ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রক্ষা পাবে বাংলাদেশ ॥ আবারও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা

প্রকাশিত: ১১:০৭, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

রক্ষা পাবে বাংলাদেশ ॥ আবারও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা

এম শাহজাহান ॥ প্রায় দশ বছর পর আবার সদর্পে ফিরে আসছে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। কম মূল্যের পণ্য উৎপাদন ও তা রফতানি করায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘মন্দা’ স্পর্শ করতে পারবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে আমেরিকা ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে এবারের অর্থনৈতিক মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে, আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা সম্প্রতি ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকাকে বলেছেন, আর্থিক খাতে অস্থিতিশীলতা ও চরম আয়-সম্পদ বৈষম্যের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছে। বর্তমান সমস্যা তৈরির পেছনে আমেরিকা, ইউরোপ ও চীনের বাণিজ্যনীতিও অনেকাংশে দায়ী। এ কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। এদিকে, সারা বিশ্ব মন্দায় আক্রান্ত হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নিরাপদে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে কম মূল্যের পণ্য উৎপাদন ও তা রফতানি করায় বাজার হারানোর ঝুঁকি নেই বাংলাদেশের। স্বল্প ও মধ্যম আয়ের ভোক্তা শ্রেণীই বাংলাদেশের পণ্যের প্রধান ক্রেতা। এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধি এ যাবতকালের মধ্যে এখন সবচেয়ে ভাল অবস্থায় রয়েছে। চলতি বাজেটে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ায় ইতোমধ্যে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আশা করা হচ্ছে, বছর শেষে ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন বেশি রেমিটেন্স আহরিত হবে। গত অর্থবছরে সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আহরিত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের কৃষি ও সেবা খাতের উৎপাদন এবং রফতানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েক বছরে কৃষি উৎপাদন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে আইএমএফ প্রধানের আশঙ্কা অমূলক নয়, তবে বাংলাদেশের এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। সতর্ক অবস্থায় থেকে অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ উন্নয়নে বাংলাদেশ যা করছে তা দক্ষতার সঙ্গে করতে পারলেই মন্দার কবল থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন ও উৎপাদনে যেতে হবে। এছাড়া কারেন্সি ডিভ্যালু, অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি ও সার্ভিস খাতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর দেয়া প্রয়োজন। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রধান বলছেন, চরম আয় বৈষম্য এবং আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতার দ্বারা পরিচালিত বিশ্ব অর্থনীতি মহা হতাশা ফিরে আসার ঝুঁকি নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি তিনি ওয়াশিংটনের পিটারসন ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্সে বক্তব্য রাখেন। ওই সময় তিনি বলেন, ১৯২৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে রকম ভয়াবহ মন্দা তৈরি হয়েছিল, সেইরকম আরেকটি মন্দা আসন্ন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য শীর্ষ দশ অর্থনীতির একটি দেশ। কিন্তু সেখানে এখন সবচেয়ে বেশি আয় ও সম্পদ বৈষম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, বিশ্বব্যাপী দ্রুত জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। এর কারণে বিশ্বব্যাপী সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় যে ধরনের প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন তা গরিব দেশগুলোতে নেই। শুধু তাই নয়, তিনি বলেন, আমেরিকা ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্বে নতুন সঙ্কট। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে বিরোধ এখনও অব্যাহত রয়েছে। ট্রাম্প তার চীন বাণিজ্য চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য আপগ্রেড প্রয়োজন। তিনি বলেন, অতিরিক্ত আয় ও সম্পদ বৈষম্যের কারণে অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করছে। তিনি জানান, দাতব্য সংস্থা জুবলি ইউএসএ-এর প্রধান এরিক লেকম্পেট বলেছিলেন, ‘আইএমএফ আরও এক বৃহত্তর আর্থিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সম্পর্কে এক স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। বাজারে স্থিতিশীলতার উত্থান ও উদ্বেগের ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ায় আমাদের এই সতর্কতাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত। সরকারী ব্যয়গুলো নিচের অংশে সাহায্যকারীর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হলেও জর্জিভা বলেছেন, আমরা প্রায়শই আর্থিক খাতকে উপেক্ষা করি, যা বৈষম্যের ওপর গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বৈশ্বিক কারণে বাংলাদেশ এখনও সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম মূল্যের পণ্য তৈরি তা রফতানি করছে। উন্নত বিশ্বের স্বল্প আয়ের ভোক্তারাই এর প্রধান ক্রেতা। ফলে বিশ্বব্যাপী চরম মন্দা তৈরি হলেও এদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে সেবা খাতের পণ্য রফতানিতে নজর দেয়ার পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া কারেন্সি ডিভ্যালু, চলমান অবকাঠামো দ্রুত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো দ্রুত চালু করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, এর আগে ২০০৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা তৈরি হয়। বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। কিন্তু রফতানিতে প্রণোদনা, কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান, অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরিসহ নানা পদক্ষেপে সেই সময় মন্দার ছোবল থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশের অর্থনীতি। ওই সময় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় ছিল। স্বল্প মূল্যের শ্রমিক, কম মূল্যের পণ্য উৎপাদন ও নতুন নতুন বাজারের সম্প্রসারণ হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্দার কবল থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, গত পাঁচ বছর ধরেই মন্দার কবলে বিশ্ব। কিন্তু এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে স্পর্শ করতে পারেনি অর্থনৈতিক মন্দা। এটিই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভাল খবর। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বরাবর কম মূল্যের পণ্য উৎপাদন ও রফতানি করছে। এ কারণে ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা কমছে না। তারপরও বাংলাদেশকে সতর্কতার সঙ্গে পথ চলা প্রয়োজন। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সার্ভিস খাতে সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন। সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এদিকে, আইএমএফ গত জুলাই মাসে বিশ্ব অর্থনীতির হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনেও বিশ্বমন্দার আশঙ্কার কথা আছে। বলা হয়েছে, প্রাক্কলনের তুলনায় বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমবে। এ জন্য মূলত দায়ী করা হচ্ছে বড় দুই দেশের বাণিজ্য যুদ্ধকে। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ২ শতাংশ আর আগামী ২০২০ সালে হবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ গত এপ্রিলেই আইএমএফ বলেছিল, চলতি বছরে প্রবৃদ্ধি হবে আরও বেশি, যথাক্রমে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ ও ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। সংস্থাটির প্রাক্কলন অনুযায়ী, আগামী বছর প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি কমবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে প্রবৃদ্ধির হার কমে হবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। আইএমএফ বলছে, বিশ্বের আর্থিক বাজারও এখন যুদ্ধ করছে মূলত দুই শক্তির সঙ্গে। কেননা বাণিজ্যযুদ্ধ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্রমেই শঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারা মনে করছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর প্রভাব আরও বিরূপ হবে।
×