ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গোরা বিশ্বাস

সিটি নির্বাচন ও নাগরিক প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ০৮:০৯, ২০ জানুয়ারি ২০২০

  সিটি নির্বাচন ও নাগরিক প্রত্যাশা

নগরজুড়ে একদিকে যেমন বইছে ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়া আর অন্যদিকে বইছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের গরম বাতাস। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে অফিস-আদালত, দোকানপাট, পাড়া-মহল্লা, এমনকি গৃহিণীদের রন্ধনশালা পর্যন্ত। চায়ের দোকানে আড্ডা ক্রমেই জমতে শুরু করেছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুলতেই বড় বড় হেড লাইনে চোখে পড়ে প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ফর্দগুলো। মেয়র থেকে শুরু করে কাউন্সিলর প্রার্থী সকলের মুখে একই কথা- বাসযোগ্য ঢাকা চাই, পরিচ্ছন্ন নগর গড়ব, একটি নিরাপদ সুন্দর ঢাকা উপহার দেব ইত্যাদি। এরকম ডজনখানেক সুললিত মধুর বাণী ও আশ্বাসের সুবচন নগরবাসী সবারই মন ছুঁয়ে যাওয়ার কথা। কেননা ঢাকায় বসবাসরত প্রতিটি নাগরিকই চায় তাদের সন্তান ও পরিবারটি যেন একটি সুন্দর কোলাহলমুক্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে। প্রবীণরাও যাতে একটুখানি আরাম-আয়েশে আগামী দিনগুলো যেন কাটিয়ে যেতে পারে সে প্রত্যাশা থাকাটাই স্বাভাবিক। জনপ্রিয় একটি গানের মাধ্যমে বলা যায়Ñ সবাই তো সুখী হতে চায়/কেউ সুখী হয় কেউ হয় না। আসলেই একটি সবুজ সুন্দর নিরাপদ তিলোত্তমা ঢাকা গড়ার যে নাগরিক সুখ স্বপ্ন তা আদৌ পূরণ হয়েছি কি? সে প্রশ্ন নগরবাসীর মনে একটি দীর্ঘ সময় ধরে থেকেই যাচ্ছে। তুরাগ থেকে বুড়িগঙ্গা, মেঘনা থেকে ধলেশ্বরী বিশাল আয়তনের এই ঢাকায় প্রায় দুই কোটি লোকের বসবাস। প্রতিবছর এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সে তুলনায় বাড়ছে না সেবার মান। নাগরিক চাহিদা মিটাতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নগরবাসী যেন তাদের ট্যাক্সে দেয়া টাকায় বেশি সেবা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বর্তমান সরকার ২০১১ সালের শেষ দিকে ঢাকা সিটিকে উত্তর ও দক্ষিণ দুটি ভাগে ভাগ করে। তাতেও ঢাকার তেমন কোন পরিবর্তন সাধন হয়নি। নানা সমস্যাজর্জরিত ঢাকা এখন বসবাসের অযোগ্য এবং নোংরা শহরের প্রথম তালিকায় রয়েছে এটাই বাস্তবতা। কিছু বিষয় আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে। যেমন- বায়ুদূষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মশার উপদ্রব, বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা, যানজট, রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি সব মিলিয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে নাগরিক জীবন। এক তথ্যমতে জানা যায় প্রতিদিন ছয় হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয় সমগ্র ঢাকায়। তার মধ্যে চার হাজার টন বর্জ্য প্রতিদিন অপসারণ করে থাকে সিটি কর্পোরেশন। বাকি বর্জ্যগুলো রাস্তার ওপর খোলা আকাশের নিচে ফুটপাথের ওপর পড়ে থাকতে দেখা যায়, যা থেকে নানা ধরনের রোগের বিস্তার ঘটে। এ বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ অতীতেও খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই। ১৯৯৪ সালে নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ঢাকার প্রথম মেয়র প্রয়াত মোঃ হানিফ, তারপর প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এবং প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সময়কাল পর্যন্ত কেমন ছিল তা নগরবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক মাত্র দেড় বছর সময়ের মধ্যে ঢাকাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তার অসীম সাহস, ব্যক্তিত্ব ও কর্মোদ্দীপনা নগরবাসীর কাছে ছিল এক প্রেরণার উৎস। সে পথ অনুসরণ করেই উপনির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচিত হয়ে মোঃ আতিকুল ইসলাম বেশ কিছু কাজের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এবারও তিনি পরিকল্পিত নগর গড়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ, ছাদ বাগান, উত্তর সিটিকে সবুজ বেষ্টনীতে আচ্ছাদিত করা এবং নারীদের জন্য নিরাপদ শহর উপহার দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। একইভাবে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার তাপস ও বিএনপি মেয়র প্রার্থীগণসহ সকলেই তাদের নির্বাচনী কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। এখন তা কতটা বাস্তবায়ন হবে তা দেখার জন্য নগরবাসীকে অপেক্ষা করতে হবে। পরিশেষে বলা যায় যে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন যেহেতু স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ সেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান সেহেতু এখনকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা একটু বেশি। তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালনের ওপর দেশের রাজনীতি ও জাতীয় নির্বাচনে অনেকটাই ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে এবারের নির্বাচন সকল প্রার্থীর কাছেই একটি গুরুত্ববহন করে। কেননা ২০২০ সালকে সরকার মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বছরব্যাপী এই মহাউৎসব পালিত হবে এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর সুবর্ণজয়ন্তী জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করবে। সেই উৎসবে আগমন ঘটবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের। এসব চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই বিজয়ীদের মাঠে নামতে হবে। অতএব, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি যারাই নির্বাচিত হয়ে আসুন না কেন দলমত, পথ ও ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে উঠে নিঃস্বার্থভাবে সেবার মনোভাব নিয়ে একটি বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে ব্রতী হবেন তারা। তার জন্য চাই সৎ, কর্মঠ, যোগ্য নেতৃত্ব আর তা সম্ভব মানবতা, সহমর্মিতা, বিবেক ও নৈতিকতা। মানুষ সত্য ও সুন্দরের পূজারী। তাই সত্য ও সুন্দরই পারে একজন ব্যক্তি এবং জাতিকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে। তাই কথামালার রাজনীতি নয়, ভোটের আগে দেয়া ওয়াদাগুলোকে প্রত্যেক বিজয়ী প্রার্থীকে অন্তরে গ্রথিত করে শুধু ব্যানার ফেস্টুনে আবদ্ধ না রেখে মেয়রদ্বয় ও কাউন্সিলরগণ সকলের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাসযোগ্য একটি আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করবেন- এটাই জনগণের চাওয়া। লেখক : সাবেক কর্মকর্তা, ডিসিসি
×