ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সারতাজ আলীম

যুদ্ধ যদি বেধেই যায় তবে!

প্রকাশিত: ১২:১৫, ১৯ জানুয়ারি ২০২০

যুদ্ধ যদি বেধেই যায় তবে!

সম্প্রতি বাগদাদে ইরানের সমরবিদ এবং অন্যতম নীতিনির্ধারক কাশেম সুলাইমানি মার্কিন হামলায় নিহত হওয়ার পর থেকে ইরান বার বার মার্কিনীদের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিশোধ নেয়ার কথা বলছে। সেই প্রতিশোধ থেকেই ইরান আমেরিকার দুই ঘাঁটি লক্ষ্য করে ২২টি মিসাইল ছুড়ে মারে। অনুষ্ঠানিকভাবে পদমর্যাদা যাই হোক না কেন হাজি কাশেম নামে পরিচিত এই ব্যক্তিকে ইরানের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। বিশ্লেষকরা বলেছিলেন ইরান সরাসরি মধ্যপ্রাচ্যের আমেরিকান ঘাঁটিগুলোতে হামলার ফলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারত। যদিও বড় কোন ধরনের যুদ্ধ ছাড়াই এই উত্তেজনা কমানো গেছে। তবে ভবিষ্যতে আবার সরাসরি এই দুই রাষ্ট্র যুদ্ধে জড়াতে পারে। সামরিক শক্তিতে ইরান পিছিয়ে থাকলেও তাদের হাতে বেশ কিছু কারণ আছে যা মার্কিনীদের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। যুদ্ধ লেগে গেলে যদি চীন বা রাশিয়া ইরানকে সরাসরি বা অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে তাহলে সেটা ৩য় বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মধ্যপ্রাচ্যে পূর্ণ যুদ্ধ বাধলে সেটাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন তার ফলে বিশ্বের সামগ্রিক অর্থনীতিতে কি কি প্রভাব পড়তে পারে দেখে নেয়া যাক। হরমুজ পার্সিয়ান গালফের সরু সামুদ্রিক রুট হরমুজ প্রণালী নিয়ন্ত্রণ করে ইরান সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে এক প্রকার অচল করতে পারে। ১৬৭ কিলোমিটার লম্বা এবং ৯৬ কিলোমিটার চওড়া (কোথাও ৩৯ কিলোমিটার) এই প্রণালী দিয়ে বিশ্বের ৩৩ শতাংশ তরল গ্যাস এবং ২৫ শতাংশ তেল পরিবহন করা হয়। দৈনিক ১৮ মিলিয়ন ব্যরেল তেল পরিবহন হয় এখান দিয়ে। কমবেশি ১৪টি ট্যাঙ্কার জাহাজ এই তেল পরিবহন করে। হরমুজ ঘেঁষে রয়েছে ইরানের সমুদ্র উপকূল। উপকূল থেকে উড়ে আসা মিসাইল বা ইরানের ভূমি থেকে ড্রোন পাঠিয়ে ইরান এই জাহাজগুলোকে লক্ষ্য বানাতে পারে। এক একটা তেলের জাহাজে একটা দেশ কয়েকদিন চলার মত তেল থাকতে পারে। ইরানের মিসাইল হাজারটনি জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও জাহাজগুলোকে যে পঙ্গু করে সমুদ্রের এক জায়গায় স্থির করে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করবে সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। ইরান কয়েক মাস আগে ব্রিটিশ জাহাজ আটক করেছিল। একই কায়দায় তারা জাহাজ আটক করে নিজেদের বন্দরে নিয়ে যেতে পারে। অথবা তারা জাহাজ চলাচলে কর আরোপ করতে পারে। ব্যাপকভাবে জাহাজ চলাচল ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলে নেভাল মাইন দিয়ে এই প্রণালীকে জাহাজের কবরস্থান বানানোর সুযোগও ইরানের কাছে আছে। এ জন্যই পশ্চিমা দেশগুলো কয়েকবার এখানে নেভাল মাইন পরিষ্কার করার মহড়া দিয়েছে। নির্বিঘেœ জাহাজ চলতে পারার জন্য মার্কিন নৌবাহিনীর ৫ম নৌবহর হরমুজের পাছে মোতায়েন করা হয়েছে। তবে যুদ্ধকালীন সময়ে ইরানকে থামিয়ে রাখা যাবে কিনা প্রশ্ন উঠেছে। গত ডিসেম্বরে মার্কিন বিমানবাহী রণতরী আব্রাহাম লিঙ্কনের পিছু নিয়েছিল ১৮টি ইরানী রকেট বা মিসাইলবাহী স্পিডবোট। এতগুলো বোট থেকে মিসাইল ছুড়লে যুদ্ধজাহাজ যেখানে বিপদে পড়বে সেখানে ট্যাঙ্কারের মতো জাহাজ একেবারে অকেজো হয়ে যাওয়ারই কথা। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেছেন হরমুজ বন্ধ হলে তেলের দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। আর তাতে নড়ে যাবে বিশ্বের অর্থনীতি। এশিয়ান কিছু দেশও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমনটা হলে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে যদি রাশিয়া ইরানকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে কোথাও বাড়তি তেলের যোগান না দেয়। হরমুজ বন্ধ হলে সমুদ্র পথে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা হারাবে দুটি রাষ্ট্র। ইরাক এবং আরব আমিরাত। পার্সিয়ান গালফের এই সরু পথ দিয়েই এ দুই দেশের জাহাজগুলো খোলা আরব সাগরের দিকে যায়। সৌদির পূর্বাঞ্চলের সব বন্দরও অকেজো হয়ে পড়বে। আর তাই সবমিলে ইরানের কাছে হরমুজ খুবই গুরুত্বের। তেলক্ষেত্রে হামলা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের আশীর্বাদপুষ্ট ডজনখানেক মিলিশিয়া গোষ্ঠী আছে। অনেকদিন আগে হুথি মিলিশিয়ারা সৌদির রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত তেল সংস্থা আরামকোর তেলক্ষেত্রে হামলা করলে তাদের তেলের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। সব মিলে এই কোম্পানির বাজারমূল্য দুই ট্রিলিয়ন হতে তিন ট্রিলিয়ন ডলার যেটা প্রযুক্তি জায়ান্ট এ্যাপলের অন্তত দিগুণ বা তার বেশি। চীন, যুক্তরাষ্ট্র দিনে ১ মিলিয়ন ব্যারেলের বেশি তেল কিনে থাকে এই কোম্পানির কাছ থেকে। পূর্ণ যুদ্ধ বাধলে এ রকম আরও হামলা আমেরিকার মিত্রদের কপালে আছে সেটা প্রায় নিশ্চিত। এতে করে মার্কিনীদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর তেলের রফতানি শূন্যতে নেমে আসতে পারে। তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো দিশেহারা অবস্থায় পড়বে। শুধু যে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ বিপদে পড়বে তা কিন্তু নয়, বিপদে পড়বে এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোও। আর তাতে বিশ্বের অর্থনীতি যে একটা ঝাঁকি খাবে এটা একদম নিশ্চিত।
×