ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ফাইনালে খুলনা টাইগার্সের হার ২১ রানে

নতুন চ্যাম্পিয়ন রাজশাহী রয়্যালস

প্রকাশিত: ১৩:০৮, ১৮ জানুয়ারি ২০২০

নতুন চ্যাম্পিয়ন রাজশাহী রয়্যালস

মিথুন আশরাফ ॥ রাজশাহী রয়্যালসের অধিনায়ক আন্দ্রে রাসেল বলেছিলেন, ‘ফাইনাল জেতার পর পার্টি হবে।’ তাই হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে (বিপিএল টি২০) চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রাজশাহী রয়্যালস। খুলনা টাইগার্সকে ২১ রানে হারিয়ে শিরোপা জয় করে রাজশাহী। বিপিএল ইতিহাসে নতুন চ্যাম্পিয়ন দলও মিলে যায়। প্রথমবারের মতো কোন বিদেশী ক্রিকেটার দলকে নেতৃত্ব দিয়ে চ্যাম্পিয়নও হন। রানার্সআপ হয় খুলনা। আন্দ্রে রাসেল আবারও ব্যাটিং ধামাকা দেখান। তার সঙ্গে মোহাম্মদ নাওয়াজ ব্যাটিং ঝড় তুলেন। আর শুরুতে ইরফান শুকুরের হাফসেঞ্চুরিতে বড় স্কোরই গড়ে রাজশাহী। বিপিএলের ফাইনালে ১৭১ রানের টার্গেট খুলনা টাইগার্সের সামনে ছুড়ে দেয় রাজশাহী। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে শুক্রবার রাতে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে টস জিতে আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয় খুলনা। দর্শকে কানায় কানায় পূর্ণ স্টেডিয়াম প্রথম ইনিংসে মাতিয়ে রাখেন রাজশাহী ব্যাটসম্যানরা। ইরফান শুকুরের ৫২ রানের ইনিংসের পর রাসেল (১৬ বলে অপরাজিত ২৭ রান) ও নাওয়াজ (২০ বলে অপরাজিত ৪১ রান) মিলে অবিচ্ছিন্ন ৭১ রানের জুটি গড়ে দলকে বড় স্কোরের দিকে নিয়ে যান। ৪ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ১৭০ রান করে রাজশাহী। জবাবে ৮ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ১৪৯ রান করতে পারে খুলনা। শামসুর রহমান শুভ সর্বোচ্চ ৫২ রান করেন। রাসেল, ইরফান ও রাব্বি দুটি করে উইকেট নেন। এত বড় টার্গেট। কিন্তু ১১ রানের মধ্যেই দুই উইকেটের পতন ঘটে যায় খুলনার। দলের ৪৭ রানের সময় ১৮ রানে থাকা রাইলি রুশোকেও আউট করার সুযোগ মিলে। কিন্তু কাভারে সহজ ক্যাচ ফেলে দেন আবু জায়েদ রাহী। এই ক্যাচ ফেলার সঙ্গে কী ম্যাচ ফেলাও হয়ে গেল? ৬ ওভারে ৪৮ রান করে খুলনা। শামসুর রহমান শুভ ও রুশো যেভাবে পথ চলতে থাকেন, খুব সহজেই ৫০ রানের জুটি গড়ে ফেলেন। মনে হয়, এই দুইজনই যা করার করে ফেলবেন। কিন্তু দলের ৮৫ রানে রুশোকে (২৫ বলে ৩৭ রান) আটকে দেন নাওয়াজ। শুভ-রুশো জুটি ৭৪ রান স্কোরবোর্ডে জমা করে। রুশো আউট হওয়ায় খুলনার বিপদও যেন আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। শুভ এত অসাধারণ ব্যাটিং করতে থাকেন। ৩৮ বলে হাফসেঞ্চুরিও করে ফেলেন। কিন্তু দলের ১০১ রান হতেই আউট হয়ে যান শুভ (৫২)। চাপে পড়ে যায় খুলনা। মুহূর্তেই ‘রিভিউ’ নিয়ে এলবিডব্লিউ হওয়া থেকে বেঁচেও আবার ক্যাচ আউট হয়ে যান নজিবুল্লাহ জাদরান (৪)। কামরুল ইসলাম রাব্বি নিজের তৃতীয় ওভার করতে এসে শুভ ও নজিবুল্লাহকে আউট করে দেন। খুলনাকে বিপত্তিতে ফেলে দেন রাব্বি। মুশফিক যখন ১৬ রানে, তখন থার্ড ম্যানে থাকা রাহীর কাছে ক্যাচ যায়। কিন্তু ক্যাচ ধরার চেষ্টাই করেননি রাহী। মুশফিক আউট হলে খেলা খুলনার হাত থেকে পুরোপুরিই চলে যেত। তা যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। দলের ১৩৪ রানে গিয়ে যখন মুশফিককে (২১) বোল্ড করে দিলেন রাসেল, খেলা রাজশাহীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। একটু পর রবি ফ্রাইলিঙ্কও (১২) সাজঘরে ফিরেন। শেষপর্যন্ত ১৪৯ রান করতে পারে খুলনা। ফাইনালে হেরে যায়। শুরুতে বিপদে পড়ে রাজশাহী। দলের ১৪ রান হতেই আফিফ হোসেন ধ্রুবকে (১০) আউট করে দেন মোহাম্মদ আমির। ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে শূন্যে ভেসে এমনই ক্যাচ ধরেন মেহেদি হাসান মিরাজ, প্রশংসায় ভাসেন। আফিফ আউট হওয়ার পর লিটন কুমার দাস ও ইরফান শুকুর মিলে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন। উইকেট টিকিয়ে রাখলে পরে রান হবেই। এমন ফর্মুলাতেই পথ চলেন। ধীর গতিতে রান হতে থাকে। ৬ ওভারে গিয়ে ৪৩ রান জমা হয়। ইরফান দ্রুতই রান তুলতে চেষ্টা করতে থাকেন। সেই তুলনায় লিটন একটু স্লো খেলেন। যখন দলের ৬৩ রান হয়, তখন পুল শট নিয়ে ডিপ স্কয়াল লেগে ক্যাচ আউট হয়ে যান লিটন (২৫)। তাতে করে দলের ২ উইকেটের পতন ঘটে যায়। রানের গতি এখন না বাড়াতে পারলে বড় স্কোর করা অসম্ভবই হয়ে পড়বে। ইরফানতো নিজ তালেই খেলতে থাকেন। ৩০ বলে গিয়ে হাফসেঞ্চুরিও করে ফেলেন ইরফান। দেশের জাতীয় দলের বাইরে প্রথমবারের মতো কোন ব্যাটসম্যান ফাইনালে হাফসেঞ্চুরি করেন। কিন্তু শোয়েব মালিক (৯) বড় কিছু করে দেখাতে পারেননি। দলের ৯৪ রানে গিয়ে কাভারে ক্যাচ আউট হয়ে যান। মালিক আউট হতেই ব্যাট হাতে নামেন আন্দ্রে রাসেল। আর স্টেডিয়ামে ‘রাসেল, রাসেল’ ধ্বনি উঠতে থাকে। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচে তার ২২ বলে অপরাজিত ৫৪ রানের ঝড়ো ইনিংসেই ফাইনালে খেলে রাজশাহী। আরেকটা ধামাকা ইনিংসের আশা থাকে। নিজের তৃতীয় ওভার করতে এসে দ্বিতীয় বলে ফিল্ডিং পরিবর্তন করেন আমির। ফাইন লেগে ফিল্ডার রাখেন। আমিরের জালে আটকা পড়েন ইরফান (৩৫ বলে ৫২ রান)। দলের ৯৯ রানে গিয়ে ক্যাচ আউট হয়ে সাজঘরে ফিরেন। ১৫তম ওভারে গিয়ে ১০০ রান স্কোরবোর্ডে জমা হয় রাজশাহীর। রাসেল ঝড় যদি আবার না দেখা যায়, তাহলে বড় স্কোর মজবুত হওয়ার কোন সম্ভাবনাই দেখা যায়নি। দলের যখন ১০৮ রান, রাসেলের ৭ রান, এমন মুহূর্তে এক্সট্রা কাভারে রাসেলের ক্যাচ ধরতে ব্যর্থ হন নাজমুল হোসেন শান্ত। তখন সবার মুখে একটি কথা বের হয়েছে, যেন হাতের মুঠো গলে ম্যাচটিই চলে যাবে। রাসেল যে শেষমুহূর্তে ভয়ঙ্কর ব্যাটিং করেন। রাসেল ব্যাটিং ঝড় তুলবেন কি, পাকিস্তানের মোহাম্মদ নাওয়াজ সেই কাজটি করে দিতে থাকেন। রবি ফ্রাইলিঙ্কের করা ১৮তম ওভারের প্রথম তিন বলেই এক চার ও দুই ছক্কা হাঁকান। পঞ্চম বলে আরেকটি বাউন্ডারিসহ এই ওভারটিতেই ২১ রান নেন নাওয়াজ। মুহূর্তেই দল ১৪০ রানের কাছে চলে যায়। বাকি থাকে ইনিংসের দুই ওভার। যা করার শেষ ১২ বলেই করতে হবে। বড় স্কোর গড়তে হলে বাউন্ডারির পর বাউন্ডারির কোন বিকল্প নেই। আমিরের করা ১৯তম ওভারের তৃতীয় বলে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে এমন এক ছক্কা হাঁকান, যা এবারের বিপিএলে সবচেয়ে বড় ছক্কা হয়ে থাকে। ওভারটিতে নাওয়াজ আরও দুটি বাউন্ডারি মারায় ১৮ রান আসে। ১৫৫ রানে চলে যায় রাজশাহী। শেষ ওভারে শফিউল ইসলাম বল করতে আসেন। রাসেল তৃতীয় বলে ছক্কা হাঁকান। ওভারটিতে ১৫ রান আসে। তাতে করে শেষপর্যন্ত বড় স্কোরই হয়। ১৭০ রান করে রাজশাহী। নাওয়াজ ২০ বলে ৬ চার ও ২ ছক্কায় অপরাজিত ৪১ রান করেন। আর রাসেলের ব্যাট থেকে আসে ১৬ বলে তিন ছক্কায় অপরাজিত ২৭ রান। ১৭ ওভারে ১১৬ রানে থাকে রাজশাহী। সেখান থেকে শেষ ৩ ওভারেই ৫৪ রান আসে। রাসেল ও নাওয়াজের ৩৪ বলে করা অবিচ্ছিন্ন ৭১ রানের জুটিতেই তা সম্ভব হয়। বড় টার্গেটই খুলনার সামনে ছুড়ে দেয় রাজশাহী। এই টার্গেটই খুলনার সামনে পাহাড়সম হয়ে দাঁড়ায়। ফাইনালে হেরে রানার্সআপও হয় খুলনা। যেহেতু দেশী অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ও বিদেশী অধিনায়ক আন্দ্রে রাসেলের মধ্যেও শিরোপা উঁচিয়ে ধরার একটা প্রতিযোগিতা চলে, তাই সবার প্রশ্ন থাকে, দেশী অধিনায়কের হাতে শিরোপা শোভা পাবে, নাকি বিদেশী অধিনায়কের হাতে? খুলনার দেশী অধিনায়ক মুশফিক শিরোপা উঁচিয়ে ধরবেন, নাকি রাজশাহীর বিদেশী অধিনায়ক রাসেল? যিনিই ২১ লাখ টাকা দামের শিরোপা জেতেন, প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পাবেন। শেষপর্যন্ত সেই মিষ্টি স্বাদ পেলেন রাসেল। দেশী অধিনায়কদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ধারা বজায় রাখতে পারেননি মুশফিক। রাসেল টানা দ্বিতীয়বার ফাইনাল খেলে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতেন। বরাবরই বিপিএলে দেশী অধিনায়কের হাতেই শিরোপা দেখা গেছে। এরআগে ছয়বারের মধ্যে মাশরাফি বিন মর্তুজা চারবার, সাকিব আল হাসান ও ইমরুল কায়েস একবার করে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে শিরোপা জেতেন। সপ্তমবারে এসে তার পরিবর্তন হয়েছে। এরআগে বিদেশী অধিনায়কদের মধ্যে ২০১২ সালে প্রথম বিপিএলে বরিশাল বার্নার্সের অধিনায়ক হিসেবে শিরোপা জয়ের সুযোগ পান অস্ট্রেলিয়ার ব্র্যাড হজ। কিন্তু হজকে শিরোপা জিততে দেননি মাশরাফি। এবার রাসেল জিতে দেখান। বিদেশী অধিনায়কের হাতেই শেষপর্যন্ত শিরোপা শোভা পেল। লীগ পর্বে দুই দল পরস্পরের বিরুদ্ধে দুইবার লড়াই করে। একবার রাজশাহী, আরেকবার খুলনা জিতে। প্রথম কোয়ালিফায়ারে এসে ২৭ রানে খুলনার কাছে রাজশাহী হেরে যায়। ফাইনালে রাজশাহী প্রতিশোধ নেয়। এবার সপ্তমবারের মতো বিপিএল হচ্ছে। এরআগে ছয়বার হওয়া বিপিএলে তিনবার ঢাকা চ্যাম্পিয়ন হয়। দুইবার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স চ্যাম্পিয়ন হয়। একবার রংপুর রাইডার্স চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১২ সালের বিপিএলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, ২০১৩ সালে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, ২০১৫ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স, ২০১৬ সালে ঢাকা ডায়নামাইটস, ২০১৭ সালে রংপুর রাইডার্স, ২০১৯ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স চ্যাম্পিয়ন হয়। এবার রাজশাহী শিরোপা ঘরে তুলল। রাজশাহীর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিপিএলের পর্দাও নামল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে এবার বিশেষ বিপিএল আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিসিবির অধীনেই হয়েছে লীগ। প্রথমবারের মতো ফ্র্যাঞ্জাইজি ছাড়া হয় লীগ। প্রথমবারের মতো বিপিএলের নামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নামটিও জড়িত হয়। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধুর নামেই হবে বিপিএল। বঙ্গবন্ধু বিপিএল শুরু হয়েছিল গতবছর ডিসেম্বরের ১১ তারিখ। দেখতে দেখতে ৩৮ দিনের লীগ শেষ হয়েছে। ৭টি দল অংশ নিয়েছে। লীগ পর্বে প্রতিটি দল মোট ১২টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে। এরপর পয়েন্ট তালিকায় সেরা চার দল ‘প্লে-অফে’ খেলেছে। শেষপর্যন্ত ফাইনালে উঠে খুলনাকে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের শিবিরে নিতে পেরেছে রাজশাহী। স্কোর ॥ খুলনা টাইগার্স-রাজশাহী রয়্যালস ম্যাচ-মিরপুর টস ॥ খুলনা টাইগার্স (ফিল্ডিং)। রাজশাহী রয়্যালস ইনিংস ১৭০/৪; ২০ ওভার; শুকুর ৫২, নাওয়াজ ৪১*, রাসেল ২৭*; আমির ২/৩৫। খুলনা টাইগার্স ইনিংস ১৪৯/৮; ২০ ওভার; শামসুর ৫২, রুশো ৩৭, মুশফিক ২১; ইরফান ২/১৮। ফল ॥ রাজশাহী রয়্যালস ২১ রানে জয়ী। লীগ ॥ চ্যাম্পিয়ন রাজশাহী রয়্যালস। ম্যাচ সেরা ॥ আন্দ্রে রাসেল টুর্নামেন্ট সেরা ॥ আন্দ্রে রাসেল
×