ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডাঃ এম এ হাসান

মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ মাতা সালেমা বেগম

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ মাতা সালেমা বেগম

পরাধীন ভারতে স্বদেশী আন্দোলন ও বিপ্লবী যুগে প্রগতিশীল এক পরিবারে বেড়ে ওঠা এক নারী সালেমা বেগম। তাঁর ডাক নাম রানী। ব্রিটিশশাসিত ভারতে ছোটলাট নিয়োজিত এক পুলিশ কর্মকর্তার প্রিয় কন্যা রানী। ১৯২৫ সালের ১৮ নবেম্বর শুক্রবার কুয়াশাচ্ছন্ন প্রত্যুষে জন্ম হয় তাঁর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। নদীয়া জেলার টলটলে এক নদীর ধারে প্রকৃতির স্নেহছায়ায় বেড়ে ওঠা বিদ্যানুরাগী দুরন্ত এক মেয়ে রানী। স্মৃতিকথায় তিনি লেখেন- ‘নদীয়া জেলার এক অখ্যাত শহরে ছায়াঘেরা, মায়াভরা মাটির ঘরে আমার জন্ম। গ্রামের নাম আলমডাঙা। আর মাটির ঘরে জন্ম বলেই হয়ত মাটি আর গাছের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক। মাটি আমার খুব প্রিয়, আর সবুজ গাছপালা আমার প্রাণ, আমার জীবন।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘৪ বছর বয়স থেকে জীবনে যা কিছু দেখেছি, তা এখনও দু’চোখে ভাসে। তখন আমার বাবা চুয়াডাঙ্গা শহরে, সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা একটি বাড়িতে থাকতেন। কাছেই ছিল নদী- স্বচ্ছ পানিতে টলমল করত স্নিগ্ধ শান্ত বনবনানীর ছায়ায়। এমন শান্তির নীড় মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে উঠত বিপ্লবের যুগে। শহরের বড় বড় দোকানগুলোর সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সবাই বলত, বিলেতি কাপড়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা ছোটরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই বহ্নৎসব দেখতাম। আরও দেখতাম, অনেক ভদ্রলোকদের ধরে ধরে জেলখানার মধ্যে ভরছে; কিছু লোক আবার স্লোগান দিচ্ছে ‘বন্দে মাতরম’। তারা সবাই শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি- কেউ উকিল, কেউ শিক্ষক, কেউ রাজনীতিবিদ। তারা সবাই ছিলেন আমার বাবার বিশিষ্ট বন্ধু। ‘আমার বাবার মনের মধ্যে যে দেশপ্রেম, মানবিক বোধ ও সহমর্মিতা ছিল তা পরবর্তীতে আমার ও আমার বড় ভাইয়ের মনের মধ্যে ছায়া ফেলেছিল। তাই ছোট বয়স থেকেই দেশের জন্য মমত্ববোধ জেগে উঠেছিল। আস্তে আস্তে যত বড় হতে লাগলাম ততই দেশ আমার প্রাণের থেকে প্রিয় হলো। এমনি করেই হয়ত আমার প্রতি রক্তবিন্দুতে দেশের মঙ্গল, দেশের জনগণের জন্য ভালবাসা জেগে রইল, যা পরবর্তীতে আমার সন্তানদের রক্তের মধ্যে সঞ্চারিত হলো।’ স্মৃতি কথায় তিনি বলেন- ‘চাকদহ থাকতে প্রায়ই কলকাতা যেতাম। বছরখানেক ছিলাম চাকদহতে। এই চাকদহ থেকেই আমার বই পড়ার অভ্যাস হলো। অভ্যাস ছিল উপন্যাস পড়া। তাই লাইব্রেরীতে বই ফেরত দিতে গিয়ে অপেক্ষমাণ থেকেও বই পড়তাম। চাচারা কলকাতায় থাকতেন। পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না। মাঝে মধ্যে বাবা নিজে সঙ্গে নিয়ে দেখার জিনিসগুলো দেখিয়ে আনতেন। ‘এরমাঝে রানাঘাট থেকে বাবা মুর্শিদাবাদ বদলি হয়ে গেলেন। ১০ বছর পরে বাবা খুলনা জেলায় বদলি হয়ে এলে আমরাও খুলনা এলাম। মনে হলো স্বর্গ থেকে নরকে এসে পড়লাম। ঘরে বসে পড়াশোনা করা আর নদীর পাড়ে বসে বসে দিন কাটানোÑ এই ছিল কাজ। তবে খুলনার ঐ বটিয়াঘাটা থেকেই আমার সত্যিকারের পড়াশোনা আরম্ভ হলো। আমার ভাই যে কলকাতা গিয়েছিল, সে খুলনা জেলা স্কুলে এসে ভর্তি হলো। প্রত্যেক ছুটির দিন ওখানে আসত নানা রকম জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই, স্বাধীনতা ও বিপ্লবের বই, রাজনীতির বই, অনেক রকম ইংরেজী বইয়ের অনুবাদ- পৃথিবী সৃষ্টির বই, মানব জীবন বিকাশের বই, কত রকম বই যে ভাই আনতো এবং আমাকে নিবিষ্ট ছাত্রী করে পড়াত! সে এক নতুন আনন্দ, শেখার আনন্দ, জানার আনন্দ, বোঝার আনন্দ। ‘বটিয়াঘাটা ছিল একটা দ্বীপের মতো। তাই বোধহয় ব্রিটিশ সরকার স্বাধীনতা বিপ্লবীদের সেখানে আটক করে রাখত। আটক মানে জেলের মধ্যে নয়। তাদের জন্য ছোট ছোট ঘর করে দিত, যাতে তারা নিজে নিজে স্বাধীনভাবে থাকতে পারে। বটিয়াঘাটায় কোন স্কুল না থাকায় বাবা আমাদের ভাইবোনদের সেই সব বিপ্লবীদের কাছে প্রাইভেট পড়তে দিলেন। সেই সব বিপ্লবীদের কাছেই শিখলাম- দেশের কথা, মাতৃভূমির কথা, স্বাধীনতার কথা। জানলাম, মতিলাল নেহরু ও গান্ধীর কথা। জানলাম ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা ও সূর্যসেনের নাম এবং দেশের জন্য তাদের অবদান। পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়া আরও অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে শিখলাম। দেশকে চিনতে ও জানতে শিখলাম। শুরু হলো অন্যরকম জীবন। ‘হঠাৎ করে শুনলাম যে, আমার বিয়ে হবে। আমি তো অবাক! এখন আমার বিয়ে হবে কেন? পড়াশোনা করছি, রাজনীতি করছি, হেসে খেলে দিন কাটাচ্ছি। খামাখা ঝামেলা কেন? আমার বড় ভাই, আমার গুরু, আমার শিক্ষক, আমার বন্ধু-যে আমাকে ভালবাসে, উপদেশ দেয়, শাসন করে, আদরে মন ভরে দেয়; তাকে বললাম, ‘এ সব হবে না। ভাই আমাকে বোঝালো, ‘ভদ্রলোক খুব ভাল মানুষ। তোর কোন অসুবিধা হবে না।’ ‘১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি বিয়ে হলো। সেদিন ছিল শুক্রবার। শনিবার ২৪ জানুয়ারি, ভাই আমাকে বলল আজ থেকে ইনিই তোর গুরু, শিক্ষক ও বন্ধু। ভাইয়ের কথা মেনে নিলাম। হ্যাঁ, আমৃত্যু আমার স্বামী, আমার বন্ধু, শিক্ষক ও গুরু ছিলেন। আমিও আমৃত্যু তাকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করব। ‘আমার প্রথম সন্তান- মেয়ে, ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে তার জন্ম। তখন মহাযুদ্ধের দাবানল। সেই বছরই বা কিছু পরে রায়ট হয় ভারতের নানা স্থানে। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল, অন্যদিকে রায়ট। কলকাতা থেকে আমার স্বামী এবং আমার ভাই বরিশাল চলে আসে। এরপর ১৯৪৭-এ ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেল। আমার বড় ছেলের জন্ম হয় ১৯৪৮ সালের ১৯ মে। ছোট ছেলের জন্ম হয় ১৯৫০ সালের ১৪ মার্চ, বাগেরহাটে। আমার ছোট মেয়ের জন্ম হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ৯ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে। আমার চারটি সন্তানÑ দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ’৭১-এ বড় ছেলে যখন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশোনা করছে এবং ছোট ছেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ছে, তখন তারা দু’জন যুদ্ধে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনারা গুঁড়িয়ে দেয় শহীদ মিনার, ইকবাল হল, ঢাকা হল। জগন্নাথ হলের ছাত্র ও শিক্ষকদের নির্মমভাবে হত্যা করে। যারা জীবিত ছিল, তাদের বাঙ্কারের ভেতরে ফেলে তাদের ওপরে মাটি চাপা দিয়ে জীবিত কবর দেয়া হয়। এসব কথা শুনে আমার দু’সন্তান- সেলিম ও হাসানকে যুদ্ধে পাঠালাম। যুদ্ধে পাঠানোর সময় বললাম, ‘যাচ্ছ বীরের মতো, আসবে বীরের মতো; পিঠে গুলি নিয়ে ফিরবে নাÑএ আমার বিশ্বাস ও দোয়া।’ যুদ্ধে যাবার সময় আমি নিজ হাতে আমার বাসার গেট খুলে দিলাম। আমি ও আমার স্বামী আমাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। অঝোর ধারায় কাঁদছি। কিছুক্ষণ পর ভাবলাম, ওরা তো যাচ্ছে দেশ স্বাধীন করতে। আমি কেন কাঁদছি! তবু মায়ের মন তো! এর মধ্যে সারা বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। শুরু হলো প্রতীক্ষা। কবে ফিরে আসবে, আমার বুকের ধনরা, আমার সোনা মানিকরা? অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকলাম। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়। দিনগুলো কত বড়, শেষ হয়েও শেষ হয় না। আমরা কতগুলো অবরুদ্ধ খাঁচার প্রাণী! জোরে হাসতে পারি না। মনের দুঃখে কাঁদতেও পারি না। পারি না স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে। এই হঠাৎ কারফিউ, এই হঠাৎ ব্ল্যাক আউট, আবার হঠাৎ প্রচণ্ড গোলাগুলি। বিভীষিকাময় দিনরাতÑ এমনিভাবেই দিনগুলো যাচ্ছে। খেতে বসলে মনে হতো আমার সোনা মানিকরা কি খাবার যোগাড় করতে পেরেছে? ঘুমাতে গেলে মনে হতো, ওরা এখন কোন বনবাদাড়ে শীতের মধ্যে এক কাপড়ে শত্রুর জন্য ওঁত পেতে বসে আছে অভুক্ত পেটে। নির্ঘুম চোখে তখন খাবার মনে হতো বিষ। বিছানা মনে হতো কন্টক শয্যা। ‘প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায় দরুদ ও আয়তুলকুরসি পড়ি। আস্তে আস্তে যুদ্ধ শেষের দিকে এলো। ১৬ ডিসেম্বর বহু প্রতীক্ষিত, বহু আকাক্সিক্ষত ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা লাল পথ ধরে বিজয় দিবস এলো। ঢাকার বুকে বাংলাদেশের পতাকা পত পত করে উড়ছে, চোখ জুড়িয়ে গেল। বিকেলে দেখলাম ইন্ডিয়ান ট্যাঙ্ক বহর ঢাকার রাজপথে। ‘সন্ধ্যার সময় দেখতে পেলাম ৬০ হাজার পরাজিত হানাদার বাহিনীর একটি দল বন্ধুকের নল নিচু করে, মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে শহরের দিকে। এই বন্দুক দিয়ে কত মায়ের বুক খালি করেছে, কত পিতাকে করেছে সন্তানহারা এই জালিম বাহিনী। এর কতক্ষণ পরে আমার দু’চোখ ভরে এলো পানি। আমার ছেলেরা কোথায়? আমার ছেলেরা কি জীবিত আছে, দেখা কি হবে? যদি ফিরে না আসে, ওদের অভাব বুকে নিয়ে কিভাবে বাঁচব? নানা রকম এলোমেলো চিন্তায় মন খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলাম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালাম, আমার ছেলেদের ফিরিয়ে দাও, তুমি তো অসীম করুণাময়। ১৭ ডিসেম্বর সকালে তেজগাঁর দিকে হেঁটে হেঁটে রওনা দিলাম। মন বলছে, ছেলেরা আমার বেঁচে থাকলে অবশ্যই একবার আমার খোঁজে তেজগাঁর বাসায় যাবেই। তাই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হেঁটে হেঁটে ফার্মগেট পর্যন্ত গেছি। এমন সময় আমার এক আত্মীয় অনেক দূর থেকে চিৎকার করে বলছে, বড় আপা তোমার ছেলেরা ফিরে এসেছে। ওরা বাংলাদেশের আর্মি অফিসার। তুমি আমার বাসায় যাও, সেলিম তোমার সঙ্গে ওখানে দেখা করতে যাবে। আমি আনন্দে অধীর হয়ে জোর কদমে আত্মীয়ের সেই বাসায় নিষ্পলক চোখে উদগ্রীব হয়ে ওর অপেক্ষায় থাকলাম। উৎকর্ণ হয়ে থাকলাম ওদের পায়ের শব্দ শোনার জন্য। অবশেষে সেই পরমক্ষণটি এলো, যার জন্য দীর্ঘ নয়টি মাস গভীর আগ্রহে দিন গুনেছি। সেলিম একটানা বারান্দার ওপর দিয়ে বীর পদক্ষেপে হেঁটে আসছে। আমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। চলবে... লেখক : চেয়ারপারসন, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশ
×