহঙ্কার। ভবনের বিভিন্ন কক্ষে কাচের শোকেসে থরেথরে, অনেক কিছুই সাজানো। রয়েছে পালং ও ড্রেসিং টেবিল। বেশ ভাল লাগে মাটির মটকাগুলো দেখে। কিন্তু আফসোসের বিষয়, কোন কিছুর সঙ্গে কোন তথ্য লেখা নেই। দ্বিতীয় তলায় যাবার সিঁড়িটাও আটকানো। বাড়ির সামনে সুদৃশ্য লেক সাদৃশ্যের পুকুর। রয়েছে অশ্বারোহী ভাস্কর্য। বড় সর্দারবাড়ির শেষ জমিদার ছিলেন শ্রীশ্রী গুপীনাথ সর্দার। ভ্রমণগল্প লেখার স্বার্থে পরবর্তীতে তথ্য পেলাম, বাড়িটির মোট ২৭ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ভবনের নিচতলায় ৪৭ টি ও দোতলায় ৩৮ টি ঘর রয়েছে। কিন্তু আমার চোখে তা পড়ে নাই। কেন পড়ল না তা বুঝতে হলে হয়ত আরও একবার যেতে হবে। বর্গাকৃতি বড় সর্দারবাড়ির ভবন মধ্যভাগ লাল রঙা। যা মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ভবনটি ৩০ মিনিটের জায়গায় মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যেই প্রদক্ষিণ করে, আগালাম জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘরের দিকে। ভাগ্যিস তৃতীয় দফায় প্রবেশ ফি দেয়ার দরকার পড়ে নাই। ভেতরে ঢুকেই চোখ চড়কগাছ। থরেথরে কাচের গ্যালারিতে, সাজানো নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন। সেই সঙ্গে রয়েছে তথ্যপূর্ণ লেখা। ১৯৯৬ সালে স্থাপিত, বিশাল পরিসরের জাদুঘরটি তৃতীয়তলা। যে কারোই মন ভাল করে দেয়ার মতো, প্রায় ৪ হাজার প্রতœত্বাত্তিক নিদর্শন রয়েছে। এখানে কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে খাট-পালং, সিন্ধুক ও পালকি। যা পর্যটকদের সহজেই আকৃষ্ট করে। তরবারিসহ প্রাচীন মুদ্রা ও জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বেশকিছু ছবি প্রদর্শিত রয়েছে। আর রয়েছে তামা-কাসা, জমিদারদের ব্যবহৃত তৈজসপত্র ও খুঁজে পাওয়া কিছু দুর্লভ মূর্তি। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, আগে বড় সর্দারবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। সোনারগাঁ ছিল ঢাকার আগে তৎকালীন এদেশের রাজধানী। বাংলার বারো ভূইয়াদের মধ্যে অন্যতম শাসক, ঈশা খাঁ ছিলেন এর শাসনকর্তা। সোনারগাঁ দেশ-বিদেশে সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছে ঈশা খাঁর রাজধানী হিসেবে। তিনি ছিলেন বাংলার স্বাধীন ও বীর শাসক। তার শাসনামলে বাংলার অনেক উন্নয়ন ঘটেছিল। সোনারগাঁর মসলিন কাপড় ছিল জগদিখ্যাত। তখন থেকেই ইউরোপীয় বণিকদের পদচারণা ছিল সোনাগাঁয়ে। পরবর্তীতে জামদানি সুতি শাড়ি কাপড়ও বেশ সাফল্য পেয়েছে। সোনাগাঁর পূর্ব নাম ছিল সুবর্ণগ্রাম। কারুশিল্পেও সোনারগাঁর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ১২৯৬ হতে ১৬০৮ সাল পর্যন্ত মুসলিম শাসকদের অধিনে সোনারগাঁ রাজধানী ছিল। তখন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সোনারগাঁ, মুসলিম সংস্কৃতির চর্চার কেন্দ্রও ছিল। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ, আদিকাল থেকেই শিল্প-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। ১৬০৮ সালে মোঘল শাসকরা বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর তথা আজকের ঢাকায় স্থান্তর করার পর হতে, সোনারগাঁর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জৌলুস কমে আসে। তবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতœতত্ত্ব নগরী হিসেবে, আজও সোনারগাঁ অনন্য। যোগাযোগ : ঢাকার গুলিস্তান, মতিঝিল ও যাত্রাবাড়ী হতে বেশকিছু পরিবহন চলাচল করে সোনারগাঁর মোগড়াপাড়া পর্যন্ত। সেখান থেকে রিক্সা/অটোতে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। প্রবেশ ফি : লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে জনপ্রতি ৫০ টাকা। বড় সর্দারবাড়ি জনপ্রতি ১০০ টাকা। জয়নুল স্মৃতি জাদুঘর প্রবেশ ফি ফ্রি। তথ্য : প্রতি বুধ ও বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। প্রাকৃতিক সবুজে ঘেরা নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ১৫০ বিঘা আয়তনের, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের অভ্যন্তরে শিশুদের খেলার ব্যবস্থা, পুকুরে বোটে চড়ার সুযোগ, লাইব্রেরি ও হস্তসামগ্রী কেনাকাটার জন্য দোকানঘর রয়েছে। ঢাকার জিরো পয়েন্ট হতে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী, সোনারগাঁ জাদুঘর হতে দিনে দিনেই ঘুরে আসা যাবে।
×